Posts

চিন্তা

স্বাধীনতার কবি শামসুর রাহমান

August 17, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

102
View



কবিতার অক্ষরে অক্ষরে দেশপ্রেমের শাশ্বত ও অবিনশ্বর সৌধ বিনির্মাণ করতে পেরেছিলেন শামসুর রাহমান। যা তাঁকে বাংলা কবিতার নন্দিত পুরুষের মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছে। দেশজ স্বাজাত্যবোধ, মানুষ ও জনজীবন সম্পর্কিত এমন কোনো বিষয় নেই যা নিয়ে শামসুর রাহমান কবিতা লিখেননি। 

শামসুর রাহমান তাঁর কবিতার খাতায় আধুনিক কাব্যিক কলমে পরখ করেছেন প্রেম, ভালবাসা, প্রকৃতি, রাজনীতি, প্রতিবাদ, বিদ্রোহ, উপহাস, উচ্ছ্বাস, উদযাপন, উপলক্ষ, অভিবাদন এমনতর শত বিষয়। এরপধ্যে বাঙালির হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতা সবচে' বাঙ্ময় হয়ে ওঠেছে কবির রচনায়। তাঁর সকল কবিতার মূল সুরই যেন দেশপ্রেম। 

কূপমন্ডুকতা, অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা ও গোঁড়ামির বিরুদ্ধে বরাবর উচ্চকণ্ঠ থেকেছেন কবি শামসুর রাহমান। ফেসবুকে ধর্মের ধ্বজাধারী এখনকার প্রজন্ম নিশ্চিতই কবির এই চেতনাবিরোধী। 'তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা' তাদের ভালো লাগে না, তাই শামসুর রাহমানও তাদের পঠনপাঠনের ন্যূনতম অংশেও আর নাই। কী পরিবর্তন আমাদের? আমাদের কালের বাংলাভাষার প্রধানতম কবিকে আমরা অবলীলায় ভুলতে পেরেছি। 

স্কুল-কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে একসময় আবৃত্তি হতো, ‘স্বাধীনতা তুমি রবি ঠাকুরের অজর কবিতা অবিনাশী গান। স্বাধীনতা তুমি কাজী নজরুল ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা!’ শিল্পরসিক মানুষ ছাড়াও গণমানুষও উদ্দীপ্ত হতো এমন আধুনিক কবিতার শক্তিতে। আর আজকের উদ্দীপনার সবটা জুড়ে কেবল ফেসবুকের ফালতু ফেলনা 'টকিংস'! মনন ও মগজ সুস্থির করবার কাব্যসুধায় বাঙালির একদম মন নাই। 

আমাদের মহান স্বাধীনতার প্রশস্তিতে কবি কী দারুণ লিখেন-
স্বাধীনতা তুমি পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিন।
স্বাধীনতা তুমি
উঠানে ছড়ানো মায়ের শুভ্র শাড়ির কাঁপন।
স্বাধীনতা তুমি
বোনের হাতের নম্র পাতায় মেহেদীর রঙ।
স্বাধীনতা তুমি বন্ধুর হাতে তারার মতন জ্বলজ্বলে এক রাঙা পোস্টার। 

পেছনফেরা যে গোঁড়া মোল্লাতন্ত্র কবিকে বাতিলের খাতায় রেখে দিয়েছেন তারা কি 'পিতার কোমল জায়নামাজের উদার জমিনে'র সাথে স্বাধীনতার এমন উৎপ্রেক্ষা বা আলংকারিক সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারেন? 

একাত্তরের পাকিস্তানি হানাদার ও তাদের এদেশীয় দোসরদের বর্বরতার বিরুদ্ধে শামসুর রাহমানের 'অভিশাপ দিচ্ছি' সবচে' শক্তিশালী উচ্চারণ- 

না আমি আসিনি
ওল্ড টেস্টামেন্টের প্রাচীন পাতা ফুঁড়ে,
দুর্বাশাও নই,
তবু আজ এখানে দাঁড়িয়ে এই রক্ত গোধূলিতে
অভিশাপ দিচ্ছি। 

আমাদের বুকের ভেতর যারা ভয়ানক কৃষ্ণপক্ষ দিয়েছিলো সেঁটে
মগজের কোষে কোষে যারা
পুঁতেছিল আমাদেরই আপন জনেরই লাশ
দগ্ধ, রক্তাপ্লুত
যারা গণহত্যা করেছে
শহরে গ্রামে টিলায় নদীতে ক্ষেত ও খামারে
আমি অভিশাপ দিচ্ছি নেকড়ের চেয়েও অধিক পশু
সেই সব পশুদের।... 

শেরে বাংলার প্রোগ্রেসিভ রাজনীতির সাথে জড়িত বাবা মুখলেসুর রহমান চৌধুরীর অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও জনমানুষের প্রতি অপরিসীম দরদ কবির চেতনায়ও প্রবাহিত ছিল। শামসুর রাহমানের বিরুদ্ধে বারবার বিতর্ক তুলেছে কূপমন্ডুকরা। তারা শুধু বিতর্ক তুলেই থেমে থাকেনি। বর্বরতার চূড়ান্ত পর্যায় পর্যন্ত গিয়েছে। কবির মৃত্যু পরোয়ানা জারি করেছে। তাঁকে হত্যার জন্য বাসায় হামলা করেছে। এতকিছুর পরও কবি তাঁর বিশ্বাসের জায়গায় ছিলেন অনড়। নানামুখী চাপ সত্ত্বেও সামাজিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে সকল প্রগতিশীল আন্দোলনে নিজেকে সোৎসাহে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন। 

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও মোল্লাতন্ত্রের কাছে এমন ভয়াল উৎপীড়নের শিকার হয়েছেন। সর্বপ্রাণবাদী কবি, দার্শনিক ও বিজ্ঞান চিন্তকদের এ এক অমোঘ নিয়তি ও দুর্মর যন্ত্রণা এই যে, তারা উদারনৈতিকভাবে সর্বমানবের কথা সমান্তরালে ভাবেন বলে বিশেষ একটি গোষ্ঠীর রোষানলে পড়েন। মহামতি সক্রেটিস, কোপার্নিকাস, গ্যালিলিও বা কবি জালাল উদ্দিন রুমী কেউই রেহাই পাননি রুষ্ট ধর্মান্ধদের কাছ থেকে। 

কবি শামসুর বড় দুঃখবোধ নিয়েই সেই সময়ে লিখেন—
মোল্লাগুলো যখন-তখন
ফতোয়া জারি করে—
পাড়াগাঁয়ের দুলালিরা
দোর্রা খেয়ে মরে। 

দুখিনী সব মেয়েগুলো
বড় অসহায়
কী করে এই দুলালিদের
রক্ষা করা যায়? 

মোল্লাগুলোর জুলুমবাজি
খতম করার তরে
দেশের মানুষ সবাই মিলে
যেতে হবে ল’ড়ে। 

গোঁড়াবাদীদের এমনতর 'পন্ডশ্রম' এইসময়েও বড় বেশি প্রাসঙ্গিক। কবি লিখেন-
এই নিয়েছে ঐ নিল যাঃ
কান নিয়েছে চিলে
চিলের পিছে ঘুরছি ম’রে
আমরা সবাই মিলে… 

সুধীসমাজ! শুনুন বলি
এই রেখেছি বাজি
যে-জন সাধের কান নিয়েছে
জান নেব তার আজই। 

আমাদের এখনকার চিলটি বাস করে ফেসবুক নামের টাইমলাইনে। মাঝেই মাঝেই ধর্মানুভূতির কর্ণটা নিয়ে চিলটা দেয় ছুট। আর যমদূত নয় খোদ উজবুক আমরাই ছুটি চিলটার প্রাণহরণের বদ নেশায়। হত্যা, খতম আর বিনাশ আমাদের আরাধ্য -প্রেম সে কিছুতেই নয়! 

একটা সময় বাংলা কবিতার একচ্ছত্র আনাগোনা ছিল কলকাতায়। শামসুর রাহমান বাংলা সাহিত্য ও বাংলা কবিতার এমন এক পুরোধা যিনি রবীন্দ্রোত্তর পঞ্চকবির আধুনিক ঐতিহ্য ভূমির উপর দাঁড়িয়েও কবিতা, ভাষা ও সাহিত্যে এক অনন্য ও ব্যতিক্রম 'মনুমেন্ট' নির্মাণ করলেন যার ধারক হয়ে ওঠল আমাদের প্রাণের বাংলাদেশের ঢাকা। তিনি বাংলা কবিতাকে আমাদের গর্ববোধের জায়গায় পৌঁছে দিয়ে গেছেন। 

কবি শামসুর রাহমানের অমৃত কলমে শব্দরা জীবনবাদিতার কথা কয়ে ওঠত। এক অনির্বচনীয় বিস্ময়কর আনন্দ ধরা দিত প্রতিটি পঙ্ক্তিমালার পরতে পরতে। যেমনটা কবি নিজেই লিখেন-
শব্দ সে তো জোছনা নাওয়া নদীর তীর
শব্দ সে তো সন্ধেবেলার মেলার ভিড়।
শব্দ সে তো ভর-দুপুরে শঙ্খচিল
শব্দ সে তো টলটলে ওই পদ্ম বিল।


আমাদের ভূমিরাষ্ট্রের বাঁকবদলের উত্তাল সময় ১৯৭০ সালে প্রকাশিত তাঁর 'নিজ বাসভূমে' কাব্য তিনি উৎসর্গ করেন আবহমান বাঙলার শহিদদের উদ্দেশ্যে। ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, ‘ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯’, ‘পুলিশ রিপোর্ট’, ‘হরতাল’, ‘এ লাশ আমরা রাখব কোথায়’, এ কবিতাগুলির ছত্রেছত্রে চিহ্নিত হয়ে আছে বিক্ষুব্ধ সময়ের ছাপ। 

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলীর প্রত্যক্ষ বিবরণ তিনি লিখে গিয়েছেন  নিজের আত্মজীবনী 'কালের ধুলোয়'। 'অদ্ভুত আঁধার এক' উপন্যাস দেশমাতৃকার মুক্তি ও বিপ্লবের সত্যিকারের আখ্যান। যেখানে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কবির নিজের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অভিজ্ঞতা উপলব্ধ হয়েছে। 

মজলুম আদিব বা বিপন্ন লেখক ছদ্মনামেও লিখতেন কবি শামসুর রাহমান। আমাদের প্রিয় কবি, দেশের প্রবাদপ্রতিম সাহিত্যিক নরসিংদীর পাড়াতলীর মাটির মানুষ। নিজের গ্রাম গভীর পরিপুষ্টতায় তাঁকে কাব্যিক উপলব্ধি দিয়েছে। প্রয়াণবার্ষিকীতে স্মরণ করি‌ শামসুর রাহমানের মহত্তম কবিকৃতি। কবির প্রতি এই গুণমুগ্ধের প্রাণান্ত শ্রদ্ধার্ঘ্য।

লেখক: সাংবাদিক
২ ভাদ্র ১৪৩০ | ১৭ আগস্ট ২০২৩
 

Comments

    Please login to post comment. Login