Posts

চিন্তা

চন্দ্রনাথ মন্দির উদাহরণ হোক সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির

August 18, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

149
View

সম্প্রতি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ মন্দিরের পাশে মসজিদ নির্মাণ হচ্ছে -এমন দাবিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে কয়েকটি পোস্ট ভাইরাল হয়। এর জেরে ব্যাপারটি সরেজমিনে পরিদর্শন শেষে একটি বিজ্ঞপ্তি সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করে সীতাকুন্ড উপজেলা প্রশাসন।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ ফখরুল ইসলামের নেতৃত্বে প্রশাসনের পক্ষ থেকে চন্দ্রনাথ মন্দির এলাকা পরিদর্শন করা হয়েছে এবং সেখানে মসজিদ নির্মাণের কোনো উদ্যোগের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সনাতন ধর্মাবলম্বী সকলকে আশ্বস্ত করা যাচ্ছে, চন্দ্রনাথ মন্দির এলাকায় মসজিদ নির্মাণের কোনো অনুমতি প্রশাসনের পক্ষ থেকে দেয়া হয়নি বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।

এতে আরো বলা হয়, সীতাকুণ্ড উপজেলা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এখানে সকল ধর্মের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করে আসছে। পবিত্র তীর্থস্থানটির প্রতি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, মূল্যবোধ, অনুভূতি ও আবেগকে সীতাকুণ্ডবাসী গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মান দিয়ে থাকে। তাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করতে পারে এমন কোনো কর্মকাণ্ডকে সীতাকুণ্ডবাসী কখনোই সমর্থন করে না।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সীতাকুণ্ডের চন্দ্রনাথ পাহাড়ে মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়ে করা একটি ফেসবুক পোস্ট আমাদের নজরে এসেছে। পোস্টটি নজরে আসার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে পর্যবেক্ষণ এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।

এতে বলা হয়, পোস্টটিতে দাবি করা হয়েছে যে, এ বিষয়ে আজ প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে। তবে এখন পর্যন্ত প্রশাসনের সঙ্গে এ বিষয়ে কেউ কোনো যোগাযোগ করেনি।

প্রশাসন এখানেই একটা মারপ্যাঁচ রেখে দিয়েছে। দাবি করা হচ্ছে, মসজিদ বিষয়ে তাদের কাছে এখনো কেউ লিখিত আকারে আনুষ্ঠানিকভাবে দাবি করেনি। যদি দাবি করে তাহলে সে ফয়সালা নিশ্চয়ই পরে হবে।

৩ কোটি হিন্দু এবং ১ কোটি অন্যান্য বাদ দিলে দেশে ১৪ কোটি মুসলিম আছে। এর অর্ধেক আবার নারী। বিপুলসংখ্যক শিশু ও বয়স্ক মানুষ আছেন যারা নিয়মিতভাবে মসজিদে গিয়ে প্রার্থনা করেন না। আবার অনেক মুসলিম আছেন যারা প্র্যাকটিসিং মুসলিম না। সবমিলিয়ে মস্কে গিয়ে নামাজি মানুষ হতে পারেন ৫ থেকে ৬ কোটি। এই ৫/৬ কোটি পুণ্যার্থীর জন্য দেশের ৬৪ জেলায় প্রায় সাড়ে তিন লাখ মসজিদ রয়েছে। এসব মসজিদে ইমাম-মুয়াজ্জিন আছেন প্রায় ১৭ লাখ। যাদের বেতন-ভাতা সমাজের সকল পেশার তুলনায় সর্বনিম্নে।

বাস্তবতা হলো এসব মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়ের সময় প্রায় কোনোটারই কাতার ভরে না। এমনকি বিগত সরকার রাষ্ট্রের টাকায় প্রতিটি উপজেলায় ৫৬০টি মডেল মসজিদ ও কালচারাল সেন্টার করে দিয়েছে -সেখানকার অবস্থাও একই। বছরের পর বছর লাখ টাকা বিদ্যুৎ বিল বকেয়া থাকে কিন্তু প্রার্থনার সময় কাতার পুরো হয় না। প্রায় সবখানেই পর্যাপ্ত মসজিদ আছে এর প্রমাণ হলো দিনে ৫ বার মাইকে প্রচারিত আযানের ধ্বনি কর্ণগোচর হওয়া। দেশের কোথাও গিয়ে আযানের ধ্বনি শোনা যায় না এমন জায়গা খুব কমই আছে।

তারপরও হিন্দুধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান চন্দ্রনাথ পাহাড়েই কেন মসজিদ লাগবে? এবারকার প্রার্থনালয় স্থাপন আলাপের আগে পাহাড়ের ওপরে গিয়ে গরুর বারবিকিউ খাওয়ার বয়ান শুনেছিলাম। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ যদি দেশের সংখ্যালঘু ভাইবোনদের সুরক্ষা না দিতে চায় তবেই কেবল এমনটা হতে পারে।

চন্দ্রনাথ পাহাড়ের ১২০০ ফুট উঁচু স্থানটির সাথে জড়িয়ে আছে হাজার বছর ধরে গড়ে ওঠা মিথ ও ধর্মীয় ঐতিহ্য। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চ মাসের দিকে শিব চতুর্দশীতে এখানকার মেলায় যোগ দেন দেশ-বিদেশের লাখো পর্যটক। এছাড়া সারাবছরই লেগে থাকে পুণ্যার্থীদের ভিড়।

চন্দ্রনাথ ধামকে ঘিরে প্রচলিত আছে সনাতন ধর্মীয় বেশকিছু ঘটনা। সনাতন ধর্মীয় মতে, সত্যযুগে পার্বী তথা সতী দেহ ত্যাগ করলে মহাদেব তার মৃতদেহ নিয়ে প্রলয় নৃত্য শুরু করে। এ সময় বিষ্ণু সতীর মৃতদেহ ছেদন করে। তার দেহখণ্ড বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে সেই জায়গাগুলো হয়ে ওঠে শক্তিপীঠ, সনাতন ধর্মীয় মানুষের তীর্থস্থান। চন্দ্রনাথ মন্দির তেমনই একটি জায়গা।

এমন একটি জায়গায় গবেষক ও পর্যটকসহ সব ধর্মের মানুষেরা যাবে এটাই স্বাভাবিক। সম্মানিত মৌলভিদের যেতেও বাধা নেই। কিন্তু আমার যদি নামাজ ছুটে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে তবে আমি এত সময় ব্যয় করে পাহাড়ের ১২০০ ফুট উপরে উঠব না।

কথা হলো, হাজার বছরের পুরনো হিন্দু তীর্থস্থানে এতদিন কোনো মুসলিম প্রার্থনালয়ের প্রয়োজন কেউ দেখল না -এখন কেন হঠাৎ করে এমন দাবি উত্থাপিত হচ্ছে? এর অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। তবে আমাদের কাছে তিনটি গুরুতর কারণকেই প্রণিধানযোগ্য মনে হয়। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিমরা এখন হয়ত সুপিরিয়র কমপ্লেক্সে ভুগছে, সবখানে প্রার্থনার সুযোগ সুবিধা পাওয়াটা তাদের একচ্ছত্র অধিকার মনে করছে এবং ভিন্নধর্মাবলম্বীদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতি একধরনের উন্নাসিকতা তৈরি হয়েছে। তবে সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রে যেহেতু সকল মানুষের অধিকার সমান, রাষ্ট্রযন্ত্র নিশ্চয়ই তদানুযায়ী সকলপক্ষের জন্য ইতিবাচক ও মঙ্গলজনক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

অপরদিকে আমরা বরাবর সর্বধর্মসমন্বয়ের পক্ষে। পৃথিবীর সকলধর্মের মানুষই মনে করেন সৃজনকর্তা একজনই। তাঁর কাছে জাতিগোত্রভেদ বলে কিছুই নাই। মহাপরাক্রমশালী তিনি সুনির্দিষ্ট কোনো জনগোষ্ঠীর প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট নন। কাজেই চন্দ্রনাথ মন্দিরের পূজারিরা তাদের শুভার্থী মুসলিম দর্শনার্থীদের জন্য যদি তাদের জন্য সুবিধাজনক কোনো স্থানে নিজেরাই একটি মুসলিম প্রার্থনালয় গড়ে দেন -সেটি হতে পারে ধর্মীয় সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি ও সৌন্দর্যের অনন্য উদাহরণ।

ধর্মের আবরণে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ঘুচে যাক। সকলপ্রকার ঘৃণা অপসৃত হোক। সর্বাবস্থায় জয়ী হোক মানবীয় প্রেম ও ভালোবাসা। সহজ মানুষ একজন আরেকজনের প্রতি সহমর্মি হোক। এক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের দায়দায়িত্ব ও কর্তব্য সবার আগে।

লেখক: সাংবাদিক 
১৮ আগস্ট ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login