প্রাণসায়র
আহমেদ সাব্বির
খাল কাটলে কুমির আসে! কুমির এলেই খাল খতরনক হয়ে ওঠে। একালের খালে কুমির সত্যিই আসে কি? হয়তো অনেক আগে আসত। নদী সাঁতরিয়ে পেটমোটা কুমির সরু খালে সুড়ুৎ করে ঢুকে পড়ত। আতঙ্কে মানুষ জমে যেত। খালে নামা তো দূরের কথা একটা ইটের টুকরোও ফেলতে সাহস পেত না। খালের দুই প্রান্তে গাজিয়ে ওঠা ঝোঁপ-জঙ্গেলের আড়ালে লুকিয়ে মুখ হাঁ-করা ক্ষুধার্ত কুমির দেখত সবাই। কুমির খরস্রোতা খালের তলদেশ থেকে ভুঁস করে ভেসে উঠত। চোখ ঘুরিয়ে চারপাশ দেখে নিয়ে আবার ডুবে যেত। কুমির-কামট-শুঁশুক পাহারায় খাল সদর্পে টিকে থাকত। প্রাণি যেভাবে ফুসফুস ভরে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়, খালও তেমনি বুক ফুলিয়ে জোয়ার-ভাটায় বেঁচে থাকত।
খালের সঙ্গে কুমিরের গল্পটা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। এই যুগে সেই নদীর কুমির না এলেও টাকার কুমির এখনো আসে। তাদেরকে দাওয়াত দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। এমনিই চলে আসে। কারণ ডাঙার কুমির চিরকাল খল স্বভাবের। স্বজাতিকে দখলের খেলা দেখাতে তৎপর। আগেকার দিনে কুমির এলে মানুষেরা ঢেঁড়া পেটাত। হইহল্লা করে সচেতন করত। এখন সেটা উল্টো। কুমিরই এখন ঢেঁড়া পেটায়, দখল করে। কেউ যাতে খালের ত্রি-সীমানায় না আসতে পারে যেজন্য পাহারা বসায়।

খালের সঙ্গে কুমিরের যে সম্পর্ক তা জানতেন বিখ্যাত জমিদার প্রাণনাথ রায় চৌধুরী। দুর্গম সুন্দরবনঘেরা সাতক্ষীরা অঞ্চলের খোলনলচে পাল্টে দিতে তিনি ১৮৬৫ সালে একটি খাল খনন করেন। নিজের নামে নাম দেন প্রাণসায়র। অর্থাৎ প্রাণের সরোবর। প্রায় ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রাণসায়র খননকালে ২০০ফুট প্রশস্ত ছিল। কুমির সভ্যতার কারণে একটা শুন্য কমে গেয়ে এখন সেটা প্রায় ২০ফুটেরও কম। প্রাণসায়র খনন করে প্রাণনাথ বাবু এল্লারচরের মরিচ্চাপ নদীকে সাতক্ষীরার পৌরসভা ভেদ করে উত্তরের নৌখালি খালের সঙ্গে মিলিত করেন । বাবুর কল্যানে প্রাণসায়র হয়ে ওঠে শিল্প-বানিজ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার অন্যতম মাধ্যম।
সেই যুগে যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রধানতম মাধ্যম ছিল নৌপথ। মায়ের কাছে শুনেছি কালিগঞ্জ থেকে সাতক্ষীরায় আসতে হত নৌকায়। সকালবেলা কাঁকশিয়ালি নদীর নাজিমগঞ্জ ঘাট থেকে নৌকা ছাড়ত। প্রাণসায়রের নৌঘাটায় পৌছাতে দুপুর গড়িয়ে যেত। দীর্ঘ নৌযাত্রায় কোন ক্লান্তি ছিল না। শব্দ দূষণ, বাতাস দূষণ ছিল না। নৌকার ছইয়ের নিচে মাদুর পেতে বিশ্রাম নেওয়া যেত। খালের দুই পাড়ের জনজীবন অপরূপ গাছপালা আর মাছ ধরার দৃশ্য দেখে মন ভরে যেত। আজকের দিনে সাতক্ষীরার যে জাঁকজেল্লা , অর্থনৈতিক দাপট, সামাজিক প্রতাপ তার উৎসমুখ প্রাণসায়র। খুলনা-যশোর কিংবা আশাশুনি-শ্যমনগর সকল প্রান্তের নেটওয়ার্ক ছিল আজকের এই খাল।
নব্বইয়ের দশকেও প্রাণসায়রের বুকে প্রাণ ছিল। জোয়ার-ভাটা খেলত। গোলপাতা বোঝাই পোটকাটা নৌকা, খেয়া চলাচল করত। প্রাণসায়রে উপর তিনটি পুল ছিল। একটা লোহার পুল যেটা আজকের পাকাপুল, কেষ্টময়রার হোটেল সংলগ্ন আর বড় বাজারের উপর দিয়ে ছিল কাঠের পুল। আমরা বলতাম কেঠোপুল। সেই কেঠোপুল এতটাই উঁচু ছিল যে আব্বার হাত ধরে উঠতে হত্। হাঁটলে নড়বড় করত। রোমাঞ্চকর আনন্দ নিয়ে আমরা পুল পার হয়ে স্কুলে যেতাম। কখনো কখনো কাঠের পুলের উপর দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। দেখতাম টলটলে খালের স্রোত রোদের ঝিলিক আর বুনো শ্যাওলার চাঁক নিয়ে ভেসে চলেছে। একটু দূরে ছিপ নিয়ে বসে আছে কেউ ছাতি মাথায়। জেলেরা মাছ ধরছে। খালের দুই প্রান্তে গোলপাতার ঘরবসতি। গরানকাঠের বেড়া। রান্নাঘর থেকে ধোঁয়া উড়ছে। খালের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে মাছরাঙা-বক। চিকন ঠোঁটে তার ছটফট করছে চকচকে সরপুঁটি।
ভাদ্র মাসে সাতক্ষীরায় গুড়পুকুরের মেলা বসে। সে সময় মেলা হতো গোটা শহরজুড়ে। পৌরসভার সীমা ছাড়িয়ে ইউনিয়নেও ছুঁয়ে যেত মেলার পরিসর। গুড়পুকুরের মেলার সঙ্গে প্রাণসায়রের সম্পর্ক ছিল প্রাণের। সে সময় মেলার খাট-পালঙ থেকে শুরু করে গুড়-বাতাসা-দা-খুন্তি প্রায় সবই আসত নৌকায়। প্রাণসায়রে খেয়া-ডিঙি-পেটকাটা নৌকার জট বেঁধে যেত মেলার সময়। ১৯৭১সালে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ও প্রাণসায়র মুক্তিবাহিনী-শরনার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে, প্রাণ বাঁচিয়েছে নানাভাবে। যুদ্ধের সময় নৌপথে চব্বিশ পরগনার টাকি থেকে ইছামতি পার হয়ে সোজা প্রাণসায়রে যাতায়াত করা যেত নিরাপদে। মুক্তিবাহিনীর নির্বিঘ্ন যাতায়াত ছিল প্রাণসায়রের উপর দিয়ে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দুর্গাপূজার সময় ইছামতি-টাকির মোহনায় দুই দেশের মানুষের মিলনমেলা বসত। নৌকায় করে শত শত প্রতীমা আনা হতো বিসর্জনের উদ্দেশ্যে। প্রাণসায়রও সেদিন বাঙালির আত্মীয়তায় রঙিন হয়ে উঠত। প্রাণসায়র-ইছামতি-টাকির এই সম্প্রীতি বহুবছর ধরে টিকে ছিল। সমীন্তবর্তী উত্তেজনার কারণে মিলনমেলার সেই উৎসব এখন বন্ধ।
যে প্রাণসায়র সাতক্ষীরাবাসীর জীবন-জীবীকা, ব্যবসা-বানিজ্য ও নৌ-যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম ছিল সেটা এখন রূপকথার মতো শোনায়। আজকের প্রজন্ম প্রাণ সায়র বলতে নোংরা আবর্জনা বোঝাই দুষিত রুগ্ন খাললেই চিনবে। যেটার দুই পাশদিয়ে অসংখ্য দোকানপাট, কলকারখানা, বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে। খালের দুই প্রান্তের সবুজ পল্লব এখন আর চোখে পড়ে না। যা চোখে পড়ে তা হলো আবর্জনার স্তুপ আর শহরের নর্দমার কালো ধারা। খালে এখন স্রোত নেই। শহরের বাইরে বাঁধ দিয়ে মাছের ঘের করায় জোয়ার-ভাটা হয় না। টেংরা, বোয়ালের খলবলানিও থেমে গেছে। বক সারসের ঝাঁকও ভিড় জমায় না ভাটির চরে। এখনকার প্রাণসায়র নর্দমা সাদৃশ্য। খালের পাশের টং দোকানে দাঁড়িয়ে এক কাপ চা খাওয়া দূরের কথা, মল-মূত্রের দুর্গন্ধে দাঁড়ানো যায় না। প্রাণ সায়রে বাতাসও এখন প্রাণহরণকারী।
প্রাণনাথের প্রাণসায়র আজও ধিক ধক করে টিকে আছে। যুগে যুগে কত দখলবাজ কুমির যে প্রাণসায়রের গলা টিপে ধরেছে তার হিসাব নেই। খাল দখল করে মৎস ঘের করেছে। কৃষি খামার, বাস্তুভিটা করেছে। আইল ঠেলাঠেলিতেও খালের দশা বেহাল হয়েছে। শোষণে দূষণে ধিরে ধিরে প্রাণসায়র খাল হয়ে উঠেছে শৌচকর্মের নিরাপদ অঞ্চল। গত দুই যুগে দুই একবার খালখনন করা হলেও তার সুফল তেমন আসেনি। খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি হয়ে গেছে। খাল খনন ও রক্ষাবেক্ষণের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেখা গেছে সাতক্ষীরাবাসীকে। সভা-সেমিনর- মানবন্ধন করেও খালের প্রকৃত সীমানা রক্ষা করা যায়নি।
প্রাণসায়রের খাল খনন নিয়ে রাজনীতি, দুর্নীতি ও দখলনীতি যখন তুঙ্গে তখন একটু আশার সঞ্চার হলো। মরিচ্চাপ, বেতনা ও প্রাণসায়রের কিছুটা খণনের ফলে ইদানিং জোয়ার-ভাটা দেখা যাচ্ছে। যা অনেকটা রূপকথার মতো। খালের দুই প্রান্তে বৃক্ষরোপন করা হয়েছে। নানা পন্থায় সতর্কবানী প্রচার করা হচ্ছে খালের যেন কেউ ময়লা-আবর্জনা না ফেলে। শহরবাসীর এই সচেতনতা প্রমাণ করে প্রাণসায়রকে রক্ষা করা কতটা জরুরী। নানামুখী দখল থেকে প্রাণসায়র কে রক্ষা করতে হলে আত্মসচেতনতা ও মূল্যবোধ জাগ্রত করা প্রয়োজন। আমাদের বুঝতে হবে প্রকৃতি প্রেমের কাঙাল। তাকে ভালবাসতে হয়। সযত্নে লালন করতে হয়। সে সভ্যতার নামে নিষ্ঠুরতা খুব বেশি দিন সহ্য করে না।
খালে আগের মতো গোলপতা-গরান বোঝাই নৌকা না এলেও বর্ষার মৌসুমে সৌখিন জেলেদের মাছধরার দৃশ্য চোখে পড়ে। শৈশব স্মৃতি ফিরিয়ে আনতে অনেকেই ছিপ-বড়শি নিয়ে বসে যান। শহরের পরিবেশপ্রেমিরা যখন সগৌরবে প্রাণসায়রের ছবি-ভিডিও ফেসবুকে পোস্ট করেন তখন বড় আনন্দ হয়। মনে হয়ে সপ্তাশ্চর্যের মতো, সবেধন নীলমণির অপরূপ আমাদের প্রাণসায়র।