Posts

গল্প

রঙিন চশমা (জমিনের দিন)

August 22, 2025

Towhid Tarek

Original Author তৌহিদ তারেক

48
View

অরুনার এক্স বয়ফ্রেন্ড রোহান।কলেজের দিনগুলিতে তাদের নিয়ে গোটা কলেজ মেতে থাকত।সবচেয়ে ব্রিলিয়ান্ট ছাত্রী অরুনাকেই ধরা হত।রোহান প্রথম পরীক্ষার রেজাল্টের পর তাক লাগিয়ে দেয়।স্যাররা পর্যন্ত অবাক হয়ে যান।অরুনা-রোহানের মার্কটাও কাছাকাছি থাকত।তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক কেউ প্রমাণিত করতে পারেনি তবে রোহানের বন্ধুরা অরুনাকে প্রপোজের জন্য রোহানকে অনেক রিকোয়েস্ট করে।অরুনার ক্ষেত্রেও একইভাবে বান্ধবীরা বলত তোর হয়ে আমরা কিছু বলব?
ফ্রাস্ট ইয়ারের পর অরুনা হিজাব পড়া শুরু করে।বান্ধবীরা অত্যন্ত বিস্মিত হয়।তার কাছের বান্ধবীরা জিজ্ঞেস করে,“কি গো ড্রিম গার্ল তুমি দেখি পর্দা শুরু করলে?ব্যাপারকি বিয়ের কথাবার্তা চলছে নাকি”?অরুনা আগের চেয়ে আরও বেশি আন্তরিক হয়ে গেছে।আরও বেশি কোমল স্বরে কথা বলে,“পর্দা শুধু বিয়ের জন্য না পর্দা জীবনের জন্য,মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়েছি পর্দা তো আবশ্যিক লাগবেই”।তার এই পরিবর্তনে বন্ধুরা বেশ আপসেট হয়ে পড়ে।অরুনা ছিল সবচেয়ে স্মার্ট মেয়ে।পড়ালেখার পাশাপাশি রুপচর্চায় ছিল সেরা।তার হাসি,তার কথা বলার ধরণ বিমোহিত করত।তার সাথে কথা বললে মন ভালো হয়ে যেত।
ভার্সিটি শেষ করে জব করছি।অফিস-বাসাতেই জীবন সীমাবদ্ধ।হঠাৎ একদিন মিসবাহউলের সাথে দেখা।আমাদের আরেক বান্ধবীর সাথে তার বিয়ে হয়েছিল।কথার ফাঁকে জানালো অরুনাকে দেখতে গিয়েছিল।তার স্ত্রী এখনো অরুনার খবর নেয় রোজ।আমি বললাম,অরুনা কোন অরুনা?সে বিস্মিত হল।যেই অরুনার প্রেমে আমরা সবাই পাগল ছিলাম  মরিয়ম বেগম অরুনা।আমি হাসলাম,অহ।আচ্ছা অরুনার কি হয়েছে?মিসবাহউল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,জানিস না?আমি নাসূচক মাথা নাঁড়লাম।বলল,দু বছর হয় প্যারালাইজড হয়ে পড়ে আছে।একটা বাচ্ছা আছে,বাচ্ছাকে নিয়ে বাবার বাড়ি থাকে।অরুনার বাবার বাড়ি কলেজের পাশেই।আমরা লিঁচু খাওয়ার জন্য টিফিন টাইমে যেতাম।অরুনার বাবাকে দেখে শরম পেয়ে সালাম দিয়ে চলে আসতে চাইতাম।তিনি ডেকে বলতেন,আরে এসেছো যখন খাও।ভেতরে ও পাশে আরও দুটো গাছ আছে,এই বাইরের দুটোর লিঁচু বাচ্ছারাই খায়।মানা করি না।
আমি,মিসবাহউল আর স্ত্রীসহ পরবর্তী শুক্রবার  অরুনার বাড়িতে গেলাম।অরুনার বাবা বার্ধক্যে পড়েছেন।আগেকার হাসি,মিষ্ট ব্যবহার আছে।দেখলে মনে হয় কতদিনের আপন।
মিসবাহউল আমার পরিচয় দিল।একটু পরপর আসমানের তারার মতো জ্বলজ্বল একটা তিন বছরের ছেলে উঁকি মেরে দেখল,এক হাত দরজায়।পরক্ষণে “নানু” বলে এক দৌড়ে অরুনার বাবার কোলে চলে আসল।ধরে নিলাম এটাই অরুনার ছেলে।মনে মনে বললাম,এই ছেলে নিশ্চয় আল্লাহর ওলী হবে।
কিছুক্ষণ পর আমাদের ডাকল মিসবাহউলের স্ত্রী।এত তাড়াতাড়ি চা এল কোত্থেকে?অরুনার মা ঘন ঘন চা খান।বুয়া চা করছিল।আমাদের দেখে আমাদের জন্যও নিয়ে এসেছে।পাশের রুমে অরুনা ছেলেকে বলছে,“পাশে বসো,দুটি বিস্কুট শেষ করো”।
আমরা অরুনার রুমে গেলাম।সে হিজাব পরিহিত।আমি তার চোখের দিকে তাকালাম।পরক্ষণেই সরিয়ে নিলাম।যে তার চেহারা ঢেকেছে পুরুষের দৃষ্টি থেকে বাঁচতে তার চোখ দেখে মজা নেয়ার মতো ঘৃণ্য জিনিস পৃথিবীতে খুব কম আছে।যদিও আমি মজা নেয়ার জন্য তাকিয়েছিলান না।সেই অরুনা এই অরুনার পার্থক্য ধরতে চাচ্ছিলাম।এখনও অরুনা পর্দা করে,এখনো সে সামান্য কর্কশ ভাষায় কথা বলে..আমি বেশ চমকে গেলাম।আমার মনের ভাষাগুলি মিসবাহউলের স্ত্রী বলছিল আর অরুনার চোখ ক্রমেই ভিঁজে উঠল।
“তোর যখন পর্দা করার কথা তখন করেছিস বোন,তুই যখন সবচেয়ে দামি ছিলে শত শত ছেলে তোর উপর ক্রাশ খেত তুই তখন পর্দা করেছিস,যখন মাথা নষ্টের বয়স তুই তখন নিজেকে হেফাজত করেছিস,বোন তুই আমার শুধু সেরা বান্ধবী,আমি তোর ফ্যান”
আসলেই তো এই অরুনা জীবনে অনেক কিছু অর্জন করে ফেলেছে।সাতাশ বছরের জীবন।পঁচিশে রোগে পড়েছে তার আগেই তার আসল পরীক্ষা ছিল।সে শুধু পড়ালেখায় ভালো করেনি।ফ্রাস্ট ক্লাস ফ্রাস্ট আরও কিছু অলিখিত সনদ তার আছে।অরুনা বলছিল,“চাকরি করবে কি না এটা নিয়ে খুব পেরেশানিতে ছিলাম।বান্ধবীরা অনেকেই বিভিন্ন চাকরি করছে।ভাবলাম পর্দা মেনে করি না কেন?কিন্তু আবার এটাও মনে হল আমার তো টানাপোড়েন নেই।স্বামী আছেন,স্বামী রোজগার করেন কর্মক্ষম,বাবার সম্পদ আছে।কিন্তু এই আবার মনে হয় নিজে এত পড়ালেখা করলাম কেন?আবার অনেকেই তো চাকরি করতে গিয়ে বেপর্দা হয়ে যায়।এইসব দোলাচলের মধ্যে প্যারালাইজড হয়ে গেলাম।আল্লাহর শুকরিয়া।আমাকে রোগের মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্তের ব্যাপারে সবযোগিতা করেছেন।আমি এখন আখেরাতের কল্যাণের পথে আছি এই আশা নিয়ে জীবন পাঁড় করে দেব”।
আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম।মানুষের সামনে কথা বলা যায় কিন্তু অতিমানবী তাদের সামনে কিভাবে কথা বলি।তারা আমাদের চিন্তা চেতনার বাহিরে চিন্তা করেন।আমাদের দৃষ্টি আর তাদের দৃষ্টিতে বড়ই তফাত।
আমার বড্ড জানতে ইচ্ছে হল অরুনার স্বামী কোথায় থাকে?সে এখানে কেন?স্বামী কি তাকে ফেলে গেছে?সেটার উত্তর পেলাম একটা কল আসার পর।অরুনা নিজেই জানাল,“বিয়ের যতই আলাপ আসত তারা প্রথমেই জাহির করতে চায় জামাই টাকাওয়ালা।আমি খালাকে এনে বললাম,খালা আমি দ্বীনদার ছেলে চাই।আমার খালাও দ্বীনদার মহিলা ছিলেন।পাত্র অনেক দেখা হল কিন্তু হুজুর টাইপ কাউকে পাওয়া গেল না।শেষমেশ মাদ্রাসা পড়ুয়া একজনকে পাওয়া গেল।ইউসুফের বাবা বিয়ের প্রস্তাবে নাকি কেঁদে দিয়েছিল।তিনি আমাদের এক আত্মীয় লাগেন।মসজিদে ইমামতি করেন।এলাকায় খুবই সুনাম,মুসল্লিদের কাছেও একই খবর পাওয়া গেল।প্রতি বৃহস্পতিবার আসেন।এসেই বলেন,বাড়ি নিয়ে যাবেন।কিন্তু বাবা-মার কথার পর আর তার কথা নেই।বড়ই আমলগার মানুষ।আমার শ্বশুর,শ্বাশুড়ি বেঁচে নেই।তাই বাবা-মা এখানেই থাকার জন্য বলেন।ইউসুফের বাবা বলেন স্ত্রীর অসুখ তার জন্য একটা পরীক্ষা।জীবন থাকতে তিনি কখনো আমাকে পরিত্যাগ করবেন না।আমি বলেছিলাম আরেকটা বিয়ে করার জন্য।মাসনাহতে আমি কখনো অরাজি ছিলাম না।ইউসুফের বাবা বলেন,তিনি তার রবের সাথে ওয়াদাবদ্ধ তিনি মরিয়ম পরীক্ষায় পাশ করতে চান।মাসনাহ তার প্রয়োজন নেই।তিনি আমাকে যতটুকু ভালোবাসেন দ্বিতীয় বউকে তেমনটা ভালোবাসতে নাকি পারবেন না”।
আমরা দুপুরের খাবার খেয়ে উঠে পড়লাম।আমার চশমার কাঁচে ধুলো।সেটা পরিষ্কার করলাম।চশমাটা পুরনো হয়ে গেছে।ফ্রেমটা দেখতে ভালো লাগছে না।চশমাটা পাল্টানো দরকার,খুব তাড়াতাড়ি দরকার।

Comments

    Please login to post comment. Login