"চল,পদ্মা দেখে আসি",এই কথাটা ফেলা যায় না।রতন তার গার্লফ্রেন্ডকে কল দিয়েছে সেও যেন আসে।আমি মুসাকে বললাম,রতন কি আমাদের সাথে যাবে?মুসা অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছেলে।সে বলল,হিন্দু হিসেবে বুঝেনি,আমি তাকে বলে দেবো যাতে সে একা যায়।মুসা এক ফ্লাস্ক চা সাথে নিল,সাথে মুড়ি।
আমরা পদ্মার পাঁড়ে বসলাম।রতনের একটু মন খারাপ।মুসা তাকে বলল,অতিথির এত দূর থেকে এসেছেন,তুই মুখখানা একটু হাসিখুশি রাখ।রতন হেসে দিল।
একজন লোক পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন।তিনি বললেন,ভাতিজারা ঐদিকে যেও না গতকাল জয়নুল মুন্সি এখানেই পড়েছিলেন,অল্পের জন্য রক্ষা।আমি মুসার কাছে জানতে পারলাম এতদ এলাকায় জয়নুল মুন্সি একনামে পরিচিত লোক।একচল্লিশ বছর ধরে তিনি নামাজ ক্বাজা করেননি।আমি প্রথমে হালকাভাবে নিলেও মূহুর্তেই মনে হল এটা কি সম্ভব।লোকটার কি অসুখ বিসুখ হয়নি।মুসা চা ঢালতে ঢালতে বলল,চল কাল একবার লোকটাকে দেখে আসি।
আমরা বসে আছি জয়নুল মুন্সির দহলিজে।আমি মনে করেছিলাম মুন্সি হয়তো সংসারবিমুখ মানুষ।কিন্তু গিয়ে জানলাম দারুণ সংসারী মানুষ।ছোট মেয়েকে মাদ্রাসা থেকে আনতে গেছেন।এরই মধ্যে দুজন লোক পানি পড়া নিতে এসেছে।
জয়নুল মুন্সি বাইসাইকেলের বেল দুবার বাঁজালেন এবং দহলিজের সামনে এসে থামলেন।আমরা সালাম দেয়ার আগেই তিনি অত্যন্ত অমায়িক স্বরে সালাম দিলেন।বাইসাইকেল রেখে মেয়েকে কোলে নিয়ে বললেন,আমি আসছি,আপনারা বসুন।আসার সময় ছেলেকে সাথে নিয়ে আসলেন।যে আধঘন্টা পূর্বে আমাদের চা এনে দিয়েছিল।বললেন,ছেলেটা হাফেজ হয়েছে এবার মাদ্রসায় ভর্তি করাবো আপনারা তার জন্য দোয়া করবেন।ছেলেকে পান সুপারি আনতে পাঠিয়ে দিলেন।এরই ফাঁকে গভীর মনোযোগে মনে মনে পড়ে পানির বোতলের ঢিপা খোলে ফুঁ দিলেন।পানিপড়ার জন্য সামান্য হাদিয়া দিল একজন।অন্যজন দিল শিমবীজ।বলল,মুন্সি আজ পয়সা হাতে নাই।মুন্সি মুঁচকি হাসি দিয়ে বললেন,ভাই পান খান।
লোকেরা চলে গেলে আমি মুন্সির ছেলেকে পাশে বসালাম।মুসা মুন্সিকে বলল,এই লোক সিলেটি।এসেছিল পদ্মা দেখতে।শুনল আপনার কথা,নিয়ে এলাম।আচ্ছা আপনার গতকালকের ঘটনা কি?মুন্সি বললেন,নদীর কিনারায় দাঁড়িয়ে ছিলাম।অসতর্ক থাকায় হঠাৎ পড়ে গিয়েছিলাম।পাশে লোক ছিল তারা হইচই করেছে।মুসা আমাকে বলল,মুন্সি হুজুরের সাথে কথা বল।কিছু জিজ্ঞেস করার থাকলে কর।
-দহলিজ তো আজকাল দেখা যায় না আপনার এখানে দেখে ভালো লাগছে।
-এটা খুবই প্রয়োজনীয়।আমার স্ত্রী এলাকায় আরও কয়েকটা দহলিজের ব্যবস্থা করেছেন।
-আপনার স্ত্রী?
-জ্বি,তিনি তার বাবার সম্পত্তির একাংশ লোকদের দহলিজ নির্মাণে ব্যয় করেছেন কিংবা বলা যায় উৎসাহিত করেছেন,সামান্য সহযোগিতার মাধ্যমে।
-মাশা আল্লাহ।আচ্ছা হুজুর,আপনি একচল্লিশ বছর ধরে টানা নামাজ পড়েন?
-জ্বি আলহামদুলিল্লাহ।
-মাঝে মাঝে দু এক ওয়াক্ত ছুটে নি?
-ছুটেনি আলহামদুলিল্লাহ।
-রোগ ব্যাধি?
-একবার গাছ থেকে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়েছিলাম জ্ঞান ফিরতে দেখি আসরের ওয়াক্ত।নামাজ পড়ে নেই পরক্ষণেই।কোমরে ব্যাথা থাকায় বসে বসে প্রায় এক সপ্তাহ নামাজ পড়তে হয়েছে।
-আর?
-আরেকবার হাই প্রেশারে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম।অবশ্য জোহরের ওয়াক্তের ভেতরেই ঠিক হয়ে গিয়েছিলাম।
-ফজর ক্বাজা হয়নি?
-আমি তাহাজ্জুদ পড়ে আর ঘুমাইনা?
-বলেন কি?তাহাজ্জুদ কতদিন ধরে পড়েন?
-একদিন কম একচল্লিশ বছর হবে।
-সুবহান আল্লাহ।এটাও কি সম্ভব?
-মাঝে কয়েকবার প্রচন্ড অসুখ হয়েছিল।কিন্তু হুঁশ ছিল।পেটের পীঁড়ায় বিছানায় গড়াগড়ি করেছি কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ আজান হলে আমার আর অন্য খেয়াল থাকে না।নামাজের জন্য আমি কখনো অজুহাত করিনা আর আমার মায়ের দোয়া ভাই।
-আপনার মা দোয়া করেছিলেন?
-জ্বি।আমার মা ছিলেন বড়ই অসহায়।বাবা তাকে তালাক দিলেন।পরে আবার তাকে সংসারে ফিরিয়ে নিতে চাইলেন।আমার মামারা মাকে ফিরে যেতে বলল।কিন্তু আমার মা ফিরে গেলেন না।তালাকপ্রাপ্তা হয়ে গেলে ফিরে যাবে কেমনে?তিন ইদ্যতের পর অন্য পুরুষের সাথে বিয়ে হওয়া লাগবে।তারপর আবার ঐ পুরুষ স্বইচ্ছায় তালাক দিতে হবে।এরপর আরও তিন ইদ্যত পর পুরনো স্বামীর সাথে নতুন করে বিবাহ করতে হয়।মা যখন এসব বলল আমার মামারা মাকে বাড়ি থেকে বের করে দিল।তখন আমার বয়স তিন।আমার মা পলিথিনের তাঁবুতে থাকতেন।শেঁয়ালের ডাকে আমি নাকি ভয়ে কাঁদতাম।আমার মা নাকি "আল্লাহ আল্লাহ" জিকির করতেন।আর বলতেন,"আল্লাহ,শেয়ালের ভয়ে সে এখন কাঁদছে তোমার ভয়ে যেন সারা জীবন কাঁদে"।
-আপনার মা আপনাকে নিয়ে তাঁবুতে কতদিন ছিলেন?
-সাত বছর।
-আপনার মামারা কি নিতে আসেনি?
-এসেছিল,মা যাননি।
-আপনার নানা,নানি বেঁচেছিলেন তখন?
-না।তারা মায়ের বিয়ের আগেই মারা গিয়েছিলেন।
-আপনার মা সাত বছর পর কি মারা যান?
-হ্যা।
-তারপর আপনি?
-মা বলে যান,আমি যেন তাঁবুতেই থাকি।রোজগার করে যদি জায়গা জমি কিনে ঘর তুলতে পারি তবে যেন তাঁবু ছাড়ি ।আমি এই জায়গাটা পড়ে কিনেছিলাম।
-তাঁবুতে একা থাকতেন?
-মামাতো ভাই ছিল কয়েকজন।তারা একেক রাত একেকজন আসত।আর ততদিনে কাছেই আরও ঘর উঠে।
-আপনি নামাজ শুরু করেছিলেন কবে?
-পনেরো বছর থেকে।সেই প্রথম রমজান থেকে শুরু।
-আমাদের জন্য একটু দোয়া করবেন।
-অবশ্যই,আপনারাও করবেন।
-আপনার মতো আল্লাহর নেককার বান্দার সাথে দেখা হয়ে খুব ভালো লাগল।আপনার সোহবতে আরেকদিন আসব ইন শা আল্লাহ।
-ইন শা আল্লাহ। তবে ভাই এসব নামাজ কোন উপকারে আসবে না যদি নিয়্যত সহী না হয়।আমি খুব টেনশনে আছি "রিয়া" নিয়ে।লোকেরা ইদানীং এটা নিয়ে বাড়াবাড়ি করছে।নামাজ এটা একটা ডিউটি।চল্লিশ,পঞ্চাশ এটা কোন হিসাবের বিষয়?প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্তে আযান হবে নামাজ পড়ব এটা তো নরমাল বিষয়।লোকেরা নামাজ পড়ে না দেখেই এত মাতামাতি।আল্লাহ ডিউটি দিয়েছেন,ডিউটি পালন করব শেষ।তারা মাতামাতি করে আমার সামান্য অহংকার বৃদ্ধি পেলে সব যাবে।আপনি আমার জন্য দোয়া করবেন ভাই।মুসাফির মানুষ,খাস একটু দোয়া চাই।আজকে দুপুরে এখানে খাবার খাবেন ইন শা আল্লাহ।
আমরা খাবার খেলাম।এত সাধারণ খাবার এত স্বাদে আমি কোনদিন খাইনি।আলু ভর্তা,ডিমবাজি সাথে ডাল।মুসা একটি বোতলে পানি পড়া নিয়ে নিল।আমরা আসার সময় মুসা বলল ঐ দেখ,পদ্মা দেখা যায়।আমি বললাম,এতক্ষণ পদ্মার সাথেই তো আলাপ করছিলাম।মুসা হ্যা সূচক মুঁচকি হাসল।
59
View