অধ্যায় ১ — সেই শৈশবের দিনগুলো
আমি, আরিফ আহমেদ।
কখনো ভাবিনি জীবনটা হবে একটুকর রঙিন স্বপ্নের মতো। শৈশবের সেই দিনগুলো আজও চোখ বন্ধ করলে স্পষ্ট ভেসে ওঠে।
আমাদের গ্রামটা ছিল নদীর ধারে। বর্ষাকালে নদী ফুলে-ফেঁপে উঠত, আর আমি বন্ধুদের নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তাম শীতল জলে। সূর্যের আলোয় জলকণার ঝিলিক যেন আমাদের হাসির মতো ছড়িয়ে পড়ত চারপাশে। বিকেলে ঘুড়ি ওড়ানোর সময় বাতাসে মিশে যেত আমাদের চিৎকার, আর সন্ধ্যা নামলে বাবার কাঁধে চেপে গ্রামের বাজারে যাওয়াটাই ছিল আমার সবচেয়ে বড় আনন্দ।
মা ছিলেন আমার পৃথিবীর কেন্দ্র। তাঁর হাতে মাখা খাবারের স্বাদ আজও জিভে লেগে আছে। স্কুল থেকে ফিরে তাঁর আঁচল ধরে বসে গল্প শোনার যে অভ্যাস ছিল, তা ছাড়া দিন যেন সম্পূর্ণ হতো না। তখন ভাবতেই পারিনি—এই সুখ, এই উষ্ণতা কোনো একদিন ফুরিয়ে যাবে।
অধ্যায় ২ — শহরের আলোর মায়া
সময়ের স্রোতে সব বদলে গেল। বাবার ব্যবসা বড় হলো, আমরা গ্রাম ছেড়ে চলে এলাম শহরে।
আকাশছোঁয়া দালান, ব্যস্ত রাস্তাঘাট আর নতুন বন্ধু—সবকিছুই যেন আমাকে এক নতুন জগতে নিয়ে গেল। শৈশবের মাটির গন্ধ ধীরে ধীরে হারিয়ে গেল, তার জায়গা নিল শহরের আলোর ঝলকানি। আমি পড়াশোনায় ভালো ছিলাম, আর বাবার স্বপ্ন ছিল আমাকে বড় কিছু করা। আমি নিজেও বিশ্বাস করতাম—আমার সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে।
কিন্তু জীবন কখনোই শুধু স্বপ্নের পথ মেনে চলে না।
অধ্যায় ৩ — সবকিছুর শেষ
সেদিনের কথা মনে হলেই বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। এক ভয়ংকর সড়ক দুর্ঘটনা মুহূর্তেই আমার পৃথিবীকে ছিন্নভিন্ন করে দিল।
হাসপাতালের সাদা দেয়াল, রক্তমাখা স্ট্রেচার, কানে ভেসে আসা মানুষের কান্না—আমি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
মায়ের নিথর মুখ আর বাবার ঠান্ডা হাত ধরে বুঝতে পারলাম, আমি একা হয়ে গেছি। তখন আমার বয়স মাত্র আঠারো।
কিন্তু দুঃখের চেয়েও নির্মম ছিল লোভী আত্মীয়দের আসল চেহারা।
বাবার সম্পত্তি নিতে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল। আদালতের দৌড়ঝাঁপ, ভুয়া কাগজপত্র, তিক্ত কথা—সব মিলিয়ে আমি যেন অসহায় হয়ে পড়লাম। শেষ পর্যন্ত আমি হারালাম সবকিছু।
রাজপুত্র থেকে আমি হয়ে গেলাম নিঃস্ব ভিখারি।
অধ্যায় ৪ — ফুটপাতের রাতগুলো
শহরের যেই রাস্তায় একসময় গাড়িতে চড়ে ঘুরেছি, সেখানেই ফুটপাথে রাত কাটাতে হলো।
কোনো কম্বল ছিল না, কেবল আকাশের চাঁদ-তারা আমার সঙ্গী। ক্ষুধা এমনভাবে ছিঁড়ে খেত ভেতরটা, যে ভিক্ষা চাইতেও লজ্জা লাগত না।
মানুষ পাশ দিয়ে যেত—কেউ করুণা করত, কেউ ঘৃণা করত, বেশিরভাগই দেখেও না দেখার ভান করত।
একদিন আয়নায় নিজের মুখ দেখে আমি আঁতকে উঠেছিলাম—অগোছালো চুল, শীর্ণ দেহ আর চোখে নিস্তেজতা। এ কি আমি?
অধ্যায় ৫ — নতুন ভোর
এক ভোরে আমি বসেছিলাম এক পুরনো কারখানার সামনে। ঠান্ডায় কাঁপতে থাকা আমাকে দেখে কারখানার মালিক এগিয়ে এলেন।
তিনি বললেন,
—"কাজ করতে পারবে?"
আমি মাথা নাড়লাম। কাজটা ছিল ঝাড়ু দেওয়া, মালপত্র গুছিয়ে রাখা। কঠিন ছিল, তবুও আমি সর্বশক্তি দিয়ে শুরু করলাম।
কাজের প্রতি আমার নিষ্ঠা দেখে মালিক ধীরে ধীরে বিশ্বাস করতে লাগলেন। একদিন আমার অতীতের কথা জানতে চাইলেন। আমি সব খুলে বললাম। তিনি শুধু হেসে বললেন,
—"জীবনকে নতুন করে শুরু করো। আমি তোমার পাশে আছি।"
সেদিন প্রথম মনে হলো, পৃথিবীটা একেবারে নিষ্ঠুর নয়।
অধ্যায় ৬ — ভালোবাসার আলো
কারখানার পাশেই ছোট্ট এক চায়ের দোকান ছিল। সেখানেই কাজ করত প্রিয়া। প্রতিদিন চায়ের কাপে ধোঁয়া উঠত, আর তার চোখে মমতার আলো জ্বলজ্বল করত।
আমার ভাঙাচোরা গল্পগুলো শুনে সে কখনো বিরক্ত হতো না। বরং তার নীরব সঙ্গ আমাকে বাঁচার শক্তি দিত। ধীরে ধীরে আমি বুঝতে পারলাম—প্রিয়ার উপস্থিতিই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ।
অধ্যায় ৭ — নতুন দিগন্ত
প্রিয়ার অনুপ্রেরণায় আমি ছোট্ট একটি ব্যবসা শুরু করলাম। শুরুটা কঠিন ছিল, কিন্তু আমি জানতাম—হারানোর মতো আমার কিছুই নেই। ধীরে ধীরে ব্যবসা বড় হলো। আমি আবার উঠে দাঁড়ালাম নিজের পরিশ্রমে আর মহান রবের করুণায়।
যারা একসময় আমাকে অবজ্ঞা করেছিল, তারাই আবার কাছে আসতে চাইলো। কিন্তু আমি ফিরিয়ে দিলাম। কারণ আমি শিখে গিয়েছিলাম—সত্যিকারের আপনজন রক্তের সম্পর্ক দিয়ে নয়, হৃদয়ের টানে খুঁজে পাওয়া যায়।
অধ্যায় ৮ — পূর্ণতার সংজ্ঞা
আজ আমি সফল, সম্মানিত। কিন্তু তার থেকেও বড় কথা—আমি সুখী।
প্রিয়ার হাত ধরে আমি গড়ে তুলেছি এক পৃথিবী, যেখানে ভালোবাসা আর বিশ্বাসই সবচেয়ে বড় সম্পদ।
হ্যাঁ, আমার জীবন একসময় ফুরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই শূন্যতার ভেতর থেকেই আমি খুঁজে পেয়েছি পূর্ণতা।
আমি আরিফ আহমেদ—একজন মানুষ, যে হেরে গিয়েও নতুন করে জিততে শিখেছে।