Posts

গল্প

আমিত্ব (জমিনের দিন)

August 22, 2025

Towhid Tarek

Original Author তৌহিদ তারেক

62
View

জ্বলমলে নগরীতে ঢুকলাম।এত আলো জীবনে কখনো দেখিনি।চোখে লাগছে।চোখ ছোট ছোট করে তাকাচ্ছি।এ শহরের কত গল্প শুনেছি।ছোটোবেলায় বইয়ে পড়ার সময় কল্পনা করতাম সুদুরের সে শহর কেমন?কেমন তার মানুষজন?কি এক রুপকথার জীবন কাটায় মানুষ সেই শহরে।কত কিছু সেখানে পাওয়া যায়।কিংবা সংবাদপত্রে এই শহরের কত ছবি দেখেছি।বাঁশের বেতের দেয়ালে সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য ভাতের মাড় দিয়ে পেপার লাগিয়ে দিতাম।একবার এই শহরের একটি ছবি পেপারে দিয়েছিল।সে পেপার লাগিয়েছিলাম।সেই থেকে এই শহর চেনা শহর হয়ে উঠল।সব মিলিয়ে শৈশবের শহর,স্বপ্নের শহর।
আমরা রেস্টুরেন্ট খোঁজছি।প্রচন্ড ক্ষিদা পেয়েছে।থাকার হোটেল কাছেই।নিয়াজ ভাই বললেন,হেঁটে সাত-আট মিনিট লাগবে।নিয়াজ ভাই ক্ষুদার কষ্ট সহ্য করতে পারছেন না।তিনি বিমান যাত্রায় খুব অল্প খাওয়া দাওয়া করেন।অগত্যা একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম।আমি চেয়ে চেয়ে দেখছি।নিয়াজ ভাই দেখছে খাবার।তার চোখের অবস্থা এমন অর্ডার না দিয়ে যা পায় ছুঁ মেরে মুখে পুড়ে দেবে।
আমি আসলেই কিছু খাওয়ার মুডে দেই।দেখার মুডে আছি।নিয়াজ ভাই দেখছে,খালি কোন চেয়ার দেখা যায় কিনা এবং পেয়েই ধপাস করে বসে পড়ল।বয়স্ক এক লোক পাশে বসা ছিলেন।নিয়াজ ভাইয়ের বসা দেখে তিনি উঠে গেলেন।দৌড় দেবেন কিনা সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না।সুবিধাজনক রাস্তা খোঁজে বের করছেন।তবে বেশ বিলম্ব হচ্ছে।ঠাওর করতে পারছেন না তার শরীর মানাবে তো?একটু পর বসে পড়লেন।খুব নিশ্চিন্ত হয়ে বসলেন।যখন নিয়াজ ভাই আমাকে বলল,“বাংলাদেশ থেকে এখানে আসা এত সহজ না মেরে ছোটা ভাই”।পাশের বয়স্ক লোকটি ইন্ডিয়ান।বাংলা না বুঝলেও আমরা যে বাঙ্গালী সেটা কয়েক সেকেন্ডেই বুঝে ফেলেছেন।তিনি এই শহরে আজ দ্বিতীয় বার একা বেরিয়েছেন।চৌদ্দ দিনের জন্য এ দেশে আসা তার।ছোট ভাইয়ের বউ বারংবার বলে দিয়েছে,ছিনতাইকারী আছে সাবধান।নিগ্রোদের থেকে আরও বেশি সাবধান। নিয়াজ ভাই কালো চামড়ার লোক।চেহারাটাও কিছুটা আফ্রিকান আফ্রিকান লাগে বলে বুড়ার হার্ট হয়তো ধরফর ধরফর করছিল।
এই শহরে এসে আমার স্বপ্নের একটা ধাপ পূর্ণ হল।আমার জীবনে এখন অর্জনের সময়।সময় এখন আমার পক্ষে।অবশেষে আমার কপাল খুলতে যাচ্ছে।এ জাতীয় চিন্তায় মগ্ন আমি।
বিছানায় শুয়ে মনে হল বাদশাহী ঘুম ঘুমাবো।মুঘলদের খাবারের মতো ঘুম ছিল কিনা জানা নেই।থাকলে আজ মোঘল ঘুম ঘুমাবো।আমাকে আর পায় কে?আমি এসে গেছি।পৃথিবী শুনছো আমি এসে গেছি..
একে একে সাত মাস নয়দিন কেটে গেল।আজ রবিবার।ছুটির দিনে মাঝে মাঝে ঘুরতে বের হই।না হয় ঘুম দেই লম্বা ঘুম।এই সাতমাসে অনেক কিছুই বদলে গেছে।প্রাথমিক রোমাঞ্চ কেটে যাওয়ার পর চিন্তা ছিল কিভাবে একটি কাজ জুঁটাবো।সেটা হল এবং ভালোভাবেই হল।দক্ষ লোকের সংখ্যা পৃথিবীতে সবচেয়ে কম।দক্ষ এবং কর্মঠ নয় লোকের সংখ্যা আরও কম।দক্ষ,কর্মঠ ও শিক্ষিত লোকদেরই হয়তো স্বর্ণমানব বলা যায়।সাতমাস আগে একটা কাজের জন্য অস্থির হয়ে গিয়েছিলাম।এখন মনে হয় প্রতিদিনই একটা কাজ বের করতে পারব।বালাই হাওরে আমার মা-বাবা বাস করে।নয় লক্ষ সাতান্ন হাজার টাকা পাঠিয়েছি।আরও বেশি পাঠাতে পারতাম।কিছু কেনাকাটা করা লাগছে।আলাদা রুম নিয়ে থাকছি।রুম শেয়ার করা সিলেটিদের কাছে সম্ভবত সবচেয়ে বড় দূর্ভোগের একটি।বিভিন্ন ওয়াটস আপগ্রুপ আছে।মসজিদ গ্রুপ,ইউনিয়ন গ্রুপ,উপজেলা গ্রুপ।সেখানে কন্ট্রিবিউট করি।ওয়াজের জন্য চাঁদা দিয়েছি,মাদ্রাসার টিনের জন্য কল এসেছে।সময় করে জেনে নেব টাকা কেমন দরকার।অনেক লোক আগে পাশ দিয়ে গেলে কথাও বলত না।ওয়াটসআপ গ্রুপ থেকে নাম্বার নিয়ে নক করে।আমি হাসি,আমার আনন্দ হয় রাগ হয় না।দুরদেশে চলে এলে রাগ,অভিমান বড়ই তুচ্ছ জিনিস হয়ে যায়।বালাই হাওড়ের ঢেউয়ের মাঁয়া যেমন টানে তেমনি মানুষগুলিও টানে।যাদের সাথে শত্রুতা ছিল ইচ্ছে হয় তাদের একে একে কল দিয়ে বলি,আমি কারো শত্রু নই।আমি শত্রুতার,ঝগড়াঝাঁটি ভুলে যাওয়া মানুষ।আমার মায়ের দেশ,আমার সবুজ লতাপাতার দেশ আমি তোমাদেরই।বহুদুরে চলে গেলে মানুষের মধ্যে একটা টান চলে আসে।যেই টানের জন্য বাংলাদেশের প্রবাসীরা দেশটাকে নিজের ঘামে,নিজের রক্তে গড়ে তুলছে।শুধু নিজের জন্য এসেছিলাম,পরিবারের জন্য এসেছিলাম এসে দেখি প্রতিবেশীর জন্য এসেছি,গ্রামের জন্য এসেছি,লালসবুজ দেশটার জন্য এসেছি।হাফ ইঞ্চি কলিজাটা ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল আকার ধারণ করেছে।ঢাকায় আগুন লাগলে মনে হয় নিজের ঘরের টিন পুঁড়ছে।গ্রামের কারও অসুস্থতার খবরে মনে হয় এ তো আমার ভাই অসুস্থ হয়েছে।এই দেশে যতই বাঙ্গালিকে দেখি ততই গর্বে বুকটা ভরে যায়।দেশে থাকতে মনে করতাম বাঙ্গালিরা  পৃথিবীর খারাপের খারাপ জাতি।শুধু ধান্ধাবাঁজি,বাটপারি করে।স্বার্থের বাইরে এক পা এগোয় না।এই সাতমাসে বাঙ্গালিকে আমি চিনতে পেরেছি।ঠিক বাঙ্গালিকে বুঝতে পেরেছি।এখন আমি বলতেই পারি পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ ক'টা জাতি থাকলে বাঙ্গালিও একটা।এরা বরফ শীতে কাঁপে বাঙ্গালির জন্য,এরা মরুভুমে  পুঁড়ে বাঙ্গালির জন্যই।এ কোন বাঙ্গালি আমি দেখছি?এ কোন স্বরুপ আমি প্রত্যক্ষ করছি।বিদেশের বাঙ্গালি যেন একেকটা পবিত্র মানব।মাকে বলেছি তিনবছর পর দেশে যাবো।বালাই হাওরে ডুব দিয়ে গোসল করব।পবিত্র হবো আরও বেশি পবিত্র হতে হবে আমাদের।যারা রোজ বালাই হাওরে গোসল করে তারা আরেকটু ঘষে মজে নিক আমরাও আসছি।উঁনুন থেকে এবার সাম্য,শান্তির শিখা বেরোবে।

Comments

    Please login to post comment. Login