Posts

চিন্তা

সত্য লিখে বাঁচা সহজ নয়!

August 23, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

374
View



মেঘনার জলে শুদ্ধ হলো বিভুরঞ্জন সরকারের আত্মসম্মান। আমরা যারা আপোষকামিতার স্রোতে গা ভাসিয়ে ভয় করে চলেছি মরণে -তাদের মুখরক্ষা করে গেলেন বিভুরঞ্জন। যিনি তাঁর অমোঘ শেষ কথাটি বলেছেন, 'সত্য লিখে বাঁচা সহজ নয়!' 

'সব মিলিয়ে পত্রিকায় আমার অবস্থা তাই খুবই নাজুক। সজ্জন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক চাপ সইতে না পেরে আমার সঙ্গে কথা বলাই বন্ধ করেছেন।
আমি এখন কী করি? কোন পথে হাঁটি?' 

এটি সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের জীবনের সর্বশেষ নোট। এবং এটিই তার জীবননোটের আসল সারবত্তা। Upward pressure and survival crisis তথা উপরের চাপ ও টিকে থাকার সংকট -এই শিরোনামে ভবিষ্যতের কেউ হয়ত রিসার্চ পেপার তৈরি করবে। 

রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক হীনস্বার্থে দেশে আগাছার মতো গণমাধ্যম নিবন্ধন পেয়েছে। বিগত সরকার এটি খুব বেশিমাত্রায় করেছে। কিন্তু সেসব গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়নি। এই সুযোগে মালিকেরাও শ্রমিকের ঘাম ও রক্ত শোষে নিয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়ে রেখে আলগা ঠাটবাট দেখাতে পারছেন। সংবাদমাধ্যম তার স্বভাবসুলভ দায়িত্বের জায়গা থেকে ক্ষমতাকে জবাবদিহি করলেই এর কন্ঠ চেপে ধরা হয়। কী একালে, কী সেকালে -স্বাধীনমত রোধ করবার খায়েশ যেন কারোরই মেটে না। 

সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকার সরাসরি দল না করলেও পার্টিজান ছিলেন। 'শেখ হাসিনা স্বপ্নপূরণের সফল কারিগর' -নামে বই লিখেছেন। যতটুকু অনুমান করি সেখানে তিনি হাসিনা রেজিমের ডার্কসাইডগুলোর আলোচনা উহ্য রেখে ইতিবাচক আলোচনায় হাসিনাকে গ্লোরিফাই করেছেন। এমন কাজের পরিণামে অন্যদের কথা বলব না শুধু সাংবাদিক কম্যুনিটির অনেকেই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ নয় কেবল, বৈদ্যুতিক খাম্বাও বনে গেছেন। কিন্তু বিভুরঞ্জনের ভাগ্যের শিকে ছিঁড়েনি। কারণ বিভুরঞ্জন সময় বুঝে উতল হাওয়া দেখে ঠিকঠাক ডিগবাজিটা মারতে পারেননি। হতে পারে এটি তাঁর সাদাসিধে সরল বুদ্ধি অথবা নৈতিকতা চর্চার ছিটেফোঁটা। 

মিস্টার বিভুরঞ্জন শেষ নোটে নিজেই লিখেছেন, 'শেখ হাসিনার শাসনামলে নানা পরিচয়ে অনেকে অনেক সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন। একপর্যায়ে লাজলজ্জা ভুলে আমিও শেখ হাসিনার দরবারে সাহায্যের আবেদন করে কোনো ফল পাইনি। অনেক সাংবাদিক প্লট পেয়েছেন। আমি দুইবার আবেদন করেও সফল হইনি। বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনাকে নিয়ে বই লিখেও নাকি কতজন ভাগ্য বদলেছেন। অথচ আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত দুটি বইয়ের জন্য আমি দুই টাকাও রয়্যালিটি পাইনি। একেই বলে কপাল!' 

ধরে নেয়া যায় বিভুরঞ্জন সরকার আ.লীগ সরকারের আনুকূল্য চেয়েছেন। কিন্তু সফলকাম হতে পারেননি। সফলকাম হলে হয়ত প্রবল আত্মসম্মানে গ্লানির কলঙ্ক লাগত, তবে নিজের বোধকে পরিশুদ্ধ করতে স্রোতস্বিনী মেঘনার জলকে আলিঙ্গন করতে হতো না। বিভুরঞ্জন নিতান্ত নিরূপায় হয়ে নিজেকে শুদ্ধতায় মিলিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু দলান্ধ ও দলদাসত্বের বাইরে এসে তিনি তাঁর আত্মসম্মান বাঁচাতে পেরেছেন। পক্ষান্তরে আপনারা শ্বেতহস্তি যারা প্রতিষ্ঠান প্রধানের চামচামি করে, ক্ষমতাসীন সরকারের তল্পিবাহক হয়ে বেতন ও ভাতার মোটাভাগ নিজেদের দখলে রেখে বিভুরঞ্জনদের মতো মানুষদেরকে প্রান্তিক অবস্থায় ঠেলে দিচ্ছেন ক্রমাগত -তারা কঠিন সময়ের কাছে কী জবাব দেবেন? 

কিন্তু এসব আলাপ রেখেও বিভুরঞ্জন সাংবাদিক কম্যুনিটির জন্য যে মেসেজ রেখে গেলেন তা প্রগাঢ় আলোচনার দাবি রাখে। আমরা বছরের পর বছর ধরে বলে আসছি বাংলাদেশে অন্যান্য সেক্টরের মতো সাংবাদিকতার জগতও একদম ঠিক নেই। সাংবাদিকরা অন্যের অসঙ্গতি তুলে ধরে, কিন্তু নিজেদের ঘরের অন্ধকার দিক নিয়ে কখনোই খবর করে না, আলাপ করে না। কার্যত তিনি এই বিষয়টিই আমাদেরকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেছেন। 

দেশে একটামাত্র মিডিয়া থাকলেও সমস্যা ছিল না। সেটি যদি বিবিসি-সিএনএনের মতো সঠিক সত্য কথা অবলীলায় বলত পারত তা হতো দেশ, জাতি ও ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের জন্য সর্বোচ্চ কল্যাণকর। দেশে 'ধর্মের চেয়ে আগাছা বেশি'র মতো অগণন মিডিয়া। তারা নাম ধারণ করেছে গণমাধ্যম। আসলে তাদের কাজ হলো মালিকের ইচ্ছেপূরণ, দলপ্রীতি, গোষ্ঠীতোষণ এবং ক্ষমতার তল্পিবাহকের ভূমিকায় অভিনয় করা। একমাত্র সংবাদ মাধ্যমেই অভিনয় ও ন্যাকামো চলে না। সর্বোচ্চ বস্তুনিষ্ঠতা, সততা ও নৈতিকতার চর্চা না থাকলে গণমাধ্যম তার নামের প্রতি সুবিচার কখনোই করতে পারবে না। ফোর্থ স্টেট হয়ে উঠাও তার পক্ষে সম্ভবপর হবে না। বাংলাদেশের দশা হয়েছে ওই অসম্ভবের চরম পরাকাষ্ঠা। 

বিভুরঞ্জন তাঁর নোটের শুরুতেই লিখেছেন, 'সাংবাদিকতার সঙ্গে আমার সম্পর্ক পাঁচ দশকের বেশি সময়ের। দেশের নানা পরিবর্তন, আন্দোলন, গণআন্দোলন এবং রাজনৈতিক উত্থান-পতন প্রত্যক্ষ করেছি। এই দীর্ঘ সময় আমি লিখেছি সত্যের পক্ষে, মানুষের পক্ষে, দেশের পক্ষে। কিন্তু আজ, যখন নিজের জীবনকে দেখি, অনুভব করি -সত্য লিখে বাঁচা সহজ নয়।' 

তিনি লিখেছেন, 'মন খুলে সমালোচনা করার কথা প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন। কিন্তু তার প্রেস বিভাগ তো মনখোলা নয়।' 

এই বিষয়গুলো নিয়ে ইন্টেরিম গভমেন্ট ভাবতে পারে। আ.লীগ সরকার সংশয়হীনভাবে স্বাধীন সাংবাদিকতার বাধা ছিল। গণ-অভ্যুত্থানে গঠিত হওয়া গণমুখী সরকার আগের রেজিমের ধারাবাহিকতা কেন রক্ষা করবে? কেন গণমাধ্যম সংস্কার কমিশন গঠনের মাধ্যমে মিডিয়ার সর্বোত স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে না? কেন বলবে না যে, যেসব প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের ন্যায্য বেতন-ভাতা থেকে বঞ্চিত করে -তাদের গণমাধ্যম চালানোর দরকার নেই। 

সাংবাদিক বিভুরঞ্জন তাঁর পারিবারিক সংকটের কথা তুলে ধরেছেন। তাঁর সরকারি চিকিৎসক কন্যার উচ্চতর ডিগ্রি হয় না, বুয়েট ইঞ্জিনিয়ার ছেলে চাকরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে -এসবই বাঙালির রোজকার সংকট। কিন্তু বিভুরঞ্জনের ধর্মীয় পরিচয় দিয়ে যদি তাঁর পরিবারের প্রতি এতটুকু বৈষম্য করা হয় সেটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পর্ষদ খতিয়ে দেখতে পারে। বাংলাদেশে যদিও হিন্দু কম্যুনিটি আ.লীগের কাছেও নানা ছলছুতোয় নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হয়েছে বেশুমার -তবু অনেকেই হিন্দু বলতে আ.লীগ বুঝে। অথচ বর্তমান সরকারের সময় অনেক হিন্দুই দৃশ্যমানভাবে ক্ষমতার পাদপ্রদীপে আছে। 

মোদ্দাকথা হলো সাংবাদিক বিভুরঞ্জনের ঘটনাকে আর পাঁচটা দৈনন্দিন ঘটনার সাথে মিলিয়ে দিয়ে পাশ কাটানোর সুযোগ নেই। তিনি কেন পারিবারিক বন্ধন টুটে দিয়ে আত্মহননের পথ বেছে নিলেন এটি নিয়ে সমাজবিজ্ঞানী ও রাষ্ট্রনিয়ন্তা সবাইকে ভাবতে। তাঁর ব্যক্তিগত দলপ্রীতির চেয়ে তাঁর দেখানো সাংবাদিকতার ভয়াল সংকট নিয়ে জোরেশোরে কথা বলতে হবে। সভ্য ও কল্যাণময় রাষ্ট্র বিনির্মাণ, শুদ্ধ সাংস্কৃতিক আবহ তৈরি এবং দলমত নির্বিশেষে সবার সুন্দর সহাবস্থানের সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্যই এটি খুব জরুরি। 

ফুটনোটস: হাতেগোনা কয়েকটি গণমাধ্যমের মধ্যে মতিউর রহমান সম্পাদিত প্রথম আলো বাংলাদেশের শীর্ষ গণমাধ্যম। যারা সর্বোচ্চ বস্তুনিষ্ঠতা ও পেশাদারিত্ব রক্ষা করে। নিজের কর্মীর মানমর্যাদা ও অর্থনৈতিক সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেয়। লেখকদের মর্যাদা সমুন্নত রাখে। বিভুরঞ্জন সরকার স্বীকার করেছেন সম্পাদক মতিউর রহমানকে ফিরিয়ে দেয়া ছিল তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ ভুল। 

লেখক: সাংবাদিক 
২৩ আগস্ট ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login

  • Chameli Akter 3 months ago

    কথা বলেছেন সত্য