Posts

চিন্তা

অশ্লীল স্লোগান ও তরুণ প্রজন্মের মানসিকতা

August 26, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

325
View

বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্লোগান বরাবরই ছিল প্রতিবাদের অন্যতম হাতিয়ার। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে নব্বইয়ের গণআন্দোলন কিংবা গেল বছরের সরকারবিরোধী জুলাই মুভমেন্ট -সবক্ষেত্রেই স্লোগান আন্দোলনকে শক্তি দিয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে যে প্রবণতা চোখে পড়ছে, তা নতুন এক বাস্তবতার দিকে ইঙ্গিত করছে। তরুণ প্রজন্ম, বিশেষত জেনজি (Gen Z), তাদের রাজনৈতিক প্রতিবাদে ব্যবহার করছে এমন সব স্লোগান, যেখানে অশ্লীলতা, যৌন ইঙ্গিত কিংবা শরীরের শারীরবৃত্তীয় অংশকে খুব কদর্যভাবে বেশিই প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। যেমন—“টিনের চালে কাউয়া, ফজলু আমার *উয়া” বা “এক দুই তিন চার, তারেক জিয়ার *টকি মার”। এর আগে জুলাই আন্দোলনে প্রতিবাদকারীরা মুখে বলত এবং গ্রাফিতি করত, হাসিনা cdi, এখন আবার পাল্টা দিতে আ.লীগ অ্যাক্টিভিস্টরা বলছে জুলাই cdi. ক'দিন আগে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম তাঁর সোশ্যাল হ্যান্ডেলে লিখেছেন, 'সাধু সাবধান! কে কী করছেন কিংবা করতে চাচ্ছেন কোনো কিছুই গোপন থাকবে না। শেখ হাসিনা তো জান নিয়ে পালাইতে পারসে। আপনারা সেটাও পারবেন না। জনগণ এতো ভালো না। কঙ্কালতন্ত্রের পশ্চাৎ অংশের মধ্যবর্তী মাংসল ক্ষেত্র দিয়ে সকল ক্ষমতা ভরে দেওয়া হবে।' 

প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এ প্রজন্ম প্রকাশ্য রাজনীতিতে এমন ভাষার আশ্রয় নিচ্ছে? 

মনোবিশ্লেষণী ব্যাখ্যা বলছে, নিষিদ্ধ শব্দ ব্যবহার মানুষের ভেতরে দমিত আকাঙ্ক্ষার এক ধরনের বহিঃপ্রকাশ। মনস্তাত্ত্বিক সিগমুন্ড ফ্রয়েড তাঁর লেখায় দেখিয়েছিলেন, সামাজিকভাবে চাপা রাখা যৌন শব্দ বা ট্যাবু ভাষা ব্যবহার অনেক সময় মানুষকে মুক্তির অনুভূতি দেয়। রাজনৈতিক স্লোগানে এই শব্দাবলি ব্যবহার তরুণদের কাছে তাই “বিদ্রোহী সাহসিকতা”র প্রতীক। 

দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অচলাবস্থা, দুর্নীতি ও নেতৃত্বহীনতা তরুণদের মধ্যে একধরনের দমনকৃত হতাশা তৈরি করেছে। Dollard-এর Frustration-Aggression Hypothesis অনুযায়ী, হতাশা প্রায়ই প্রতীকী আগ্রাসন হিসেবে বেরিয়ে আসে। বাংলাদেশি তরুণরা যখন দেখে তাদের দাবি প্রচলিত পথে গুরুত্ব পাচ্ছে না, তখন তারা ভাষাকেই আক্রমণের অস্ত্র হিসেবে বেছে নিচ্ছে। অশ্লীল স্লোগান তাই কেবল অশোভনতা নয়, বরং জমে থাকা ক্রোধেরঝ্য বিস্ফোরণ। 

এই প্রজন্ম সামাজিক মাধ্যমে বেড়ে উঠেছে। TikTok, Facebook বা youtube-এর মতো প্ল্যাটফর্মে “শক ভ্যালু” বা চমক সৃষ্টি করাই অনেক সময় জনপ্রিয়তার মূল চালিকাশক্তি। অনলাইন কথোপকথনে ব্যবহৃত অশ্রাব্যতা সহজেই অফলাইনে চলে আসছে। মনোবিজ্ঞানী Suler যাকে বলেছেন “online disinhibition effect” -অনলাইনে যে ভাষা সহজে উচ্চারিত হয়, তা বাস্তব রাজনীতিতেও জায়গা করে নিচ্ছে। 

তাত্ত্বিক মিশেল ফুকো দেখিয়েন, যৌনাঙ্গকেন্দ্রিক ভাষা আসলে সামাজিক ক্ষমতার কাঠামোকে ভেঙে দেয়। নেতাদের শরীর বা পশ্চাৎদেশ নিয়ে কৌতুক করার ভেতরে নিহিত থাকে এক ধরনের ‘ডিমিস্টিফিকেশন’। অর্থাৎ নেতাদের আর অর্ধদেবতার আসনে না বসিয়ে তাদেরকে সাধারণ দেহী মানুষ হিসেবে চিত্রিত করা। অশ্লীল স্লোগান তাই ক্ষমতার মুখোশ উন্মোচনের এক কৌশল হিসেবেও কাজ করছে।


বাংলাদেশের তরুণদের বড় একটা অংশ বেকারত্ব, অনিশ্চয়তা ও অকার্যকর রাজনৈতিক ব্যবস্থার শিকার। ফরাসী সমাজবিজ্ঞানী পিয়ের বুর্দিয়ু ভাষাকে দেখেছিলেন ক্ষমতার লড়াইয়ের ক্ষেত্র হিসেবে। যখন প্রচলিত রাজনীতির কাঠামোতে তরুণদের কণ্ঠস্বর প্রতিফলিত হয় না, তখন তারা ভাষার মধ্য দিয়েই প্রতীকী সহিংসতা চালায়। শুনতে অশ্রাব্য হলেও অশ্লীল স্লোগানই যেখানে এক ধরনের ‘বিকল্প রাজনৈতিক ভাষা’।

বিশ্রী এই প্রবণতা নিছক হাস্যরস বা দুষ্টুমি নয়; বরং তাৎপর্যপূর্ণ এক প্রতিরোধ। তবে এর ব্যাপক নেতিবাচক দিকও রয়েছে। প্রথমত, এতে করে রাজনৈতিক দাবির মর্যাদা ক্ষুণ্ন হতে পারে। দ্বিতীয়ত, প্রজন্মগত ফারাক তৈরি হয় -বয়স্ক প্রজন্ম এটিকে অসভ্যতা মনে করে। তৃতীয়ত, দীর্ঘমেয়াদে সমাজের ভাষাচর্চা দূষিত হওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। চতুর্থত বিকৃত সংস্কৃতি তার জায়গা পোক্ত করায় শুভবোধ, ভদ্রতা, সভ্যতা হারিয়ে যেতে পারে। এবং পঞ্চমত গণমানুষ চরম অশ্লীলতাকে স্বাভাবিক বলে নির্বিকারত্ব মেনে নেতে পারে। 

Gen Z প্রজন্মের এই বিকৃত স্লোগান সংস্কৃতি তাদের হতাশা, ক্ষোভ ও রাজনৈতিক প্রতিরোধের বহিঃপ্রকাশ। তারা প্রচলিত ভদ্র ভাষায় বিশ্বাস হারিয়েছে, কারণ সেটি তাদের দাবি কার্যকর করতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই তারা ভিন্ন ভাষা বেছে নিয়েছে -যতই অশ্রাব্য হোক না কেন। তবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি এই বার্তার ভেতরের ক্ষোভকে না বোঝে, তাহলে অশ্লীল স্লোগান আরও বাড়বে। নেতাদের উচিত -অশ্লীলতার ভাষা বন্ধ করতে চাইলে প্রথমে তরুণদের দাবিকে গুরুত্ব দেওয়া, যাতে তারা বিকল্প ভাষার পরিবর্তে বাস্তব রাজনৈতিক অংশগ্রহণে নিজের অবস্থান প্রকাশ করতে পারে। 

রেফারেন্স:
• Freud, S. (1905). Three Essays on the Theory of Sexuality.
• Dollard, J. et al. (1939). Frustration and Aggression. Yale University Press.
• Suler, J. (2004). “The Online Disinhibition Effect.” CyberPsychology & Behavior, 7(3).
• Foucault, M. (1978). The History of Sexuality, Vol. I.
• Bourdieu, P. (1991). Language and Symbolic Power.


লেখক: সাংবাদিক 
২৬ আগস্ট ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login