আফরা এখনো ক্লাসে ভর্তি হয়নি
আফরা ছোট্ট একটা মেয়ে। বয়স মাত্র ছয়। তার চোখদুটো টলটলে পানির মতো, আর ঠোঁটে সারাক্ষণ লাজুক একটা হাসি খেলে বেড়ায়। সে মায়ের হাত ধরে রাস্তায় হাঁটে, কিন্তু যখনই দেখে স্কুলগামী বাচ্চারা ইউনিফর্ম পরে যাচ্ছে, তার বুকের ভেতর হালকা কষ্টের ঢেউ খেলে যায়।
আফরা এখনো ক্লাসে ভর্তি হয়নি।
প্রতিদিন সকালে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। পাশের বাড়ির রাফি, তুহিন, মিতু সবাই নীল-সাদা ড্রেস পরে স্কুলে যায়। তাদের হাতে চকচকে ব্যাগ, বই-খাতা, নতুন জুতো। আফরার চোখে স্বপ্ন জমে ওঠে। সে মাকে বলে,
—“মা, আমি কবে স্কুলে যাবো?”
রুবিনা মায়ের চোখ ভিজে ওঠে। তিনি মেয়ে আফরাকে বুকে জড়িয়ে বলেন,
—“যাবি মা, অবশ্যই যাবি। একটু সময় দে। টাকার ব্যবস্থা হলেই তোকে ভর্তি করাবো।”
কিন্তু আফরা বুঝে যায়—টাকা নামক শব্দটা তাদের সংসারে অনেক বড় একটা দেয়াল।
ছোট্ট স্বপ্ন
আফরার কাছে স্কুল মানে রাজপ্রাসাদ। খাতা মানে ধনরত্ন। আর পেন্সিল মানে জাদুর কাঠি। সে রাতে শুয়ে শুয়ে কল্পনা করে—সে ক্লাসে বসে আছে, ম্যাডাম তাকে ডাকছে, “আফরা, ওঠো, কবিতা বলো।” আর সবাই হাততালি দিচ্ছে।
কিন্তু সকালে ঘুম ভাঙলে আবার বাস্তব সামনে আসে। ভাঙা খাট, পুরোনো জামা, আর মায়ের ক্লান্ত মুখ।
অভাবের সংসার
আফরার মা সেলাই আর বাসায় বাসায় কাজ করে সংসার চালান। বাবার কোনো খোঁজ নেই অনেক বছর। সংসারে টানাপোড়েন লেগেই থাকে। কখনো ভাড়া দিতে দেরি হয়, কখনো বাজার ফাঁকা পড়ে যায়।
কিন্তু আফরার মন ভরেই থাকে স্বপ্নে। সে খালি খাতার পাতায় নিজের মতো করে অক্ষর আঁকতে চেষ্টা করে। একদিন পাশের বাসার মিতুর খাতা দেখে অক্ষর কপি করতে বসে গেল। কিন্তু হঠাৎ হাত কাঁপল, লাইনগুলো বেঁকে গেল। আফরা বিরক্ত হয়ে খাতা বন্ধ করল। তারপরও মায়ের কাছে এসে বলল,
—“মা, আমি শিখব। আমি পারব।”
মানুষের কথা
পাড়ার লোকেরা কখনো মাকে প্রশ্ন করে,
—“আপনার মেয়ে এখনো স্কুলে যায় না কেন?”
কেউ কেউ আবার হাসাহাসি করে বলে,
—“গরিবের মেয়ে পড়াশোনা করে কী হবে?”
এসব কথা আফরা শুনে ফেলে। তার বুকটা ধক করে ওঠে। কিন্তু সে কাউকে কিছু বলে না। শুধু মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে,
“একদিন আমি অবশ্যই স্কুলে যাবো। সবাইকে দেখাবো আমি পারি।”
আলো আসার শুরু
হঠাৎ একদিন খবর এলো—পাশের মাঠে এক এনজিওর স্কুল খুলছে। গরিব বাচ্চাদের জন্য ফ্রি পড়াশোনার ব্যবস্থা থাকবে। রুবিনার বুক কেঁপে উঠল। তিনি আফরার হাত ধরে সেখানে গেলেন।
একজন দিদি নাম লিখে নিলেন। তারপর আফরার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
—“তুমি কি পড়তে চাই?”
আফরা মাথা নাড়িয়ে বলল,
—“হ্যাঁ, চাই।”
সেদিনই প্রথমবার সে নিজের নাম লিখতে শিখল—আফরা।
নতুন দুনিয়া
টিনের ঘর, বাঁশের বেঞ্চ, হাতে গোনা কিছু বই—এটাই আফরার কাছে স্বপ্নের স্কুল। প্রতিদিন সকালে পুরোনো জামা পরে হলেও সে আনন্দে সেখানে ছুটে যায়। তার হাতে ভাঙা পেন্সিল, কিন্তু চোখে হাজার রঙের আলো।
শিক্ষকরা তাকে দেখে বলেন,
—“এই মেয়েটার চোখে অনেক জেদ আছে।”
আফরার প্রতিজ্ঞা
একদিন ক্লাসে স্যার জিজ্ঞেস করলেন,
—“তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও, আফরা?”
আফরা নির্দ্বিধায় বলল,
—“আমি শিক্ষক হবো। যেন কোনো ছোট্ট মেয়ে কখনো স্কুলে ভর্তি না হয়ে কাঁদতে না হয়।”
সবাই অবাক হয়ে তাকাল। রুবিনা মায়ের চোখে জল এসে গেল।
সমাপ্তি
আফরা ছোট্ট মেয়ে। তার লড়াই কেবল শুরু। হয়তো তার হাতে নতুন বই নেই, নতুন জামা নেই। কিন্তু তার স্বপ্ন আছে। সেই স্বপ্নই একদিন তাকে অনেক দূরে নিয়ে যাবে।
কারণ—
আফরা এখনো ক্লাসে ভর্তি হয়নি, কিন্তু তার মন ইতিমধ্যেই জ্ঞানের স্কুলে ভর্তি হয়ে গেছে।