সেদিন আদালতে জর্জ আসার পর প্রায় ৫০ বছর বয়সী একজন লোক কে কাঠগড়ায় আনা হলো। সে ছিল খুনের আসামি। আর আমি হলাম আদালতের একজন প্রহরী। সেটা ছিল একটা অন্যরকম ইমোশনাল ঘটনা। অতঃপর আদালতের কাজ শুরু হলো। জর্জ সাহেব আসামি কে জীজ্ঞেস করলেন আপনি এ বয়সে একজন খুনের আসামি। তাও আবার ২০ বছর আগে আপনার নিজের স্ত্রীকে খুন করেছিলেন। আর এখন নিজেই আইনের কাছে এসে আত্মসমর্পণ করেছেন। এর কারণ কি?
কাঠগড়ায় দাঁড়ানো লোকটি কোনো কথা না বলে কিছুক্ষণ চুপ থাকল। তারপর জর্জ সাহেব আবার জীজ্ঞেস করায় তিনি ভাঙা কন্ঠে বললেন আমি দোষ করেছি আমাকে শাস্তি দিন। তারপর তার উকিল তাকে বললেন আপনি কেন এরকম করেছিলেন দয়া করে আমাদের বলুন। লোকটি কিছুই বলছিলেন না। অনেক্ষণ তার উকিল তাকে বোঝানোর পর অবশেষে তিনি মুখ খুললেন।
তিনি বললেন, আজ থেকে ২৬ বছর আগের ঘটনা আমি একটা মেয়েকে অনেক ভালোবাসতাম সেও আমাকে ভালবাসতো তারপর আমরা বিয়ে করি। আমি ছিলাম একজন রিকশাচালক। আমাদের বিয়ের এক বছর পর আমাদের একটি ছেলে সন্তান হয়। অভাবের মাঝেও আমাদের সংসার ভালোই চলছিলো। দেখতে দেখতে আমাদের ছেলের বয়স ৫ বছর হয়ে গেল। একদিন আমি আগেই বাড়ি চলে আসলাম। দেখলাম বাড়ির বাইরে আমার ছেলে একাই খেলা করতেছে।
তাকে কোলে নিয়ে বাড়িতে প্রবেশ করলাম ভিতরে যেতেই দেখলাম আমাদের ঘর থেকে একজন পুরুষ বের হচ্ছে। আমি চমকে উঠলাম তারপর আমার স্ত্রী বের হয়ে আসল। আমি রেগে বললাম এসব কি । কেউ কিছু বলছিল না আমি আরো রেগে গেলাম তারপর সেই লোকটি কে মারতে গেলাম। তার গায়ে হাত তুলতেই আমার নিজের স্ত্রী আমাকে একটা থাপ্পর মারল। আমি অবাক হয়ে গেলাম।এরপর আমার আমাকে বলল তোমার সাথে বিয়ে করে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করেছিলাম। তোমার তো নুন আনতে পান্তা ফুরায়। তোমার সাথে আর আমি সংসার করতে পারব না। এরপর সেই লোকটির সাথে বেরিয়ে গেল। আমার কোলে আমার ছেলে কান্না করতে লাগলো। একবারো ভাবলো না আমার কথা একবারও ভাবলো না ছোট ছেলেটার কথা।
এই বলে আসামি টি কান্না করতে লাগলো একটু পানি চাইল তারপর তাকে পানি দেওয়া হলো। পানি পান করার পর আবার তিনি বলতে শুরু করলেন। এভাবেই কিছুদিন চলে গেল। আমি ভাবছিলাম ভুল ভাঙলে আবার চলে আসবে। কিন্তু সে আর কোন খবর নেয়নি। একদিন আমি খবর নিতে গেলাম তারপর আমি দেখলাম সে আর একটি লোকের সাথে ঘুরতেছে। আমার আরও খারাপ লাগলো। কিছুদিন পর আবার আর একটি ছেলের সঙ্গে তাকে দেখতে পেলাম। আমার তখন তার উপর প্রচন্ড ঘৃনা হচ্ছিল। আমি বাড়িতে আসতেই আমার ছেলে বলল আম্মু কোথায়, আমার বলার কোনো ভাষা ছিল না। আমি ছেলে কে বুকে নিয়ে জোরে জোরে কাঁদতে লাগলাম ।
এরপর একদিন দেখলাম একটা ছেলে তার সাথে জোর জবরদস্তি করতেছে আমি গিয়ে ছেলে টিকে তাড়িয়ে দিলাম তখন সে আমাকে বলল তোমাকে আমার বিষয়ে নাক গলাতে কে বলেছে আমাকে যে যাই করুক তোমার তাতে কি? , আমি যেখানে টাকা পাবো সেখানেই যাব। আমার তখন এতোটা ঘৃণা হচ্ছিল আমি রেগে গিয়ে পাশেই একটা ছুরি দেখতে পেলাম সেটাকে উঠিয়ে তার গলায় মেরে দিলাম । কারণ তার এসব আমার আর সহ্য হচ্ছিল না। তারপর আমি সেখান থেকে পালিয়ে গিয়ে আমার ছেলে কে নিয়ে অন্য জায়গায় আত্মগোপন করলাম। এভাবেই আমি সেখান মজুরি কাজ করে আমার ছেলে কে ভালো স্কুলে পড়ালেখা করালাম। সেদিন আমি শুধু আমার ছেলে কে বড় করে তার জীবন সাজিয়ে দেয়ার জন্য পালিয়ে গিয়েছিলাম । এখন আমার ছেলে বড় হয়ে গেছে সে এখন তার নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছে। আমার কাজ এখন শেষ তাই আমি এখন আমার কাজের শাস্তি পাওয়ার জন্য আত্মসমর্পণ করেছি।
তখন জর্জ সাহেব বললেন কিন্তু তোমার ছেলে কোথায়? তখন তার পক্ষের যিনি উকিল ছিলেন তিনি ভাঙা কন্ঠে বলে উঠেন, আমিই সেই হতভাগা জর্জ সাহেব। আদালতের সবাই যেন চমকে উঠলাম। ততক্ষণাৎ সেই উকিল আসামি লোকটির হাত থেকে তার শার্টের কাপড় তুলতেই আদালত যেন থমকে গেল । কারণ তার হাতে অগুনিত ব্লেড দিয়ে কাটার দাগ। জর্জ সাহেব আসামি কে জিজ্ঞেস করলেন এগুলো কিসের কাটার দাগ । লোকটি একটু চুপ থেকে কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমার স্স্ত্রী কে আমি এতো টা ভালোবাসতাম যখন আমার স্ত্রীর ওইসব কথা মনে পড়ে কষ্ট লাগত তখন আমি আমার হাত কাটতাম যেন এই যন্ত্রনায় আমি ওই কষ্ট ভুলে যাই। কারণ আমি ওই কষ্ট সহ্য করতে পারতাম না। আদালতে জর্জ সহ সবার চোখের কোণে যেন পানি এসে পড়ল। কিছুক্ষণের জন্য আদালত যেন নিস্তব্ধ হয়ে গেছে।
এরপর জর্জ সাহেব সাজা শোনালেন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। লোকটি তার ছেলেকে বুকে নিয়ে কিছুক্ষণ কাঁদতে থাকল। এরপর তাকে জেলে নিয়ে চলে গেল। তার ছেলে মাঝে মাঝেই তার সাথে দেখা করতে যায়। সেদিনের সেই ঘটনা আমার সারা জীবন মনে থাকবে।
আল্লাহ হাফেজ।
46
View