Posts

উপন্যাস

আত্মা

August 30, 2025

Fijon Qurayish

Original Author ফিজন কোরাইশ

70
View

সূচনা – অভিশপ্ত গ্রাম

গ্রামটার নাম কাদামাটি পুর। গ্রামটি ছোট হলেও এর চারপাশে অদ্ভুত এক ভয় ঢেকে থাকে। দিনের বেলায় লোকজন শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করে, হাটবাজার বসে, গরু-ছাগল চরানো হয়। কিন্তু রাত নামলেই যেন অন্য এক পৃথিবী। চারদিক ঘন অন্ধকার, গাছপালার মধ্যে শোঁ শোঁ শব্দ, আর দূরে পেঁচার ডাক— গ্রামবাসী বিশ্বাস করে, এ শব্দগুলো কেবল প্রকৃতির নয়, এর ভেতরে আছে অশরীরী শক্তির উপস্থিতি।

গ্রামের শেষ প্রান্তে এক ভাঙা জমিদারবাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। দীর্ঘদিন ধরে পরিত্যক্ত। জানালার কাঁচ ভাঙা, দরজার কড়ি ছিঁড়ে গেছে, দেয়ালে লতাপাতা উঠে গেছে। লোকেরা বলে—
“ওই বাড়ি অভিশপ্ত, ওখানে এক আত্মা বন্দি।”

বৃদ্ধরা বলেন, বহু বছর আগে জমিদারের একমাত্র মেয়ে মারা গিয়েছিল অমানবিক অত্যাচারে। তার আত্মা শান্তি পায়নি, বরং সেই বাড়িতে ঘুরে বেড়ায়। লাল শাড়ি পরে সে রাতের বেলা বের হয়, করিডোরে হাঁটে আর মানুষের নাম ধরে ডাকে।

প্রথম অধ্যায় – সাহসী চার বন্ধু

এক গ্রীষ্মের রাতে গ্রামের চার তরুণ বন্ধু বসেছিল চায়ের দোকানে।
তাদের নাম—

রাকিব (সবচেয়ে সাহসী)

জুবায়ের (চঞ্চল, একটু গা-ছাড়া)

আরমান (ভীতু হলেও বন্ধুবান্ধবকে ছাড়ে না)

শুভ (তাদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট, কিন্তু অনেক কৌতূহলী)

শুভ বলল—
“শোনো, সবাই বলে জমিদারবাড়িতে ভূত আছে। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না।”

রাকিব হেসে বলল—
“আমিও বিশ্বাস করি না। ভয় দেখানোর জন্য এসব বানানো গল্প।”

জুবায়ের চায়ের কাপ নামিয়ে বলল—
“তাহলে আজ রাতে চল সবাই মিলে প্রমাণ করি! ঢুকে দেখি আসলেই কিছু আছে কি না।”

আরমান ভয় পেয়ে বলল—
“পাগল নাকি? মানুষ নাকি নিখোঁজ হয়ে গেছে ওখানে!”

রাকিব দৃঢ় কণ্ঠে বলল—
“আমরা চারজন একসাথে গেলে কিছু হবে না। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আজ রাতেই যাচ্ছি।”

বন্ধুরা সিদ্ধান্ত নিল। রাত বারোটার সময় তারা লণ্ঠন, টর্চলাইট, আর মোবাইল নিয়ে জমিদারবাড়িতে যাবে।

দ্বিতীয় অধ্যায় – জমিদারবাড়ির ভেতরে

রাত ঠিক বারোটায় তারা বাড়ির সামনে হাজির হলো। আকাশ কালো, মেঘে ঢেকে গেছে চাঁদ। কুকুরগুলো হঠাৎ হাউমাউ করে চিৎকার শুরু করল, যেন বুঝতে পেরেছে কেউ নিষিদ্ধ জায়গায় ঢুকতে যাচ্ছে।

বাড়ির বিশাল দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই চারদিকে এক ধরনের ঠাণ্ডা বাতাস লাগল।
মনে হলো, কেউ যেন শ্বাস নিয়ে তাদের গায়ের সব উষ্ণতা টেনে নিচ্ছে।

করিডোর লম্বা আর অন্ধকার। লণ্ঠনের আলো ম্লান হয়ে গেল, টর্চের আলোও যেন ভেতরে ঢুকতে পারছিল না।
মেঝেতে ধুলো, দেয়ালে মাকড়সার জাল, ছাদ থেকে ঝুলছে বাদুড়।

শুভ ফিসফিস করে বলল—
“এই জায়গাটা ঠিক লাগছে না রে…”

ঠিক তখনই হঠাৎ এক করুণ কান্নার শব্দ শোনা গেল।
চারজন থমকে দাঁড়াল।

তৃতীয় অধ্যায় – প্রথম সাক্ষাৎ

করিডোরের এক কোণায় লাল আলো জ্বলে উঠল। ধীরে ধীরে এক অবয়ব ভেসে এল।
সে লাল শাড়ি পরা এক তরুণী। চুল খোলা, মুখ সাদা, ঠোঁটে অদ্ভুত এক হাসি।
কিন্তু সবচেয়ে ভয়ের ছিল তার চোখ— দুটো লাল জ্বলন্ত অগ্নিশিখা।

সে ফিসফিস করে বলল—
“কেন এসেছো এখানে…? তোমরা কি মরতে এসেছো…?”

চারজন জমে গেল। শরীর কাঁপতে লাগল।
জুবায়ের সাহস করে বলল—
“তুমি কে?”

আত্মা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে কানে ফিসফিস করল—
“আমি এই বাড়ির মালকিন… আমার রক্তে ভিজেছে এই দেয়াল… তোমাদেরও চাই।”

হঠাৎ করিডোরের দেয়াল থেকে রক্ত ঝরতে লাগল।
মেঝে ভেসে গেল লাল রঙে।

চতুর্থ অধ্যায় – মৃত্যু শুরু

শুভ ভয়ে চিৎকার করে দৌড় দিল। কিন্তু আত্মা তার সামনে এসে দাঁড়াল।
তার লম্বা চুল হঠাৎ ছুঁড়ে দিল শুভর গলার চারপাশে, আর তাকে জাপটে ধরল।

শুভ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করল—
“বাঁচাও! আমি মরতে চাই না!”

তারপর তার গলা থেকে রক্ত ঝরে পড়ল।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে শুভ মাটিতে নিথর হয়ে পড়ল।

বাকি তিনজন আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে দৌড়ে পালাল।

পঞ্চম অধ্যায় – কঙ্কালের ঘর

তারা এক ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।
শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু ভেতরে ঢুকেই ভয় আরো বেড়ে গেল—
ঘরের ভেতর অসংখ্য কঙ্কাল পড়ে আছে!

কঙ্কালগুলো যেন হাসছে।
চোখের ফাঁকা গর্তে অদ্ভুত আলো জ্বলছে।

আরমান ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল—
“এরা কারা…?”

রাকিব গম্ভীরভাবে বলল—
“যারা এখানে ঢুকে আর বের হতে পারেনি।”

হঠাৎ কঙ্কালগুলো নড়তে শুরু করল। হাত-পা নাড়াতে লাগল।
তারা তিনজনের দিকে এগিয়ে এলো।

ষষ্ঠ অধ্যায় – আয়নার ফাঁদ

তারা দরজা ভেঙে পালাল। করিডোর তখন অদ্ভুতভাবে বদলে গেছে।
একটা বিশাল আয়না সামনে।

আরমান সেখানে গিয়ে নিজের প্রতিবিম্ব দেখল।
কিন্তু প্রতিবিম্বটা হঠাৎ হাসল, চোখ লাল হয়ে গেল, দাঁত বের করল।

তারপর প্রতিবিম্ব আয়না ভেদ করে বেরিয়ে এল।
সে আরমানকে ধরে টেনে নিয়ে গেল ভেতরে!

আরমান চিৎকার করছিল—
“বাঁচাও! আমাকে ছাড়ো!”

কিন্তু কয়েক সেকেন্ডেই সে অদৃশ্য হয়ে গেল। আয়নায় শুধু রক্ত ছিটকে পড়ল।

সপ্তম অধ্যায় – শেষ প্রতিশোধ

এবার শুধু রাকিব আর জুবায়ের বাকি।
জুবায়ের ভয়ে পাগলের মতো দৌড়াতে লাগল।
কিন্তু আত্মা তার সামনে এসে দাঁড়াল, তার বুকের ভেতর হাত ঢুকিয়ে হৃদপিণ্ড বের করে ফেলল!

জুবায়ের নিথর হয়ে মাটিতে পড়ে গেল।

এখন রাকিব একা।
সে সাহস করে একটা মোমবাতি জ্বালাল।
মোমের আলোয় আত্মার চেহারা স্পষ্ট দেখা গেল—
সে ছিল জমিদারের মেয়ে। তার বাবাই তাকে হত্যা করেছিল কারণ সে এক গরিব ছেলের প্রেমে পড়েছিল।

মৃত্যুর আগে সে প্রতিজ্ঞা করেছিল—
“আমি কারও সুখ হতে দেব না… আমার কষ্টের মতো কষ্ট সবার হবে।”

রাকিব কাঁপতে কাঁপতে বলল—
“তুমি ভুল করছো… আমাদের ছেড়ে দাও।”

কিন্তু আত্মা হাহাকার করে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
মোমবাতি নিভে গেল।
শুধু একটানা মানুষের চিৎকার ভেসে আসতে লাগল।

অষ্টম অধ্যায় – অভিশপ্ত ভোর

পরদিন সকালে গ্রামের লোকজন জমিদারবাড়ির সামনে এলো।
তারা দেখল—
দরজার সামনে শুভ, জুবায়ের, আর আরমানের কঙ্কাল পড়ে আছে।
তাদের শরীরে মাংস নেই, শুধু হাড়।

কিন্তু রাকিবের কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না।

লোকেরা বলে, রাকিব এখনও বেঁচে আছে— আত্মা তাকে নিজের সাথে বন্দি করে রেখেছে।
কখনও মাঝরাতে জমিদারবাড়ি থেকে তার কান্নার শব্দ পাওয়া যায়।

উপসংহার

এরপর থেকে কেউ আর সাহস করে জমিদারবাড়ির দিকে যায় না।
গ্রামবাসী রাতে ঘরের বাইরে বের হয় না।

তবে এখনো মাঝে মাঝে শোনা যায়—
লাল শাড়ি পরা মেয়েটি করিডোরে হাঁটছে, হেসে ডাকছে…

“আরো এসো… আমি একা নই… তোমাদেরও চাই…

Comments

    Please login to post comment. Login