পোস্টস

বিশ্ব সাহিত্য

'টাইপস অফ উইমেন': প্রাচীন গ্রিসের নারীবিদ্বেষের এক নির্মম দলিল

১ জুন ২০২৪

অরিত্র আহমেদ

মূল লেখক সেমোনিদেস অফ আমোরগস

অনুবাদক অরিত্র আহমেদ

[ অনুবাদকের ভূমিকা: প্রাচীন গ্রীসে নারীকে বলতে গেলে মানুষই মনে করা হতো না। এমনকি গণতান্ত্রিক এথেন্সেও নারীকে নাগরিকত্ব দেওয়া হতো না, তা সে নারী রূপেগুণে যতো শ্রেষ্ঠই হোক। নারীর এই হীন অবস্থার ঐতিহাসিক ও সাহিত্যিক দলিলের কোনো অভাব নেই, তবু খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকে সেমোনিদেসের লেখা ‘Types of Women’ নামক ব্যঙ্গ-কবিতায় যে তীব্র নারীবিদ্বেষ দেখা যায়, গ্রীক সাহিত্যে তার তুলনা খুঁজে পাওয়া সহজ নয়। বিশেষজ্ঞরা সেমোনিদেসের জীবন ও কর্ম সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতে পারেননি, তবে এটুকু নিশ্চিত করে বলা যায় যে খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকে প্রাচীন গ্রিসের আমোরগস দ্বীপে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং কাব্য রচনা করেছিলেন এলিজিয়াক ও ইয়াম্বিয়াক ধারায়। উল্লেখ্য যে, Types of Women হচ্ছে কালের গ্রাস থেকে রক্ষা পাওয়া দীর্ঘতম ইয়াম্বিক কবিতা।

এই কবিতায় সেমোনিদেস বলছেন, সৃষ্টির শুরুতে জিউস বিভিন্ন প্রকার নারী সৃষ্টি করেছিলেন, যাদের চরিত্র ও মনমর্জিও বিভিন্ন রকম। নারীকে তিনি তুলনা করেছেন শূকর, বানর, কুকুর, শিয়াল, মৌমাছি, বেজি প্রভৃতি প্রাণীর সঙ্গে, এবং কবিতার শেষের দিকে তিনি নারীকে ‘জিউসের সবচেয়ে বড়ো অভিশাপ' আখ্যা দিয়েছেন। সেমোনিদেসের বর্ণনা থেকে এই কবিতার মর্মার্থ স্পষ্ট হয়ে যায়: দেখতে মানুষের মতো হলেও নারীর আত্মা হলো পাশবিক, এবং তার আচার-আচরণও পশুর মতো। এই উপসংহার যে আগাগোড়া ভুল, এতে তো কোনো সন্দেহ নেই; কিন্তু প্রাচীন গ্রিক পুরুষতন্ত্রের এক নগ্ন রূপ আমরা এই কবিতায় দেখতে পাই। এ কারণেই ষষ্ঠ শতকে এথেন্সে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও নারীরা যে সেখানে নাগরিকই হতে পারলো না- এই তথ্য আমাদেরকে অবাক আর করবে না, যদি নারীদের পূর্বোক্ত অমর্যাদার কথা আমরা মাথায় রাখি। এইখানেই কবিতাটির গুরুত্ব। আধুনিক পণ্ডিত মহলে ‘Types of Women' কবিতা হিসেবে তেমন মর্যাদা লাভ করেনি, কারণ সাহিত্যিক কিংবা বুদ্ধিবৃত্তিক বিচারে এই কবিতার মূল্য খুবই নগণ্য। কিন্তু ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে যদি কবিতাটি পাঠ করি, তো আমরা হতাশ হবো না। নারীকে পশুর সঙ্গে তুলনা করার এই প্রবণতা অবশ্য আজকের যুগেও বহাল রয়েছে। পুরুষতন্ত্রের অস্তিত্ব যতোদিন থাকবে, ততোদিন এই প্রবণতার বিলুপ্তি আশা করা বাতুলতা মাত্র। 

 

বাঙালি পাঠকদের জন্য কবিতাটির গদ্য অনুবাদ এখানে উপস্থাপিত হলো। ]

 

 

বিভিন্ন প্রকার নারী 

 

 

সৃষ্টির শুরুতে দেবতারা বিভিন্ন উৎস থেকে বিভিন্ন প্রকার নারী তৈরী করলেন।

 

লোমশ শূকরী থেকে তারা তৈরী করলেন এক জাতের নারী৷ এই জাতীয় নারীর ঘর থাকে নোংরা, সবকিছু সেখানে কাদায় মাখামাখি হয়ে মেঝের উপর গড়াগড়ি খায়; আর সে নিজেও কখনো গোসল-টোসল কিছু করে না, পরিধান করে যতো সব নোংরা কাপড়, আর গোবরের গাদার সামনে বসে বসে মোটা ধুমসি হতে থাকে।

আরেক জাতের নারী দেবতারা তৈরী করলেন পাতিশিয়ালী থেকে। এই জাতীয় নারী হলো সবজান্তা, কোনো কিছুই তার চোখ এড়িয়ে যায় না। ভালো-মন্দ সবই সে খেয়াল করে, বিচার-বিবেচনা করে দেখে এবং অবশেষে ভালোকে মন্দ এবং মন্দকে ভালো বলে ঘোষণা করে। তার মেজাজ-মর্জির কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। এখন এক রকম, তো পরমুহূর্তেই সে আরেক রকম।

পাজি কুকুর থেকে তৈরী হলো আরেক জাতের নারী। মায়ের যোগ্য বেটী সে, তার ধান্ধা হলো সে সবকিছু শুনবে, সবকিছু জানবে, সব জায়গায় উঁকি মেরে বেড়াবে এবং সব জায়গায় নাক গলাবে। কাউকে দেখতে পাক না পাক, সে অমনি চিল্লাপাল্লা জুড়ে দেয়। কোনো ব্যাটালোকের পক্ষে সম্ভব নয় তার সেই চিল্লাপাল্লা থামানো। বকাঝকায় তো কোনো কাজ হয়ই না, এমনকি যদি কোনো ব্যাটালোক আর না পেরে ইট মেরে তার দাঁতও ভেঙে দেয়, তবু সে থামে না। কাজ হয় না মিষ্টি কথাতেও। এমনকি বাড়িতে কুটুম এলেও তাদের মধ্যে বসেই সে হৈ-হল্লা লাগিয়ে দেয়। তার গলাবাজি থামানোর সাধ্য দুনিয়ার কারো নেই।

অলিম্পুসের দেবতারা আরেক প্রকার নারী সৃষ্টি করলেন মাটি থেকে, যাকে পুরুষের পক্ষে এক আশীর্বাদই বলা যায়। এই জাতের নারী মাত্রই অবলা জানোয়ার, ভালো-মন্দ কিছুই সে জানে না, বোঝে না। একটা কাজই সে বোঝে, সে হলো বসে বসে খালি খাওয়া। সে এমনই অথর্ব যে এমনকি হাড়-কনকনে শীতের মধ্যেও পিঁড়িটা নিয়ে যে একটু আগুনের কোলে গিয়ে বসবে, এটুকুও সে পারে না।

আরেক জাতের নারীকে তৈরী করা হলো সাগর থেকে, তার দু’রকম মেজাজ। কখনো কখনো তাকে বড়ো প্রশান্ত ও প্রফুল্ল মনে হয়, কোনো আগন্তুক তখন তাকে দেখলে তার তারিফ করে বলে উঠবে, ‘এই নারীটিই হলো পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা এবং সবচেয়ে সুন্দর নারী। কিন্তু পরের দিনই দেখা যায় তার দিকে আর তাকানো যাচ্ছে না এবং তার ধারেও আর ঘেষা যাচ্ছে না। মা কুত্তা যেমন বাচ্চাদের সাথে করে থাকে, তেমনি এমনই এক হুঙ্কার দিয়ে সে তেড়ে আসে যে কেউ তার ধারে যেতে চায় না। বন্ধু-শত্রু নির্বিশেষে সবার সাথেই সে এরকম কুত্তার মতো ব্যবহার করে। গ্রীষ্মের মৌসুমে সাগর ঠিক এরকমই নিরীহ ও নিস্তব্ধ থাকে এবং নাবিকেরা তা দেখে বড়ো উৎফুল্ল হয়ে ওঠে; কিন্তু এই সাগরই আবার কখনো কখনো গর্জন করে ওঠে এবং তেড়ে আসে সুবিশাল ঢেউ সাথে করে। যে নারীর কথা বলা হচ্ছে, সে এই সাগরের মতোই; মহাসমুদ্রের মতোই তার মনমেজাজও চিরপরিবর্তমান।

ছাইরঙা গাধা থেকে তৈরী করা হলো আরেক জাতের নারী। সে শক্তের ভক্ত, ভালোমতো হুমকিধামকি ও প্যাদানি দিলে সে আর ঝামেলা করে না, অনিচ্ছা সত্ত্বেও সবকিছু মেনে নেয়। অতঃপর সে মুখ বুজে কাজ করে এবং সবকিছু ঠিকঠাকভাবেই করে। কিন্তু তারপর সে খালি খায় আর খায়, দিনে খায়, রাতে খায়, সামনে যা পায়, তা-ই খায়, ঘরে যা কিছু আছে, সব খায়। কামকেলির ব্যাপারেও তার একই মর্জি- সামনে যে ব্যাটালোককেই পায়, তার সঙ্গেই সে অমনি শুয়ে পড়ে। তার একজন হলেই হয়।

ঘৃণ্য ও হতভাগ্য বেজি থেকে দেবতারা তৈরী করলেন আরেক প্রজাতির নারী। এই নারীর মধ্যে সুন্দর বা কমনীয় কোনো কিছু নেই, সব দিক দিয়েই সে অবাঞ্ছনীয়। কামকেলির গন্ধ পেলেই সে পাগল হয়ে যায়, কিন্তু যে পুরুষই তার সঙ্গে বিছানায় যায়, তাকেই সে অসুস্থ করে ছাড়ে। প্রায়ই সে পাড়া-প্রতিবেশীদের ঘর থেকে চুরিচামারি করে এবং দেবতাদের উদ্দেশ্যে নিবেদিত খাদ্যখাবার সে চুরি করে খেয়ে ফেলে।

লম্বা কেশর-ওয়ালা ঘোড়া থেকে জন্ম নিলো আরেক জাতের নারী। এই জাতীয় নারী কোনো কাজই করে না। শ্রমসাধ্য যেকোনো কাজ সে এড়িয়ে চলে এবং অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়। চাল গুঁড়ো করার জাঁতা সে কখনো ছুঁয়েও দেখে না, চালুনিটা কখনো একবারের জন্যও হাতে নেয় না, এমনকি একদলা গোবর পর্যন্ত বাড়ির বাইরে ফেলে আসে না সে। উনুনের ধারেকাছেও তাকে কখনো দেখা যায় না, কারণ অতো ঝুলকালি কেইবা মাখতে চায়? কেবল কোনো প্রয়োজন পড়লেই সে তার স্বামীর কাছে যায়। দিনে দু’বার গোসল করে সে, কোনো কোনো দিন তিনবারও করে। আতর মেখে, মাথাভর্তি চুল চিরুনী করে এবং ফুলের মালা মাথায় দিয়ে ফুলবাবুটি সেজে সে বসে থাকে। এই জাতীয় নারী পরপুরুষের চোখে সুন্দর। কিন্তু স্বামীর কাছে সে একটা উপদ্রব ছাড়া কিছুই নয়, যদি না সেই স্বামী কোনো রাজা বা স্বৈরশাসক হয়ে থাকে (এমন কেউ, যার এই সমস্ত আড়ম্বর দেখতে ভালো লাগে)।

আরেক প্রজাতির নারী দেবতারা তৈরী করলেন বানর থেকে। পুরুষজাতির পক্ষে জিউস-প্রদত্ত সবচেয়ে বড়ো অভিশাপ হলো এরাই। এই জাতীয় নারীর চেহারা অত্যন্ত কদাকার, গঞ্জের পথ ধরে সে যখন হেঁটে যায়, তখন সবাই তাকে দেখে হাসাহাসি করে। তার ঘাড় খাটো এবং সে চলাফেরা করে বদখতভাবে। তার পাছা বলে কিছু নেই, আছে খালি দু’টো পা। যে হতভাগা ব্যাটালোক তাকে আদর-সোহাগ করে, তার কপালের কথা ভাবলে আসলেই দুঃখ হয়। বানরের মতোই সকল প্রকারের ছলাকলা তার জানা; লোকজন তাকে নিয়ে হাসাহাসি করলেও সে তা গায়ে লাগায় না; এবং কারো উপকার সে তো করেই না, বরং তার সারাটা দিনই কেটে যায় কারো না কারো যথাসাধ্য ক্ষতি করার মতলব ভাজতে ভাজতে।

মৌমাছি থেকে তৈরী হলো আরেক প্রজাতির নারী। যে পুরুষ তাকে পায়, তাকে ভাগ্যবানই বলতে হবে, কারণ নারীজাতির মধ্যে কেবল এই জাতের নারীরই তেমন কোনো দোষ চোখে পড়ে না। এই জাতীয় নারী যে সংসারে থাকে, সেই সংসারের সম্পদবৃদ্ধি হয়; তার স্বামী তাকে ভালোবাসে, সে-ও ভালোবাসে তার স্বামীকে, স্বামীর সঙ্গেই সে বুড়ো হয় এবং জন্ম দেয় রূপেগুণে শ্রেষ্ঠ সন্তান-সন্ততির। সে হয়ে ওঠে অনন্য এক নারী এবং এক ঐশী সৌন্দর্য তাকে সবসময় ঘিরে রাখে। অন্যান্য নারীরা কামকেলি নিয়ে কথা বলার জন্য যে আড্ডার আসর বসায়, ঘুণাক্ষরেও সে সেখানে যায় না। তার মতো রূপেগুণে সেরা ও বিচক্ষণ নারীরাই পুরুষজাতির পক্ষে জিউসের সবচেয়ে বড়ো আশীর্বাদ।

কিন্তু জিউসের মতলবটাই হলো এই যে, সকল প্রকার নারীই এই পৃথিবীতে থাকবে এবং পুরুষের পাশাপাশি বাস করে যাবে চিরকাল ধরে। হ্যাঁ, নারীই হলো জিউসের সবচেয়ে বড়ো অভিশাপ- যখন তাকে আপাতদৃষ্টিতে ভালো মনে হয়, তখনই সে আসলে সবচেয়ে খারাপ ও ক্ষতিকর। নারীর সঙ্গে থাকলে পুরুষ সারাদিনে এক মুহূর্তের জন্যও শান্তি পায় না; ঘরে কোনো নারী থাকলে পুরুষের পক্ষে ঘর থেকে ক্ষুধাকে তাড়ানো কঠিন হয়ে পড়ে, ঘরের শত্রু ও আমাদের প্রতিকূল দেবতা হয়ে ক্ষুধা ঘরেই বাস করতে থাকে। মানুষ কিংবা দেবতাদের দয়ায় ঋদ্ধ হয়ে ঠিক যে মুহূর্তে পুরুষ একটু আয়েশ করবে বলে ঠিক করে, অমনি তার বউ ছুটে এসে তার ভুল ধরা শুরু করে ও হুলস্থুল বাঁধায়। হ্যাঁ, ঘরে মেয়েমানুষ থাকলে বাড়িতে কুটুম এলেও তাকে ভালোমতো আপ্যায়ন করা সম্ভব হয় না; এবং যে মহিলাকে আপাতদৃষ্টিতে সবচেয়ে সম্মানীয়া বলে মনে হয়, সে-ই দেখা যায় সময়কালে সবচেয়ে বিপজ্জনক হয়ে ওঠে; হতভম্ব, প্রতারিত স্বামী যখন স্ত্রীর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে, তখন প্রতিবেশীরা তার করুণ অবস্থা দেখে হাসাহাসি করে। আমাদের স্বভাব হলো আমরা নিজের বউয়ের গুণগান করি আর অন্যের বউয়ের ঘাড়ে দুনিয়ার সব দোষ চাপিয়ে দিই- আমরা বুঝতে পারি না যে আমাদের সবার কপালই আসলে খারাপ। তবু যেহেতু জিউস নিজের হাতে সবচেয়ে বড়ো এই অভিশাপ সৃষ্টি করেছেন, এবং এমন এক বন্ধনে পুরুষকে তার সঙ্গে বেঁধেছেন, যে বন্ধন ছিন্ন করা অসম্ভব, সেহেতু অনেক পুরুষকেই দেখা যায় নারীকে বাঁচানোর জন্য পাতালের দ্বার পর্যন্ত ছুটে যেতে।