স্টেশন মাস্টার ম'সাহেব নিজ রুমে বসে আছেন৷ বাইরে ঝুম বৃষ্টি সাথে ঝড়ো হাওয়া বইছে৷ টিনের চালে তুমুল শব্দ হচ্ছে৷ ম'সাহেব ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন আকাশের কি অবস্থা দেখতে৷ দিন ছোট হওয়ায় সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে এসেছে। বৃষ্টির মতিগতি দেখে মনে মনে ভাবলেন আজ হয়তো বাসায় ফিরতে পারবেন না৷
স্টেশনটার নাম 'মালঞ্চি'! ব্রিটিশ আমলের তৈরি। লাল ইট, ওপরে টিনের ছাউনি। ইটের তৈরি প্ল্যাটফর্মটা বেশ নিচু এবং দৈঘ্যেও ছোটও বলা চলে। আশেপাশের স্টেশনে আধুনিকতার ছোয়া লাগলেও এই স্টেশনটা আগের মতই আছে! হয়তো ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন বহন করতেই! প্রায় পনেরোটা ট্রেন চলাচল করলেও থামে মাত্র একটা! তাও আবার লোকাল! অবশ্য স্টেশনের যে অবস্থা লোকাল ট্রেন থামে এইই অনেক। বাকিরা শুধু ছুটে যায় কোনদিন থামে না...
এক কোণায় ছোট্ট এক চায়ের দোকান, জবুথবু এক বুড়ো চালায়৷ স্টেশনের গাছের পাতা ডালপালা, লাইনে পড়ে থাকা কাগজই তার জ্বালানি! চায়ের স্বাদ বেশ তিতকুটে ও ধোঁয়াটে হলেও নিয়মকরে কখনো গাছের পাতার টুকরো, পিপড়া কাপে ভাসতেই থাকে৷ স্টেশনে লোকজনও তেমন আসে না, কিন্তু বুড়ো নিয়ম করে দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত চায়ের দোকানে রোজ আসলেও আজ আসেনি।

ম'সাহেব ফিরে দেখলেন মেঝেতে বেশ পানি জমে গিয়েছে! টিনের ছাউনিটার যায়গায় যায়গায় ফুটো হয়ে পানি পড়ছে। জরুরি ফাইলগুলো সরিয়ে রাখলেন। অবশ্য সেখানেও পানি পড়ছে তবে একটু কম। বরাদ্দ না থাকায় কিছুদিন আগে নিজেই বেতনের ক'টা টাকা বাঁচিয়ে মেরামত করিয়েছিলেন৷ মিস্ত্রিও বিরক্ত হয়ে বলে গিয়েছে সবগুলো টিন পাল্টাতে হবে, এই জিনিস ঠিক করতে সে আর আসতে পারবে না। এই জরাজীর্ণ স্টেশনেই ম'সাহেবের প্রায় দশ বছর কেটে গিয়েছে৷ প্রথমদিকে বদলির যে চেষ্টা করেননি তা না, একসময় হাল ছেড়ে এখানেই থেকে গিয়েছেন৷
বেশ অনেকটা সময় কেটে গিয়েছে৷ হঠাৎ টুং করে ব্লক মেশিনে শব্দ হলো ! পাশের স্টেশন থেকে সংকেত এসেছে! ব্লকের নীচের দিকে পিতলের তৈরি মাথাটা চাপ দিয়ে ভেতরে ঠেলে দিয়ে লিভারটা ঘোরালেন। টুপ করে একটা পিতলের ফাঁপা বল বেরিয়ে এলো৷ ট্রেন আসবে। নামটা সুন্দর, "সীমান্ত এক্সপ্রেস"! প্রচন্ড গতি নিয়ে চিলাহাটি-খুলনা ছুটে চলে। রাত প্রায় পৌনে এগারোটা বাজে! স্টেশনমাস্টার হারিকেন সর্দৃশ সিগন্যাল জ্বালালেন, একপাশে সবুজ রং একপাশে লাল রংয়ের কাঁচ থাকায় দুই পাশে দুই রকম রং দেখা যায়৷ এক হাতে সেই হারিকেনের সবুজ দিকে ট্রেনের দিকে তাক করে, আরেক হাতে ছাতা মাথায় তিনি প্ল্যাটফর্মে বৃষ্টির মাঝে দাঁড়িয়ে রইলেন, থেমে থেমে বৃষ্টির ঝাপটা তার গায়ে লাগছে৷ স্টেশনের এক মাথায় আলোটা ধীরে ধীরে উজ্জ্বল ও বড় হচ্ছে। ট্রেন আসার আগে লাইনে একটা বিদ্যুৎ চমকানোর মতো শিহরণ জাগানো শব্দ হয়, শব্দটা ম'সাহেবের বেশ ভালো লাগে। ঝড়ো গতিতে ট্রেনটা চলে গেলো। ঠিক তখনই দক্ষিণ পাশের অন্ধকারে চোখে পড়ল একটা ছোট্ট ছায়া। মনে হলো, ভিজে কুঁকড়ে থাকা এক ছেলে। ট্রেন চলে যেতেই আলো মিলিয়ে গেল—এখন আর কিছু দেখা যায় না। ট্রেন যাওয়ার সময় একটু আলোতে যা দেখেছিলেন এখন তাও দেখা যাচ্ছে না। আশেপাশে বাড়িঘরও নেই বললে চলে। তিনি এগিয়ে যাবেন কি না ভাবতে ভাবতে এগিয়ে গেলেন৷ কিন্তু প্রচন্ড বৃষ্টিতে পিচ্ছিল হয়ে যাওয়াটা প্ল্যাটফর্ম থেকে লাইনে নামতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলেন! প্রচন্ড ব্যাথায় কুকড়ে গেলেন অথচ নড়ার শক্তিটাও পাচ্ছেন না৷
বৃষ্টির শব্দের ভেতরেও মনে হচ্ছিল—কেউ যেন কাছাকাছি দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে।
কিন্তু কে? সেই ছেলেটা… নাকি আর কেউ?