অধ্যায় ৪
পাঁচ টাকার নোটে লেখা ভালো বন্ধু চাই
বিকেলের হালকা রোদে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসটা যেন অন্যরকম লাগে। ছায়াঘেরা মাঠের কোণে বসে হাসিব এক হাতে চা, আরেক হাতে মোবাইল নিয়ে বসে আছে। ফোনের স্ক্রিনে মেসেঞ্জারের নীল আলো জ্বলছে—ওই নীল আলোতেই তার মন জড়িয়ে আছে গত কয়েক মাস ধরে।
—"হ্যালো, তুমি কি আজ আসবে?"
মেসেজ পাঠানোর সঙ্গে সঙ্গেই হাসিবের বুক ধড়ফড় করতে লাগল।
কিছুক্ষণ পর রিপ্লাই এলো,
—"হ্যাঁ, আজ তোমার সাথে দেখা করার ইচ্ছে আছে।"
সেই ছোট্ট রিপ্লাই-টা হাসিবের ভেতরে হাজারটা আতশবাজি ফোটাল। যে মেয়েটির সাথে প্রথম পরিচয় হয়েছিল পাঁচ টাকার এক নোটে লেখা "ভালো বন্ধু চাই" বাক্য দিয়ে—আজ সে-ই মেয়েটি প্রথমবারের মতো দেখা করার জন্য রাজি হয়েছে।
সন্ধ্যা নামতে না নামতেই শহরের ব্যস্ত মোড়ে হাসিব দাঁড়িয়ে ছিল। রাস্তার আলো তখন জ্বলে উঠেছে, চারপাশে মানুষের ভিড়, গাড়ির হর্ন—সব কিছুর মাঝেও হাসিবের চোখ কেবল একটিই খুঁজছিল।
হঠাৎ ভিড়ের ফাঁক থেকে লাল ওড়না উড়তে উড়তে বেরিয়ে এলো মেয়েটি। বুকের ভেতরটা হঠাৎ থমকে গেল হাসিবের।
—"তুমি… আফরিন?"
মেয়েটি হেসে মাথা নেড়ে বলল,
—"হ্যাঁ, আমি-ই তো। তুমি হাসিব, তাই না?"
কথাগুলো এত সহজভাবে বলল, কিন্তু সেই স্বাভাবিক কথার আড়ালেই ছিল এক অদ্ভুত কাঁপুনি। দুজনেই যেন অনেকদিন ধরে একে অপরকে চেনে, অথচ এটাই তাদের প্রথম দেখা।
কাছের এক কফিশপে বসে গেল তারা। জানালার পাশে টেবিলটা পেয়েই যেন দুনিয়ার সবচেয়ে নিরিবিলি জায়গা মিলল।
—"তুমি আসলে নোটে নাম্বার কেন লিখেছিলে?"
হাসিব কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করল।
আফরিন একটু চুপ করে থেকে বলল,
—"জানো, আমি খুব একা ছিলাম। মনে হচ্ছিল জীবনে কাউকে দরকার, যে অন্তত আমাকে শুনবে। বন্ধু খুঁজছিলাম। তাই হয়তো ওই নোটে লিখেছিলাম।"
হাসিব হেসে ফেলল,
—"তাহলে ভাগ্যই আমাদের এক করেছে। আমি সেই নোটটা না পেলে হয়তো আজকের এই দেখা হতো না।"
আফরিন নিচু স্বরে বলল,
—"হয়তো। তবে জানো, ভয়ও পাচ্ছিলাম। যদি ভুল মানুষ পাই? যদি কেউ আমার সরলতাকে খারাপভাবে নেয়?"
—"আর আমি তো প্রমাণ দিলাম, আমি খারাপ না।"
হাসিব মজা করে বলল।
দুজনেই হেসে উঠল। সেই হাসির ভেতরে জমে উঠল এক অদ্ভুত স্বস্তি।
সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হলো। বিদায়ের আগে আফরিন ধীরে বলল,
—"হাসিব, তুমি কি শুধু বন্ধু থাকবে?"
প্রশ্নটা শুনে হাসিব অবাক হয়ে গেল।
—"মানে?"
—"মানে, তুমি কি কখনো আমার বন্ধুত্বের বাইরে কিছু চাইবে?"
হাসিব চোখ মেলে তাকাল মেয়েটির দিকে। চারপাশের কোলাহল মিলিয়ে গিয়ে মনে হলো সময় থেমে গেছে।
সে ধীরে বলল,
—"আজকে কিছু বলব না। তবে একটা কথা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি—যতদিন তুমি আমাকে বন্ধু ভাববে, আমি ততদিন তোমার পাশে থাকব।"
আফরিনের চোখে এক ঝিলিক খেলে গেল। বিদায়ের সময় হাত মেলাল তারা। সেই হাত মেলানো যেন এক নতুন গল্পের শুরু হয়ে থাকল।