গ্রিক পণ্ডিত মহামতি প্লেটো প্রাথমিক শিক্ষায় সঙ্গীতের গুরুত্ব নিয়ে যথেষ্ট গভীরভাবে লিখেছেন, বিশেষত তাঁর Republic (রাষ্ট্র) এবং Laws (আইন) গ্রন্থে। শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষায় সঙ্গীত সম্পর্কে তাঁর অভিমত মূলত এভাবে সংক্ষেপ করা যায়—
• শৈশবেই সঙ্গীত শিক্ষা শুরু হওয়া উচিত
প্লেটো মনে করতেন, ছোটবেলাতেই (প্রাথমিক পর্যায়ে) শিশুদের মনে যে ছাপ পড়ে, তা স্থায়ী হয়। তাই সঙ্গীতের মাধ্যমে তাদের চরিত্র, নৈতিকতা ও আত্মার বিকাশ ঘটানো সম্ভব।
• সঙ্গীত আত্মাকে গঠন করে
প্লেটোর মতে, সঙ্গীত কেবল বিনোদন নয়; এটি মানুষের আত্মা ও মননের গঠনমূলক শিক্ষা। সঙ্গীত শিশুদের মধ্যে শৃঙ্খলা, সৌন্দর্যবোধ ও সাদৃশ্য (harmony) তৈরি করে।
• নৈতিক শিক্ষা ও আবেগ নিয়ন্ত্রণ
তিনি বলেছিলেন, সঙ্গীত শিশুদের আবেগ ও নৈতিকতার সঙ্গে যুক্ত। সঠিক রকমের সঙ্গীত শিশুদের মধ্যে সাহস, সংযম ও ন্যায়বোধ গড়ে তোলে। ভুল ধরনের সঙ্গীত তাদের চরিত্র নষ্ট করতে পারে। তাই রাষ্ট্রকেও নজর রাখতে হবে কোন ধরণের সঙ্গীত শেখানো হচ্ছে।
• শরীর ও মনের ভারসাম্য
প্লেটো বলতেন, শরীর গড়ার জন্য যেমন ব্যায়াম জরুরি, তেমনি মন ও আত্মাকে গড়ার জন্য সঙ্গীত জরুরি। তাই প্রাথমিক শিক্ষায় জিমন্যাস্টিকস (শারীরিক শিক্ষা) আর মিউজিক (সঙ্গীত শিক্ষা) সমানভাবে প্রয়োজন।
সারকথা, প্লেটোর মতে প্রাথমিক শিক্ষায় সঙ্গীত শেখানো অত্যন্ত জরুরি, কারণ এটি শিশুর চরিত্র, নৈতিকতা, আবেগ ও আত্মাকে সঠিক পথে পরিচালিত করে এবং শারীরিক শিক্ষার সঙ্গে মিলে পূর্ণাঙ্গ মানুষ তৈরি করে।
প্লেটোর শিষ্য মহামতি এরিস্টটল প্রাথমিক শিক্ষায় সঙ্গীতের ভূমিকা সম্পর্কে যথেষ্ট স্পষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিয়েছেন। তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ Politics (Book VIII)-এ তিনি শিশুদের শিক্ষার বিষয়টি আলোচনা করতে গিয়ে চারটি প্রধান বিষয়কে প্রাথমিক শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে মত দেন—
১. পঠন-পাঠন (literacy/letters)
২. ব্যায়াম (gymnastics)
৩. অঙ্কন (drawing)
৪. সঙ্গীত (music)
এরিস্টটলের মতে:
• সঙ্গীত কেবল বিনোদনের জন্য নয়; বরং এটি চরিত্র গঠন ও নৈতিক উন্নতিতে ভূমিকা রাখে। তিনি বিশ্বাস করতেন, সঙ্গীত মানুষের আবেগকে প্রভাবিত করে এবং শৃঙ্খলিত আবেগ গঠনে সহায়ক।
• বিনোদন ও অবসর শিক্ষার অংশ হিসেবেও সঙ্গীত গুরুত্বপূর্ণ। প্রাচীন গ্রীসে অবসর (leisure)কে উচ্চমূল্য দেওয়া হতো, আর এরিস্টটলের মতে, সঙ্গীত সেই অবসরকে উৎকর্ষ করে ও মানুষের মনের উন্নয়ন ঘটায়।
• তিনি বিশেষভাবে সতর্ক করেছিলেন যে, প্রাথমিক স্তরে শিশুদের সঙ্গীত শিক্ষা অতিরিক্ত কারিগরি প্রশিক্ষণমূলক হওয়া উচিত নয়, কারণ এতে তাদের পেশাদার সঙ্গীতশিল্পী হয়ে ওঠার ঝুঁকি থাকে। তাঁর মতে, সঙ্গীত শিক্ষা হওয়া উচিত চরিত্র গঠন ও সৌন্দর্যবোধ জাগ্রত করার জন্য, পেশাদার দক্ষতার জন্য নয়।
• এরিস্টটল বলেছিলেন, শিশুদের যে রকম সঙ্গীত শেখানো হবে, তা যেন নৈতিকভাবে উৎকৃষ্ট হয়, কারণ সঙ্গীত মানুষের মানসিক অভ্যাসকে গঠন করে।
সংক্ষেপে, এরিস্টটলের মতে প্রাথমিক শিক্ষায় সঙ্গীত রাখা জরুরি, তবে তা কেবল বিনোদনের জন্য নয়; বরং শিশুর নৈতিকতা, আবেগ নিয়ন্ত্রণ, রুচিবোধ ও চরিত্র গঠনের উদ্দেশ্যে।
প্লেটো ও এরিস্টটল দুজনেই শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষায় সঙ্গীতের গুরুত্ব স্বীকার করেছেন, তবে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিতে সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। প্লেটো সঙ্গীতকে মূলত নৈতিকতা ও আত্মার গঠনের হাতিয়ার মনে করতেন; তাঁর মতে সঠিক সঙ্গীত শিশুদের চরিত্রকে সুশৃঙ্খল ও ন্যায়পরায়ণ করে, আর ভুল সঙ্গীত নষ্ট করে—তাই রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে “ভালো” সঙ্গীত শেখানো জরুরি। অপরদিকে এরিস্টটল নৈতিকতার পাশাপাশি সঙ্গীতের ব্যবহারিক ভূমিকা যেমন বিনোদন, মানসিক স্বস্তি ও আবেগ নিয়ন্ত্রণের দিকটি জোর দিয়ে তুলে ধরেন; তবে তিনি সতর্ক করেন যে অতিরিক্ত সঙ্গীতচর্চা ক্ষতিকর হতে পারে, তাই প্রাথমিক শিক্ষায় এর প্রয়োজন সীমিত ও সুশৃঙ্খলভাবে হওয়া উচিত।
মোদ্দাকথা হলো শিশুদের জন্য সঙ্গীত চর্চা জরুরি।
আপনি হয়ত মনে করছেন সঙ্গীত বাদ দিয়ে একমাত্র ধর্মশিক্ষা পেলেই শিশুরা সর্বজ্ঞানে বিশারদ হয়ে উঠবে। এমনটা নাও হতে পারে। এবং হবে না যে, এর সবিশেষ উদাহরণ হলো বাংলাদেশ। এখানে ধর্মশিক্ষার এতটুকু খামতি কোথাও নাই। কিন্তু অরাজকতারও শেষ নেই।
অন্তর্বর্তী সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সঙ্গীত শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এটা খুবই যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত। কিন্তু অনেক ধর্মগুরু প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছেন। আমরা মনে করি স্কুলগুলোতে সঙ্গীত নয় শুধু, থিয়েটার, নৃত্য ও চারুকলা শিক্ষকও নিয়োগ দেয়া উচিত। শিশুর মধ্যে যদি সুকুমার বৃত্তি চর্চা জাগিয়ে দেয়া না হয়, কেবলমাত্র একটি বিশেষ ধর্মীয় শিক্ষা পাওয়া শিশুটি চরম সাম্প্রদায়িক, গোঁড়া, অসহনশীল এবং অসংবেদনশীল হয়ে গড়ে উঠতে পারে। সেটি হলে কোনো দেশের জন্যই সেটা মঙ্গলজনক হবে না।
সঙ্গীত ও সুর ছাড়া পৃথিবীর কোনো দেশই চলে না। জাতীয় সঙ্গীত সবারই আছে। রাষ্ট্র জাতীয় কবিও লালন করে। এই কবিদের অন্যতম প্রধান চর্চার জায়গাটি হলো গীতিকবিতা। সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও প্রতিরক্ষা সক্ষমতার জন্য প্রতিটি দেশেই সশস্ত্র বাহিনী কিংবা অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষায় পুলিশ বা অন্যান্য অসামরিক ও আধাসামরিক বাহিনী আছে। মিউজিক ছাড়া সেসব বাহিনীর সুশৃঙ্খল প্যারেড, ড্রিল বা কুচকাওয়াজ কিছুই হবেই না।
লেখক: সাংবাদিক
৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫