ট্রয়নগরীর ধ্বংস তথা Trojan Destruction মূলত গ্রিক পুরাণের ঘটনা, যা হোমারের মহাকাব্য ইলিয়াড এবং পরবর্তী নানা কাব্য-পুরাণে এসেছে। ঐতিহাসিকভাবে ট্রয় নগরী (বর্তমান তুরস্কের হিসারলিক অঞ্চলে) খ্রিস্টপূর্ব প্রায় ১২শ শতকে ধ্বংস হয়েছিল বলে প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ মেলে।
পুরাণকথায় ট্রয়নগরীর ধ্বংস যেন এক নারীর সৌন্দর্যের শপথে রচিত ট্র্যাজেডি। ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিস যখন স্পার্টার রাজা মেনেলাউসের স্ত্রী হেলেনকে অপহরণ করে নিয়ে আসে, তখনই দেবতাদের অভিশাপ ও মানুষের হিংসা মিলে যুদ্ধের আগুন জ্বলে ওঠে। সোনার আপেলের বিতর্কে প্যারিস আফ্রোদিতির পক্ষে রায় দেওয়ায় হেরা ও এথেনার ক্রোধ ট্রয়ের উপর নেমে আসে। দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী লড়াই শেষে গ্রিকদের কৌশল 'ট্রোজান হর্সের ফাঁদ' ট্রয়ের নগরদ্বার ভেদ করে। রাতের আঁধারে আগুনে নিশ্চিহ্ন হয় প্রাচ্যের এক গৌরবময় নগরী। ইতিহাস ও পুরাণ তাই আজও সাক্ষী, এক নারীর জন্য প্যারিসের দুঃসাহসী প্রেমই ট্রয়নগরীর চূড়ান্ত ধ্বংসের কারণ হয়েছিল।
আমাদের কালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের এক নারী শিক্ষার্থীর আবাসস্থল জোবরা গ্রামে মাঝরাতে ঘরে ফেরাকে কেন্দ্র করে গ্রামবাসী ও চবিয়ানদের মধ্যে ব্যাপক সং'ঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ল। জানা গেলো জোবরার দারোয়ান চবির ছাত্রীকে অপমান করেছে, যেটি সইতে পারেনি তাঁর সতীর্থরা। প্রতিশোধ নিতে গেছে সবাই। ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। একেবারে যাকে বলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লোমহর্ষক ল'ড়াই। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পুলিশ ডেকেও সময়মতো পায় নাই। এই সুযোগে বেপরোয়া জোবরা গ্রামবাসী দেশিয় অ'স্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে শিক্ষার্থীদের অহমে প্রাণঘাতি আ'ঘাত করেছে। প্রকারন্তরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০ শিক্ষার্থী মারাত্মক জখম। বেশ কয়েকজন আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য অধ্যাপক কামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেছেন, 'আমাদের নিরীহ শিক্ষার্থীরা এলাকার সন্ত্রাসীদের দ্বারা আহত হয়েছেন। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীর পাশে রয়েছে। পুলিশ প্রশাসন থেকে যে পরিমাণ সহায়তা পাওয়ার কথা, সেটি পাইনি। আগে বিশ্ববিদ্যালয় শত শত পুলিশ থাকত, সব জায়গায় পুলিশের পাহারা থাকত, জল কেমন থাকত, বিশ্ববিদ্যালয় বলার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ আসত। কিন্তু এখন পুলিশ বলে, সরি, তারা আসতে পারবে না!'
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার বলেছেন, আগের রাতে পুলিশের দুটি গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। এ কারণে সাদা পোশাকে ছিলেন পুলিশ সদস্যরা।
ওদিকে গতকাল রোববার সচিবালের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত কোর কমিটির সভায় রাষ্ট্রীয় বাহিনীর একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, 'দাবি আদায়ের রাস্তা অবরোধ, মব সন্ত্রাস এবং দুই পক্ষের পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও আক্রমণের শিকার হয়, সে খবর গণমাধ্যমে আসে না।
সভায় এক কর্মকর্তা বলেন, বিদেশে বসে কেউ কেউ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়ে ধারাবাহিকভাবে উসকানিমূলক বক্তব্য দিচ্ছেন। রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে হেয় করা হচ্ছে। দেশীয় ইউটিউব চ্যানেলেও রাষ্ট্রের বাহিনীকে নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এ বিষয়ে সরকারের করণীয় নির্ধারণ করা উচিত বলে মত দেন তাঁরা।
গেল বছর ৫ আগস্টের আগের দুই সপ্তাহ অধিকার আদায়ে সংক্ষুব্ধ ছাত্রদের মনোভঙ্গি দেখেছে বাংলাদেশের পুলিশ। প্রাণ হারিয়েছেন অনেকেই। ওই পুলিশ এখন আর ক্যাম্পাসমুখো হতে চায় না। এককথায় বিগত রেজিমের বেপরোয়া পুলিশের খেসারত দিতে হয় এখনকার পুলিশকে। আর আমরা আহাজারি করে মরছি পুলিশকে সক্রিয় না করতে পারায় 'মব ভায়োলেন্সে'র বাড়াবাড়িতে। এইদেশে এখন যেন সবাই রাজা। সবার হাতে মা'রণাস্ত্র।
সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য উদ্ভুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে, 'ক্যাম্পাসে দফায় দফায় সংঘর্ষে শিক্ষক-শিক্ষার্থী র'ক্তাক্ত হচ্ছেন, ধানক্ষেতে শিক্ষার্থীদের কু'পিয়ে আহত করার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। অথচ এই পরিস্থিতির মধ্যেও রোববার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইয়াহইয়া আখতার নিয়োগ বোর্ডের পরীক্ষা চালিয়ে গেছেন। এমনকি সকালে সেনাদের টিমও ওনার পরামর্শে ক্যাম্পাস ছাড়েন।' শিক্ষার্থীদের অভিভাবক হিসেবে এমন অমানবিক ও অসংবেদনশীল উপাচার্য থাকা না থাকায় কোনো ম্যাটার করে না আসলে।
এমন অরাজক পরিস্থিতিতে যেকোনো সহিংসতার সূত্রপাতটা অঙ্কুরে থামিয়ে দেয়ার কোনো বিকল্প নেই। একবার ভাবুন তো চবির দর্শন বিভাগের ওই শিক্ষার্থী যদি হেলেন হয়ে না উঠতেন, তাহলে কি আমাদের ঘরের কাছের চট্টগ্রামে এমনতর Destructed ট্রয়নগরী দেখতে হয়?
লেখক: সাংবাদিক
১ সেপ্টেম্বর ২০২৫