Posts

চিন্তা

প্রাকৃতিক পাথরের বাস্তুতন্ত্রে তস্করের হানা

September 3, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

143
View



এটি একটি খুবই প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন যে, হতে পারে পৃথিবী নামের গ্রহে সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী মানুষ, তাই বলে এই মনুষ্য প্রজাতি কি প্রকৃতি সাজিয়ে তুলতে পারে? এক কথায় উত্তর হলো না। প্রকৃতির সন্তান মানুষের পক্ষে তাঁর স্রষ্টার প্রকৌশলে হাত দেয়ার এতটুকু এখতিয়ার নেই। বরং মহামহিম প্রকৃতিকে বিরক্ত করলে মানুষ নামের ক্ষুদ্র প্রাণীকে ওই প্রকৃতি নিমিষে ধূলায় মিশিয়ে দিতে পারে। 

সিলেটের ভোলাগঞ্জের প্রাকৃতিক সাদা পাথর হাজার বছরে সৃষ্ট প্রকৃতির সুন্দরতম অংশ। আর আমরা মানুষ ওই সুন্দরেরে কেবল ঈর্ষা করতে পারি। ধ্বংস করবার ন্যূনতম অভিপ্রায় আমাদের মনুষ্যত্বের পতনকেই কেবল ত্বরান্বিত করতে পারে। 

বাংলাদেশের রাজনীতিতে পাথরে বুক বেধে মেনে নেয়ার গল্প আমরা শুনেছি। ওই বুক বেধে রাখবার পাথরও যখন বাচ্চাকাচ্চাসমেত লুট হয়ে যায় তখন মেনে নেয়ার শেষ প্রদীপটিও যেন ধপ করে নিভে যায়। অতঃপর চারিধারে ঘণায়মান অন্ধকার। সুড়ঙ্গের শেষ প্রান্তে নিভু নিভু আলোটিও আর দেখা যায় না। নিকষকালো অমাবশ্যা ভরা পূর্ণিমাকেও ভ্রুকুটি করে, "তোমাদের সবাইকে অন্ধকারের নিমজ্জনে ডুবিয়ে মারব।" 

এমনিতে সাপে নেউলে সম্পর্ক, তবে বাংলাদেশে একটা ইস্যুতে সম্প্রতি বিএনপি-জামায়াত-এনসিপি এক কাতারে এসেছিল। প্রমাণ পাওয়া গেছে ঐ ঐক্যে পতিত আওয়ামী লীগের লোকজনও ছিল। ৪২ জন বিভিন্ন স্তরের রাজনীতিবিদের সাথে পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসনের লোকজনও জড়িত ছিল এবং বিজিবির নিষ্ক্রিয়তা ছিল এটাও খোলাসা হয়েছে। সেটি হলো সিলেটের ভোলাগঞ্জের সাদাপাথর লুট! সরকার অনেকের বদলির সাথে সিলেটের জেলা প্রশাসকও বদলে নিয়েছে। কিন্তু ভোলাগঞ্জের খোয়া যাওয়া সাদা পাথরের খুব সামান্য অংশই পূর্বের জায়গায় ফেরত এসেছে। 

লুট হয়ে যাওয়া এই পাথর নিয়ে সরকারের তরফে ব্যাপক তৎপরতা, তদন্ত কমিটি গঠন ও নানামুখী নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। সিআইডি, দুদক ও মন্ত্রণালয় একযোগে কাজ করছে। কিন্তু চাইলেই কি ভাঙা কাঁচ জোড়া লাগে? কখনোই না। 

আমরা প্রায়ই শুনি পাহাড় কেটে বসতি গড়া হচ্ছে, নদী দখল করে কারখানা বানানো হচ্ছে। এবার দেখলাম পাহাড় বিধৌত পাথর চুরি করে মানুষ তার নিজেকে ধ্বংস করবার সৌধ বানাচ্ছে। জনতার আদালতে ধরা খাওয়ার পর ওই পাথর স্বস্থানে ফেরত দেয়ার বিনিময়ে চোরেরা দায়মুক্তি পাচ্ছে! বোধের কী বিস্ময়কর অবনমন আমাদের? যারা পরিবেশ ও প্রতিবেশ ধ্বংস করল, তাদেরকে পাকড়াও না করে নাটকীয় বাহানায় দায়মুক্তি দেয়া হচ্ছে। আমরা যারা পরিবেশ সচেতন তারা এই ঘটনাকে স্রেফ নাটকই বলব। বাস্তবে পৃথিবীজুড়ে কোথাও এমন কাজ হয় কিনা বিস্তর সন্দেহ রয়েছে। 

সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি থেকে বেআইনিভাবে সাদাপাথর উত্তোলন ও অপসারণের ফলে সৃষ্ট প্রতিবেশগত ও পরিবেশগত আর্থিক ক্ষতি টাকায় নিরূপনে ২১ আগস্ট একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে সরকার। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে (অপারেশন) আহ্বায়ক করে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক অধ্যাপকসহ ছয় সদস্যবিশিষ্ট কমিটিকে আর্থিক ক্ষতি নিরূপন করে আগামী ২১ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদন দিতে বলা হয়। ওসব প্রতিবেদন সময়মতো বের হওয়ার ব্যাপারে আমাদের বিরাট সন্দেহ ও সংশয় আছে। ওই কমিটিতে পরিবেশ বিশারদ কয়জন আছেন? যদি থেকে তারা কি বলেছেন, পাথরকে তার স্থানচ্যুত করে দিয়ে পুনরায় যত্রতত্র ছুঁড়ে ফেললেই ভঙ্গুর প্রকৃতির পুনর্গঠন হয়? আমরা মনে করে হয় না। সাদা পাথরের বাস্তুতন্ত্র একদিনে গড়ে উঠেনি যে, আপনি চাইলেন ভেঙে দিলেন আর মনপছন্দ মতো গড়ে দিয়ে আসলেন। এর সময়, প্রক্রিয়া ও জীব বা জীবাস্মের আন্তসম্পর্কের গভীর সমন্বয় জরুরি। 

হাজার বছরের সময়ের পরিক্রমায় পাহাড়ের গা থেকে পাথর ধীরে ধীরে ভেঙে যায়। গরম বা ঠান্ডার প্রভাব, বৃষ্টির পানি, হিমবাহ বা বাতাসের চাপে বড় বড় শিলার টুকরো ছোট হয়ে যায়। যখন বৃষ্টি বেশি হয় বা মাটির ভেতরে পানি জমে যায়, তখন ঢাল বেয়ে পাথরগুলো গড়িয়ে নামে। একে ভূমিধস বা ল্যান্ডস্লাইডও বলা হয়। 

পাহাড় থেকে গড়িয়ে আসা পাথর ছোট ছোট খালে ও ঝরনায় পড়ে। সেখান থেকে বৃষ্টির পানির প্রবল স্রোতে এগুলো ধুয়ে নিচে নেমে আসে। দীর্ঘ যাত্রায় নদীর পানির স্রোতে ও পাথর-পাথরের ঘর্ষণে এগুলো মসৃণ হয়, আকারে ছোট হয় এবং নদীর তলায় বা পাড়ে জমে। 

স্রোতের গতি কমে গেলে (যেমন নদীর বাঁক, মোহনা বা সমতল অঞ্চলে) পাথর আর এগোতে পারে না। তখন সেগুলো নদীর পাড়ে বা তলদেশে স্তরে স্তরে বিছিয়ে যায়।
বস্তুত আবহাওয়া, ভূমিধস ও নদীর স্রোত -এই তিন প্রক্রিয়া মিলে পাথরকে পাহাড় থেকে নদীর তীরে এনে বিছিয়ে দেয়। 

এই পাথর যদি কেউ সরিয়ে নিয়ে পুনরায় সেখানে ফেলে, তাহলে আগের প্রতিবেশ কি ফিরতে পারে? না, অবশ্যই পারে না। প্রাকৃতিক প্রতিবেশ বিনষ্ট করে তা গড়বার ক্ষমতা অক্ষম মানুষের নেই। 
 

ভোলাগঞ্জ, জাফলং কিংবা বিছানাকান্দি -পাথরগুলো সেখানে এসেছে হাজার হাজার বছরের আবহাওয়াজনিত ক্ষয়, ভূমিধস, পানির স্রোত ও প্রাকৃতিক ছাঁকন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। মানুষ যদি একই পাথর আবার ফেলে দেয়, তাতে সেই দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ক্রমবিকাশ কখনোই ফেরানো যায় না। 

প্রাকৃতিকভাবে নদীর পাড়ে পাথর স্তরে স্তরে, আকার অনুসারে সাজানো থাকে -বড় পাথর নিচে, ছোট পাথর ওপরে। এটা স্রোতের শক্তি, প্রবাহদিক, মৌসুমি পরিবর্তনের উপর নির্ভর করে। মানুষ সেই পাথর তুলে নিয়ে আবার ফেরত দিলে সেই স্বাভাবিক বিন্যাস নষ্ট হয়ে যায়। 

প্রাকৃতিক পাথরের ভেতর ও ফাঁকে শ্যাওলা, শৈবাল, পোকামাকড়, কেঁচো, শামুক, ছোট মাছ ইত্যাদি বাস করে। তারা সময় নিয়ে সেই পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেয়। যখন পাথর সরিয়ে নেওয়া হয়, সেই ক্ষুদ্র প্রাণীরা নষ্ট হয়। মারা পড়ে। আবার ফেরত দিলেও তারা সঙ্গে সঙ্গে ফিরে আসে না। 

পাথর নদীর পাড়কে ভাঙন থেকে রক্ষা করে, পানির প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে। এগুলো সরিয়ে দিলে মাটি ধসে পড়ে বা পানির স্রোত বদলে যায়। পরে ফেরত দিলে আগেরমতো একই রকমভাবে সুরক্ষা দিতে পারে না। 

পাথরকে তার প্রকৃতি নির্ধারিত স্থান থেকে সরালে মাইক্রো-ইকোসিস্টেম (ক্ষুদ্র বাস্তুতন্ত্র) -যেমন ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, অণুজীব -চিরতরে বিলীন হয়ে যায়। যেগুলো ছিল আসল "প্রতিবেশ" রক্ষার মূল ভরসা। কাজেই পাথরকে ফেরত দেওয়া মানেই প্রকৃতির প্রকৃত রূপকে ফেরত দেওয়া নয়। 

কারণ প্রকৃতি শুধু বস্তু (পাথর) নয়, বরং সময়, প্রক্রিয়া ও জীবের আন্তঃসম্পর্কের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একেকটা জটিল ব্যবস্থা। জৈব প্রকৌশলের এক অপার বিস্ময়! 

মোদ্দাকথা পাথর চোরদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য উদাহরণ তৈরি করা দরকার ছিল। প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার তা পারে নাই। আমরা মানুষকে আঘাত করলে তার বিচারে জেল জরিমানা করি। অথচ ওই মানুষের জীবনদাতা বা ভাগ্যনিয়ন্তা প্রকৃতির নিজস্ব চিরায়ত চলনকে বাধাগ্রস্ত করলেও তাদেরকে আমরা অজুহাতে দায়মুক্তি দেই। এই প্রকৃতি আমাদের মতো নির্বোধ, নির্মম ও দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষদেরকে আদৌ ক্ষমা করবে? 

লেখক: সাংবাদিক 
৩১ আগস্ট ২০২৫

Comments

    Please login to post comment. Login