কবির ভাই
কবির ভাই আমার অতি প্রিয় এক ব্যক্তি। তাকে মসজিদে বা রাস্তাঘাটে দেখলেই আমার চেহারায় আনন্দের ছায়া পড়ে। তিনিও আমাকে দেখে খুশি হন। তিনি আমাকে ঠিক কি কারণে পছন্দ করেন জানি না। কিন্তু আমি তাকে পছন্দ করি তার নিঃখাদ দরবেশি জীবনের কারণে। তাকে অধিকাংশ সময় এলাকায় দেখা যায় না। তিনি তাবলীগে তিন চিল্লায় সময় লাগান। তাবলীগের সাথীদের জন্য তার খেদমতের অভাব নেই। কারো বাসায় রান্না হয় নি, তো কবির ভাই টিফিন ক্যারিয়ারে করে তার বাসায় খাবার নিয়ে যান। এই মানুষকে কে না পছন্দ করবে?
একদিন হাফিজ ভাইয়ের মেসবাড়িতে গেলাম। দুপুর বেলা। দেখলাম, কবির ভাইও সেখানে আছে। আম গাছের ছায়ায় বসে আছে দুজনে। আমাকে দেখে দুজনের চেহারাই হাস্যোজ্বল হয়ে উঠল। আমি সালাম দেয়ার আগেই তারা সালাম বলল। যদিও আমি তাদের তুলনায় বয়সে ছোট। আমি বসে গেলাম তাদের সাথে। ওহ, হাফিয ভাইয়ের পরিচয় দেয়া হয় নি। এখন দিই। হাফিজ ভাই হলেন এই এলাকার তাবলীগের দায়িত্বশীল। তাকে তাই অনেকে আমির সাব বলে সম্মোধন করেন। তার অনুরোধে আমি গতমাসে ৩ দিনের জন্য তাবলীগে বের হয়েছিলাম। প্রতি নামাজ শেষে গোল হয়ে বসে দ্বীনি আলোচনা করার যে ব্যাপারটা এটা আমার খুবই পছন্দ হয়েছিল। এটা আমাকে সাহাবীদের (রা) সময়কার দ্বীনি আলোচনা চর্চার কথা মনে করিয়ে দিত।
হাফিজ ভাই হঠাৎ উঠে গেলেন। আমি এসেছিলাম তার কাছে একটা কাজে।
তিনি বললেন, আরিফ ভাই, মিনিট পনের বসেন। আমি আসতেছি।
সময়টা ভর দুপুর। বাইরে রোদ। আম গাছের ছায়ায় কিছুক্ষণ বসে বিশ্রাম নিলে মন্দ হয় না। আমি বসে পড়লাম। কবির ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই কেমন আছেন?
- আল্লাহ রাখছেন ভালো, আলহামদুলিল্লাহ।
-আলহামদুলিল্লাহ।
-পরিবার পরিজনের ঝামেলার কারণে আল্লাহর রাস্তায় সময় দিতে পারি না ঠিকমত!
-আপনি তো ভালোই সময় দেন, কবির ভাই।
কবির ভাই হ্যাঁ, না কিছু বললেন না। তিনি চুপ করে আছেন। আমিও চুপ করে গেলাম। কিছুক্ষণ পর কবির ভাই মুখ খুললেন, নবীজি (স) এর সুন্নাত না হলে বিয়েই করতাম না! হা হা।
কবির ভাইয়ের কথা ঠিক কোন উদ্দেশ্যে কোনদিকে যাচ্ছে বুঝতে পারছিলাম না। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দিলে ভালো হবে মনে হয়!
বললাম, হাফিয ভাইয়ের এখানে কখন এসেছেন ভাই?
-সকাল ৮ টা বাজে আসছি। এই এটা সেটা চিন্তা ফিকিরে আছি। সাথীদের কার কি হালত এই নিয়ে আরকি।
আমি মাথা ঝাঁকালাম। বললাম, আচ্ছা। কবির ভাই বাটন ফোন টিপতে ব্যাস্ত হয়ে গেলেন। এই বাটন ফোন এত টেপার কি আছে কে জানে? হাফিজ ভাইয়ের জন্য অপক্ষায় বসে থাকা ছাড়া এখন আমার কাজ নেই। কী আর করার। অবশ্য বসে বসে চিন্তা করা যায়। কবির ভাইয়ের কথাই ধরা যাক। আমার ধারণা, পরিবারের সাথে তার সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। এই কারণেই তিনি বিয়ে না করার কথা তুলেছেন। আর সকাল থেকে দপুর পর্যন্ত হাফিয ভাইয়ের মেসবাড়িতে এসে বসে আছেন! পরিবারের সাথে মনোমালিন্য না হলে এমন হওয়ার কথা না। তার মত এত চমৎকার মানুষের সাথে তার পরিবারের কী ধরণের মনোমালিন্য হতে পারে, এটা বোঝার উপায় আপাতত নেই। আল্লাহ রহম করুন সবার প্রতি।
হাফিয ভাই চলে এলেন কিছুক্ষণ পরে। আমি কাজের কথা বলে সেদিন চলে এলাম।
পরদিন দুপুরবেলা উপজেলা ভূমি অফিসে যাওয়ার পথে কবির ভাইয়ের দেখা হয়ে গেল। তার হাতে টিফিন ক্যারিয়ার। আমি তার চেহারার দিকে খেয়াল করলাম। (অন্যদের চেহারার ভাবভঙ্গি বিশ্লেষন করার চেষ্টা করাটা আমার এক ধরণের বদভ্যাস হয়ে গেছিল।) তার চেহারায় এক ধরণের বিষাদ, লুকোনো কষ্ট, আকুতি মিশে আছে। কিন্তু চেহারার উপরে উজ্জ্বল হাসির আড়াল।
কবির ভাই দাঁড়িয়ে গেলেন। বললেন, হাফিযকে দুপুরের খাবার দিয়ে এলাম। টিফিন ক্যারিয়ারে নিছিলাম, ঢেলে দিয়ে এলাম। (হাফিয ভাই বিয়ে করেন নি, মেসে খান) এখন তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে হবে, আমার মেয়েরা আবার আমাকে ছাড়া খেতে পারে না। অপেক্ষা করে থাকে। হা হা।
বললাম, আচ্ছা ঠিক আছে ভাই। বাড়ি গিয়ে খান ইন শা আল্লাহ।
-হুম।
কবির ভাই চলে গেলেন। তার চলে যাওয়ার ভঙ্গি দেখে মনে হলো, তিনি চলে যেতে চাচ্ছেন না। আর কিছুক্ষণ আমার সাথে গল্প করতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু আমার তাড়া আছে। আমিও কথা বাড়ালাম না।
হাঁটতে হাঁটতে ভাবছি, আমার বিশ্লেষন যদি ভুল না হয়, ‘আমার মেয়েরা আবার আমাকে ছাড়া খেতে পারে না। অপেক্ষা করে থাকে।’ – কবির ভাই এর এ কথা সত্তায নয়। বরং তার প্রত্যাশা মাত্র। প্রত্যাশা হলো– তার মেয়েরা তাকে এতই ভালোবাসবে– তিনি বাড়ি না গেলে তারা খেতে বসবে না । কিন্তু বাস্তবে হয়ত উল্টোটাই ঘটে । কবির ভাই হয়ত পরিবারের কাছে যথাযথ মূল্য পান না। এজন্যই বাইরের মানুষের কাছে মূল্য পাওয়ার জন্য বিভিন্ন কাজকর্ম করেন। আল্লাহই ভালো জানেন। আমি উপজেলার দিকে দ্রুত হাঁটতে লাগলাম। জরুরী কাজ আছে।
কয়েকমাস পরের ঘটনা। কবির ভাইয়ের ছোট ভাইয়ের সাথে আমার দেখা হলো রাস্তায়। সেলিম ভাই। ভদ্রলোক পরিবার সহ ঢাকায় থাকেন। হয়ত এলাকায় বেড়াতে এসেছেন। আমি সালাম দিলাম। কুশল জিজ্ঞেস করলাম। বললাম, সেলিম ভাই, কত দিন থাকবে এলাকায়?
–সপ্তাহ খানেক।
–আচ্ছা।
–চলেন চায়ের দোকানে বসি। কথা আছে আপনার সাথে।
সেলিম ভাই আমাকে হাত ধরে নিয়ে গেলেন। আমার সাথে কী কথা থাকতে পারে তার? বললাম, কী কথা ভাই?
– কথা তেমন না। মানে, কবির ভাইয়ের পরিবারে তো বিশাল ঝামেলা । জানেন না?
– না ভাই। উনি তো থাকেন তাবলীগে। তেমন দেখা হয় না।
–হ্যাঁ! উনি পরিবারের কোনো খোঁজ নেন না । তাবলীগে তাবলীগে ঘুরেন। বেশিরভাগ সময়ে মোবাইল থাকে অফ ।
– আচ্ছা! পরিবারের খোঁজ খবর না নিলে কেমন কি!
–শুনেন, ওদের দুই ভাড়াটিয়া দুই মাস হলো ভাড়া দেয় না। ভাবির কাছে টাকা পয়সা নাই। তিন মেয়ে নিয়ে সংসার চালাতে কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ভাবি আমাকে অভিযোগ দিল।
সবকিছু শুনে আমি থমকে রইলাম। সেলিম ভাই আবার শুরু করলেন,
আপনাদের সাথে উনি চলাফেরা করে। আপনারা একটু বুঝান কবির ভাইকে। দ্বীনের দাওয়াতি কাজ করবে ঠিক আছে, পরিবারের দেখাশোনাও তো করতে হবে না কি?
–হুম! ঠিকই বলেছেন। কিন্তু সেলিম ভাই, কিছু মনে করবেন না। আমার ধারণা, কবির ভাইয়ের পারিবারিক সমস্যার কারণ শুধুমাত্র কবির ভাই না। আমি কি ঠিক বলেছি?
সেলিম ভাই কিছু না বলে মাথা নিচু করে রাখলেন। তার চোখ মুখ শক্ত। শব্দ করে কয়েকটা নিঃশ্বাস ছাড়লেন। বললেন, কবির ভাইর মেয়েগুলোও তার মায়ের মত হইছে । বাপের প্রতি সম্মান নাই।
আমি বললাম, থাক ভাই। এগুলো আর জানার দরকার নাই। পারিবারিক বিষয়। গোপন থাকাই ভালো।
চায়ের দোকান থেকে বের হওয়ার সময় সেলিম ভাইকে বললাম, আসলে দুই পক্ষকেই বুঝিয়ে সমস্যাটা সমাধান করতে হবে। আপনারা পারিবারিক ভাবে তাদের বোঝান। আল্লাহ সহজ করুন। আর কবির ভাইয়ের সাথে দেখা হলে, তার সাথে কথা বলব ইন শা আল্লাহ।
সেলিম ভাই চলে গেলেন সেদিন।
এর পরে চার মাস পেরিয়ে গেছে । আবার সেই পুরোনো হাফিয ভাইয়ের মেসবাড়িতে দেখা হয়ে গেল কবির ভাইয়ের সাথে। তিনি উঠে এসে সালাম দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তাকে খুব খুশি দেখাচ্ছে। বললেন, আরিফ ভাই! ব্যাবসায় নামছি আলহামদুলিল্লাহ! ফাটাফাটি লাভ করছি!
আমি বললাম, আচ্ছা, আচ্ছা। আমাদের ভাবির হাতে তাহলে এবার টাকা গচ্ছিত রাইখেন ভাই! হা হা। আপনি আবার যা খরুচে মানুষ! খরচ করে ফেলবেন সব!
–ঠিক বলছেন ভাই। পরিবারের জন্য খরচ করাটাও নবীজির (স) আদেশ! অনেক সাওয়াবের কাজ!
কবির ভাই আমার হাত ধরে বসিয়ে দিলেন। কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন, ৬ টন অশ্বগন্ধা গুড়া সাপ্লাই দিছি এক পার্টিরে। ৪ শেয়ারে ব্যাবসা। ২০ লাখ টাকা লাভ হইছে! ৫ লাখ করে ভাগে পড়ছে!
–আচ্ছা, আচ্ছা!
–পার্টি নতুন। আমাদের হাতে সাপ্লাইয়ের পুরো দায়িত্ব দিয়ে দিছে। নরমাল পাইকারি রেটে দিছি! তাতেই এই লাভ!
আমি আবার বললাম, আচ্ছা, আচ্ছা! কবির ভাই বললেন, ব্যাবসায় লাভ করছি। আপনাদের জন্য খানাদানার আয়োজন করব!
–কবে!
–মাস খানেকের মধ্যে ইন শা আল্লাহ।
কবির ভাই এবার আমার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বললেন, ২০ লাখ টাকা দিয়ে একটা ফাইবার ইম্পোর্ট করার জন্য টাকা লাগাইছি। দেশে চলে এলেই ৪০ লাখে বেঁচে দিব! খাসা মার্কেট ভাই! টাকা আরও ডাবল হবে। হা হা। আল্লাহর দয়া।
বললাম, ব্যাবসার এত লাইন-ঘাট কোথায় পাচ্ছেন ভাই?
কবির ভাই এর উত্তর, আছে আছে একজন। আর সব আল্লাহর দয়া।
কবির ভাইয়ের ব্যাবসায়িক সাফল্য আমাকে আনন্দিত করল। আমি বরকতের দুআ করলাম। আমার স্ত্রী একটা বই কিনেছিল, নাম– পারিবারিক সুসম্পর্ক বজায় রাখার উপায়। ভাবলাম কোনো এক সুযোগে কবির ভাইকে বইটা হাদিয়া দিব ইন শা আল্লাহ।
দিন বিশেক পরে মসজিদে যুহর পরে বাড়ি যাচ্ছি। দেখলাম কবির ভাইও বের হয়েছেন। অনেক দিন তাকে দেখি না। এজন্য তার দিকে এগিয়ে গেলাম। তিনি তো সেবার দাওয়াত খাওয়ানোর কথা বলে আর খোঁজ নিলেন না। ভাবলাম বলব, আপনার দাওয়াত পরে খাব। আজ আমাদের বাসায় চলেন। উপস্থিত দাওয়াত । বাড়িতে মেহমান এসেছে, প্রচুর রান্না হয়েছে।
কবির ভাইয়ের সাথে দেখা হওয়া মাত্রই তাকে দাওয়াত দিলাম। তিনি কিছু বলছেন না। খেয়াল করলাম, কবির ভাইয়ের চেহারা ম্লান। তিনি চিন্তিত। জিজ্ঞেস করলাম, ভাই মন খারাপ কেন? তিনি বললেন, না, এমনি, এমনি।
আমি তাকে ধরে পড়লাম। বললাম, না আপনাকে বলতেই হবে। কিছু তো হয়েছে।
রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কবির ভাইয়ের কথা শুনছি। তিনি যা বললেন, তা শোনার আশা কখনই করি নি। সারাংশ হলো– তারা যে ফাইবার আমদানী করার জন্য টাকা লগ্নি করেছিলেন, সেটার বৈধতা সরকার থেকে নেই। কাস্টমসে পুরো চালান জব্দ করেছে। কিছু আর ফেরত দেবে না। লগ্নি করা ২০ লাখ টাকা পুরো শেষ হয়ে গেছে।
আমি বললাম, ইন্না লিল্লাহ। বলেন কি ভাই? ২০ লাখ টাকা পুরো শেষ?
কবির ভাই বললেন, আরো বেশি। চারজন শরীকের আরো ২ লাখ করে মোট ৮ লাখ যোগ দেন। মোটা ২৮ লাখ টাকা। সব শেষ।
আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। বুঝতে পারছিলাম না কবির ভাইকে কী বলব। আমি তার হাত ধরে টান দিলাম আমার বাসার দিকে । বললাম, চলেন আজ একসাথে খাই।
তিনি আমার সাথে চললেন। আমি তাকে নানাভাবে শান্তনা দিতে লাগলাম। তিনি হ্যাঁ, হু করলেন। বাড়িতে এসে খেতে বসলাম। দুশ্চিন্তায় কবির ভাই ভালোমত খেতে পারলেন না। খাওয়া শেষে তার বাড়ির জন্য গোশত, রুটি, পোলাও দিয়ে দিলাম। একটা বই হাদিয়া দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু মনে হল, এখন বই হাদিয়া দেয়ার সঠিক সময় নয়।
কবির ভাইকে এগিয়ে দিলাম তার বাড়ির দিকে। কবির ভাই মাথা ঝুঁকিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। আমার অন্তর বলে উঠল, আহারে, আহারে কবির ভাই। আল্লাহ কবির ভাইয়ের প্রতি রহম করুন।