বন্ধুরা
আমাদের আজিজনগর কলেজের ২২ তম ব্যাচের পূনর্মিলনী অনুষ্ঠান চলছে । বিশাল আয়োজন। প্রায় তিন’শ জন আমন্ত্রিত। বন্ধু পরিজন মিলে জমজমাট। আমাদের কলেজ বয়েজ কলেজ হওয়ায় মেয়েদের আমন্ত্রন করার ঝামেলা নেই। আমাদের কিছু বন্ধু বিদেশে থাকে, কিছু বন্ধু গ্রুপ অফ কম্পানীর মালিক। অনেকেই বড় বড় চাকরী করে। সবার থেকে বিশাল অংকের চাঁদা পাওয়া গেছে। সেই বিশাল অংকের টাকা সম্পূর্ণভাবে খরচ করার ব্যাবস্থা করা হচ্ছে।
মহিলা শিল্পি এনে গানের আয়োজনের প্রস্তাব করেছিল একজন। আমরা এক গ্রুপ কঠিনভাবে ভেটো দেয়ায় সেটা আর হয় নি । তবে এখনো যা হচ্ছে তাকে কম বলা যায় না। ৬ টা প্রমান সাইজ সাউন্ডবক্সে হিন্দি গান বাজছে। প্রেমিক প্রেমিকার অশ্লীল ও চুটুল ধরণের গান। আমার মাথায় আসছে না যে, আমাদের মত মধ্যবয়সী মানুষদের আয়োজনে এসব গান বাজানোর কারণ কী? এগুলো তো ছেলে ছোকড়ারা শুনে। আয়োজনের মূল দায়িত্বে আছে বন্ধু আজিজ। আজিজনগর কলেজের আজিজ! কি চমৎকার মিলেছে, তাই না! তাকে ধরলাম। বললাম, দোস্ত, বুড়াদের আয়োজনে এইসব কি গান! সে বলল, পার্টিতে চ্যাংড়া, বুড়ো ব্যাবধান নাই রে! ইনজয় কর।
আমি আর কিছু বলার আগেই সে ছুটে কোথায় যেন গেল। এত বড় অনুষ্ঠানের দায়িত্ব বলে কথা। ছোটাছুটি তো করবেই।
খাসির রেজালা, গরুর মাংসের আচার, কোড়াল মাছের দোপেয়াজা, ফ্রাইড চিকেন, সবজি, ডিম, দই, মিষ্টি, লাচ্ছি সব আয়োজনই আছে। দুপুর দুইটার দিকে নিরালা পার্কের সুবিশাল কমিউনিটি সেন্টারে প্রায় ৩০০ জন একবারেই বসে পড়লাম। সেন্টারের ছেলেগুলো পরিবেশন করল চমৎকার। আরাম করে খেতে পারলাম।
উৎসবমুখর পরিবেশে খাওয়া দাওয়া হলো।
খাওয়া শেষে সবাই গালগল্প করছি।
হঠাত স্টেজ থেকে আওয়াজ এল– প্রিয় বন্ধুরা!
আরেকবার আওয়াজ এল, প্রিয় বন্ধুরা! সবাই তাকালাম সেদিকে। দেখলাম– আজিজ ভাষন দেয়ার জন্য দাড়িয়েছে!
সবাই হেসে উঠল। হলে কোরাস উঠল, প্রিয় বন্ধুরা! প্রিয় বন্ধুরা!
আজিজ চমৎকার একটি ভাষন দিয়ে ফেলল। আয়োজনে কোনো কমতি হয়েছে কি না সে জিজ্ঞেস করল। সবাই বলল, না, না।
পেছন থেকে কে একজন চিৎকার করে বলল, কমতি কিছু হয় নি, তবে বাড়তি কিছু লাগবে!
সবাই হেসে উঠল। হা হা হা।
বুঝলাম বাড়তি কিছু বলতে মদ বোঝানো হচ্ছে। আজিজ জোরে বলে উঠল, শুনো সবাই! এরপর একদিকে সরে গিয়ে নিচু স্বরে বলল, বাড়তি কিছুর আয়োজন আছে! পেছনের গ্রুপটা হই হই করে উঠল। আমি তাকিয়ে দেখতে চাইলাম তাদের। কারা কারা আছে এই গ্রুপে। কিন্তু এত বেশি খেয়েছি যে পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে থাকতে কষ্ট হল। থাক, দরকার কী?
আধা ঘন্টা খানেকের মধ্যে আমি বাড়ির উদ্দেশ্যে চলে এলাম। আরও কি কি যেন আয়োজন ছিল তখনও। কিন্তু আমার ভালো লাগছিল না।
বাড়িতে এসে আমার স্ত্রীকে জানালাম আয়োজনের বৃতান্ত। আমার পরহেজগার স্ত্রী আমার উপর অত্যন্ত রাগ করল। বলল, এসব অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছ কেন? আমি বললাম, বন্ধু বান্ধব কিছু একটা বললে না করতে পারি না। এটা আমার দোষ। আমার স্ত্রী বলল, হ্যাঁ, দোষ।
সেই রাতে আমার অভিজ্ঞতা ভালো হলো না। দুপুরে খাওয়া তৈলাক্ত খাবারের কারণে পেটে সমস্যা দেখা দিল। রাতে আর কিছু খেতে পারলাম না। লেবুর শরবত খেলাম শুধু। বারবার ওয়াশরুমে যেতে হচ্ছিল। ঘুম তো দূরে থাক। পেটের ব্যাথায় বেশ কাহিল হয়ে পড়লাম । পেটে কোনো জীবাণু হয়ত ঢুকে গেছে! এত রাতে ওষুধ পাব কোথায়? আমি দোটানার মধ্যে আছি, ওষুধ কিনতে বাইরে যাব, নাকি কষ্ট করে রাতটা কাটিয়ে দিব।
আধা ঘন্টা কেটে গেল। পেটার ব্যাথা সহ্য করে শুয়ে আছি। এখন পেটে একটু আরাম পাচ্ছি । ক্লান্ত শরীরে দ্রুত ঘুম নেমে এল। আমি ঘুমিয়ে পড়লাম।
কয়েক ঘন্টা ঘুমের পর অভ্যাসমত ফজরের ওয়াক্তে জেগে উঠেছি। তখনও আজান হয় নি। উঠে বিছানায় একদিকে কাত হতেই পেটের ব্যাথা টের পেলাম আবার । ভাবলাম যত সকালে সম্ভব ওষুধ কিনে খেতে হবে।
এই ভোরে উঠেও ওয়াশরুমে বারবার যাতায়াত করতে হচ্ছে। খুবই খারাপ ব্যাপার। মসজিদে যেতে পারলাম না। বাড়িতে নামাজ পড়তে হল। মনটা হয়ে গেল বেশ খারাপ।
নামাজ শেষে কিছু দোয়া দরুদ পড়ে আবার ঘুমুতে যাব ভাবলাম। শরীরে খুব ক্লান্তি। চোখের পাতা ঘুমে বন্ধ হয়ে আসছে । আমার স্ত্রী স্যালাইন বানিয়ে এনেছে। খেলাম। এমন সময় আমার মোবাইল বেজে উঠল। ভাবলাম এত সকালে কে কল দিয়েছে? সকাল সকাল কল আসা মানে গুরুত্বপূর্ন কিছু। মোবাইল হাতে নিলাম। দেখলাম মোবারক কল দিয়েছে। আচ্ছা! মোবারক, আমার বন্ধু। হয়ত গতকালের অনুষ্ঠান বিষয়ে কোনো কথা বলবে। কল ধরলাম। সালাম দিলাম,
আসসালামু আলাইকুম।
ওয়া আলাইকুমুস সালাম, দোস্ত। খবর তো খুব খারাপ।
খবর খারাপ মানে? আমার মত তোরও পেট নেমে গেছে নাকি তেল টেল খেয়ে? হা হা!
মোবারক আমাকে থামিয়ে দিল। বলল, আরে থাম ব্যাটা! রাত সাড়ে চারটার দিকে আজিজ হার্ট অ্যাটাক করে মারা গেছে।
কী? কী বলিস তুই? হ্যাঁ?
আরে ব্যাটা, হ্যাঁ। হাসপাতালে নেয়ার সময় পায় নি। গাড়িতেই মারা গেছে।
ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজীউন।
আজিজের মৃত্যর খবর শুনে সত্যিই আমি ধাক্কার মত খেলাম। গতকালের টাটকা ছেলেটা আজ আর নেই! বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয়। হায় আল্লাহ। আমি থমকে গেলাম। শুয়ে পড়লাম, কিন্তু ঘুম আসছিল না।
আজিজ দেখতে বেশ ফিট ছিল, শরীরে চর্বি নেই। এই ছেলে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেল কীভাবে? আসলে যার যখন মৃত্যু আছে, তখন হবেই। কেউই বাঁচতে পারবে না। আমার মৃত্যু যে কবে লিখা আছে কে জানে? বেশ আতঙ্কিত বোধ করছি।
সকাল দশটার দিকে মোবারককে আবার কল দিয়ে জানলাম জানাযা কখন। সে বলল যুহরের নামাজের পরেই। আমি সারে ১১ টার দিকে রওনা দেয়ার নিয়্যত করলাম। সকাল সকাল যাওয়ার উপায় ছিল না। আমার পেটের সমস্যা মোটেও সারে নি।
আজিজদের বাড়িতে গেলাম। অনেকেই আজিজের লাশ দেখছে। আমি দেখার সাহস করলাম না। হয়ত ব্যাপারটা সহ্য হবে না। জীবিত আজিজের চেহারাই আমার স্মৃতিতে থাক। আল্লাহ তার ভুল ত্রুটি, গুনাহ ক্ষমা করে দিন। আল্লাহ রহমানুর রাহীম, গফুরুর রহীম।
আমাদের বন্ধু সার্কেলের অন্তত দেড়শ জন এসেছে আজিজের জানাযা পড়তে। যুহরের নামাজ শেষে মসজিদেই আজিজের জানাযা হবে।
নামাজ শেষ হলো।
আমরা বন্ধুরা বসে আছি । অনেকেরই ব্যাস্ততা আছে। কেউ কেউ ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। জানাযা শুরুর আগে আজিজের পরিবারের কয়েকজন কথা বলতে উঠে দাঁড়ালো।
আজিজের বড় ভাই কথা বলতে বলতে দীর্ঘ্য করে ফেলল। ভদ্রলোক এটা ওটা বলছেন। তার চোখে পানি চলে আসছে। আমার পাশে একজন বিরক্ত হয়ে বলল, আরে এত কথার কি আছে। সময় জ্ঞান নাই লোকের।
পাশ ফিরে তাকালাম। দেখলাম– সেলিম কথাগুলো বলেছে। আহারে! মনে পড়ল এই সেলিম গতকাল আজিজের সাথে বেশ ঢলাঢলি করেছিল। গতকালই শুনলাম, সেলিম তার মেয়েকে জাপানে পাঠাবে টুরিজম এন্ড হসপিটালিটি নিয়ে পড়তে। চল্লিশ লক্ষ টাকা লাগবে। টাকা পুরোটা ম্যানেজ হচ্ছে না। সে এই পেরেশানিতে আছে।
জানাযা শেষ হলো। কবরস্থান কাছেই। বন্ধুদের অনেকেই যাচ্ছে কবর পর্যন্ত। আমিও যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। আলহামদুলিল্লাহ, পেটের সমস্যাটা কমেছে।
পথে এক বড় ভাইয়ের সাথে দেখা হয়ে গেল। আজিজের এলাকার। একসময় বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল। ঐ ভাই হাসিমুখে আমাকে ডাকলেন। জিজ্ঞেস করলেন, কেমন আছি। তার উতফুল্ল ভঙ্গি দেখে আমাকে বলতেই হল, ভালো আছি। হাসি বিনিময় হলো। ভাই আমাকে ধরে পড়লেন । উচ্চস্বরে এলাকার রাজনীতি নিয়ে এটা সেটা অনেক গল্প শোনাতে লাগলেন। আমি বিব্রত বোধ করছি। তাকে থামাতেও পারছি না। একজন মৃতের পেছন পেছন যাত্রার সময় এ ধরণের গল্প করা কি ঠিক? আমি অবাক হচ্ছি। তার কথার তালে হ্যাঁ, হু করছি । তিনি খুব উত্তেজিত ভঙ্গিতে রাজনীতির নানান ঘটনা বর্নণা করেই যাচ্ছেন। আমাদের পাশ দিয়েই হেঁটে যাচ্ছিল, জুনায়েদ। তার দিকে মনোযোগ দিলাম। শুনলাম সে আরেকজনকে বলছে, আরে দেশে ভবিষ্যত নাই। আমার ছেলেকে দুবাই পাঠাব। স্বর্নের ব্যাবসার লাইনে লাগিয়ে দিব। পরিচিত লোক আছে, আলহামদুলিল্লাহ।
আচ্ছা! তাহলে এরা দুজন নিজেদের সন্তানের ভবিষ্যত, ফ্লাট, জমি ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করছে।
আমি খুবই আশ্চর্য্য হলাম। আজিজের মৃত্যু নিয়ে কি কেউই কথা বলছে না? হায় আজিজ! আজিজ সত্যিই আজ বড় একা।
আমি সবাইকে এড়িয়ে একটু সরে হাঁটতে লাগলাম। আমার আরেক ব্যাচমেট শরীফকে দেখলাম গল্প করছে ইউসুফের সাথে। তারা গল্প করছে অফিস পলিটিক্স নিয়ে। নিজেদের চাকরির প্রমোশন নিয়ে তাদের উদ্বিগ্ন মনে হলো।
কবরস্থানের কাছে চলে এলাম। আমরা একটু পেছনে পড়ে গিয়েছিলাম। লাশ কবরে নামানো হয়েছে। মাটিও বেশ খানিকটা দেয়া হয়ে গেছে। ভীড় একটু কমলে আমরা মাটি দিব । আমার পাশে দুজন এসে দাঁড়ালো। একজনকে চিনি, আজিজের সমবয়সী হবে। সম্পর্কে ভাই । আরেকজন অপরিচিত। তারা কথা বলছিল, নতুন এই কবরস্থানের জমির ইতিহাস নিয়ে। তারা জমির খুঁটি নাটি নিয়ে আমার কানের কাছে দিয়ে কথা চালাতে লাগল। আমি খুবই বিরক্ত হলাম। সরে দাঁড়ালাম ওখান থেকে।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে সবার মাটি দেয়া হয়ে গেল। আমাদের বন্ধুরা দেখি সবাই একসাথে হচ্ছে। আমিও এগিয়ে গেলাম। অনেকের মুখই হাসি হাসি। গতকালের অনুষ্ঠান নিয়ে কথা হচ্ছে। এমন অনুষ্ঠান প্রতি বছর হওয়া উচিত বলে কেউ কেউ মত ব্যক্ত করল। একজন বলল, দেখা সাক্ষাৎ না হলে বন্ধুত্বের আর কিছুই থাকে না রে! বছরে এরকম একটা অনুষ্ঠান হলে সবার সাথে দেখা সাক্ষাৎ হয়! হওয়া উচিত।
সবাই ফেরার পথ ধরেছে। কেউ কেউ অতি তাড়াহুড়ো করে বাইকে বা রিকশায় উঠছে। হয়ত ব্যাস্ততা আছে তাদের। কিছুক্ষণের মধ্যে যে যার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে চলে গেলাম। মনে হল, গতকালের মত আজও একটা হই হুল্লোর শেষ হলো। বন্ধুদের সেই চিরচেনা হই হুল্লোর।