ঠান্ডা স্নায়ু
১৬৭৯-৮০ সাল। রাজপুত সহ কয়েকটি গোত্রের নেতারা নিজেদের মধ্যে দূত আদান প্রদান করছে। এই গোত্রগুলোর সবাই মোগল সম্রাজের অনুগত। কিন্তু হঠাৎ করেই বিশ্বাসঘাতকতার চিন্তা জেগে উঠেছে তাদের কিছু নেতার মনে। আলাপ আলোচনা শেষে কিছুদিনের মধ্যেই গোত্রগুলো সম্রাটের আনুগত্য ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। গঠিত হলো সামরিক জোট। আনুগত্য ত্যাগ করলে বিদ্রোহের পথই বাকি থাকে। হ্যাঁ, তারা বিদ্রোহের পথেই বেছে নিয়েছে। শক্তিশালী মোগল সম্রাজ্যের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ। যেই সম্রাজ্যের বাদশাহ— মহামতি আওরাঙ্গজেব আলমগীর (রহ)।
রাজপুত মিত্রশক্তির বিদ্রোহ দমনের জন্য বাদশাহ আলমগীর (রহ) তার কনিষ্ঠপুত্র আকবরের অধীনে ৭০ হাজার শাহী বাহিনী পাঠিয়েছেন। কিছু দিনের মধ্যেই খবর শোনা গেল, শাহী বাহিনীর তীব্র আক্রমনে রাজপুত মিত্রজোট পর্যুদস্ত হয়ে পালিয়ে গেছে। শাহী বাহিনী তাদের তাড়িয়ে নিচ্ছে। রাজপুত বাহিনী পালাতে পালাতে একটা ঘন জঙ্গল ও পাহাড়ী এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে। এই রাজপুতরা সম্মুখযুদ্ধে তেমন পারদর্শী নয়। কিন্তু গেরিলা যুদ্ধে খুবই দক্ষ। কিন্তু তারা খুব বেশিদিন নিজেদের এই দক্ষতার উপর নির্ভর করতে পারল না। খবর পেল, বাদশাহ আলমগীরের আরেক পুত্র শাহ মোয়াজ্জমের বাহিনী নতুন করে শাহী বাহিনীর সাথে যুক্ত হয়েছে। এবং পুরো মোগল বাহিনী বিভিন্ন ইউনিটে বিভক্ত হয়ে তাদের কঠিন বেস্টনী দিয়ে ঘিরে ফেলেছে। এই সংবাদ শোনার পর তারা নিজেদের অস্তিত্ব সমূলে বিনাশ হয়ে যাওয়ার অপেক্ষা করতে লাগল।
সম্রাট আওরাঙজেব আলমগীর (রহ) অবস্থান করছেন আজমীরে। তিনি মোটামুটি নিশ্চিন্ত। বিদ্রোহ দমনের ভালো খবর তার কাছে পৌঁছাচ্ছে। তিনি হয়ত ভাবছেন, এই রাজপুতরা কিসের প্রত্যাশায় বিদ্রোহ করল। তারা তো ভালোই ছিল, শান্তি সমৃদ্ধিতেই বসবাস করতে পারছিল। আর কোন সাহসেই বা মোগল শক্তির মোকাবেলা করা মত ধৃষ্টতা দেখাতে পারল! বেশ অনভিপ্রেত ব্যাপার। কিন্তু বাদশাহ আলমগীর জানেন, রাজ্য পরিচালনার ভার একবার কাঁধে নিলে এরকম অহরহ অনভিপ্রেত ঘটনার মোকাবেলা করে যেতে হয়। এসব থেকে বেঁচে থাকার কোনো উপায় নেই। আল্লাহই ভরসা। তার স্মরনেই শান্তি। বাদশাহ আলমগীর আল্লাহর তাআলার উপর ভরসা আর তার স্মরনে সময় কাটাতে খুবই পছন্দ করেন।
যুদ্ধে পরাজয় নিশ্চিত জেনে রাজপুত বাহিনী কুটনৈতিক তৎপরতার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা শাহজাদা আকবরকে বাদশাহের বিরুদ্ধে সামরিক সমর্থন ও সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিদ্রোহ করার প্রস্তাব দিতে চাইল । বাদশাহকে হটিয়ে শাহজাদা যেন সুলতানুল হিন্দ হতে পারে। শাহজাদা আকবর ছিল বয়সে কনিষ্ঠ ও অনভিজ্ঞ। মোগল শাহী বাহিনীর পুরোটা তার অধীনে থাকায় হঠাৎ দুঃসাহস তার মাথায় চড়ে বসে। সে রাজপুতদের কুটচালে ধরা দেয়। জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। বাদশাহ হওয়ার লোভ সংবরণ করতে ব্যার্থ হয়। ফলত, সে শত্রুর দেয়া টোপ গিলে ফেলল এবং নিজেকে হিন্দের বাদশাহ ঘোষনা করে বসল। একটি সিংহাসনে বসে রাজমুকুট ধারণ করল। তার নিকটই ছিল শাহী বাহিনীর সমস্ত এলিট সৈন্য। এই সাথে যোগ দিল রাজপুতদের প্রায় ৪০ হাজার সেনা। সবাই মিলে রওনা দিল আজমির দখলের উদ্দেশ্যে। সেখানে অবস্থান করছেন বাদশাহ আলমগীর।
বাদশাহ আলমগীর সব সংবাদ শুনলেন। তিনি তার স্বভাবমত অস্থির বা বিহ্বল হলেন না। মাথা ঠান্ডা রাখলেন ও আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইলেন। তার কাছে ছিল হাতেগোনা কিছু সেনা, যারা মূলত দেহরক্ষীর দায়িত্ব পালন করে। শাহী এলিট বাহিনীর সাথে তাদের সামর্থ্য, শক্তিমত্তা তুলনীয় নয়। বাদশাহের বাহিনীর আরো বিভিন্ন ইউনিট সারা রাজ্যে দূর-দূরান্তে বিভিন্ন জায়গায় ছড়ানো ছিল। সেনা সাহায্য খুব দ্রুত পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। সবচেয়ে ভীতির কথা হল, বাদশাহ আলমগীরের সবচেয়ে নিকটে যে বাহিনীটি অবস্থা করছে– সেটিই বিদ্রোহী শাহজাদা আকবারের বাহিনী!
বাদশাহ আলমগীরের পয়গাম পৌঁছল শাহজাদা মুআজ্জামের নিকট । তিনি তার বাহিনী নিয়ে দ্রুত আজমীরে বাদশাহর সাহায্যে ছুটে এলেন। সাথে আশপাশের কিছু অনুগত সালারও দ্রুত সৈন্য নিয়ে বাদশাহের সহযোগীতায় রওনা করল। কিছুদিনের মধ্যে বাদশাহর বাহিনী কিছুটা সমৃদ্ধ হল। যুদ্ধ করার উপযুক্ত হলো। বাদশাহ এবার আল্লাহর নামে সৈন্য সমেত আজমির থেকে বের হলেন। একটি সুবিধাজনক প্রান্তে শিবির করলেন। শাহজাদা আকবরের বিদ্রোহী বাহিনীও সেদিকে এগিয়ে আসছিল ধীরে ধীরে।
বাদশাহ আলমগীর সবার কেন্দ্রে অবস্থান করছেন। তিনি ভাবছেন যুদ্ধের পরিকল্পনা নিয়ে। ঠিক করলেন, সামরিক যুদ্ধের আগে কুটনৈতিক যুদ্ধ শুরু করবেন। বিদ্রোহীদের উদ্যেশ্যে একটি একটি করে নিখুঁত কুটনৈতিক তীর ছুড়বেন।
একজন সালারকে অতি গোপনে আকবরের বাহিনীতে অবস্থানরত তার ভাই, যিনি আকবরের কোষাগাররক্ষক ও আমিরের দায়িত্ব পালন করছেন, তার নিকট পাঠানো হলো। আলাপচারিতা হলো। জানা গেল সেই আমির চাপে পড়ে শাহজাদা আকবরের সাথে আছেন। প্রকৃতপক্ষে, তিনি বাদশাহের অনুগত। তাকে জানানো হলো, বাদশাহর আদেশ– গোপনে শাহজাদা আকবরের কোষাগার সমেত বাদশাহের সেনা ছাউনিতে চলে যেতে হবে যত দ্রুত ও গোপনীয়তার সাথে সম্ভব । সেই আমির অক্ষরে অক্ষরে পালন করল এই আদেশ।
আকবরের প্রধান উজির তাহাব্বুর খানের নিকটও বাদশাহের গোপণ দূত পৌঁছাল। দূত হলো সেই উজিরে শ্বশুর। দূতের সাথে আছে বাদশাহের চিঠি। চিঠিতে লিখা বার্তার অর্থ খুব পরিস্কার, তাহাব্বুর খান যদি আকবরের সঙ্গ ত্যাগ করেন ও বাদশাহের সাথে সাক্ষাত করেন তাহলে তাকে ক্ষমা করা হবে, নিরাপত্তা দেয়া হবে। বাদশাহের বার্তা তাহাব্বুর খান বিশ্বাস করলেন। বাদশাহ আলমগীরকে অবিশ্বাস করার কিছু নেই। তিনি যে ক্ষমা গ্রহণের কথা বলেছেন, সেটাই নিরপদ ভাবলেন। অনভিজ্ঞ বিদ্রোহী শাহাজাদার মতিগতির উপর ভরসা নেই।
তাহাব্বুর খান গোপনে গভীর রাতে আকবরের ছাউনি থেকে বাদশাহের ছাউনির উদ্দেশ্যে চলে এলো। প্রকৃতপক্ষে শাহজাদা আকবরের বাহিনীর অধিকাংশই মন থেকে তাকে সমর্থন করেনি, অনেকটা চাপের মধ্যে চুপ ছিল তারা। পেছনে রাজপুত বিশাল বাহিনী থাকায় তারা কিছু করতে সাহস করছিল না।
এবার বাদশাহ আলমগীর তার কুটনীতির শেষ তীরটি নিক্ষেপ করলেন। শাহজাদা আকবরের উদ্যেশ্যে চিঠি লিখলেন। এই চিঠিতে বাদশাহ রাজপুতদের পূর্ণ সেনাশক্তিকে জংলি দূর্ভেদ্য পাহাড়ী এলাকা থেকে কৌশলে বের করে খোলা ময়দানে নিয়ে আসার চমৎকার কৌশলের জন্য পুত্র আকবরকে অভিনন্দন জানান। বাদশাহ চিঠিতে আকবরকে নির্দেশ দেন– সৈন্য এমন ভাবে সমাবেশ করবে যেন রাজপুত বাহিনী থাকে পিতা পুত্রের বাহিনীর মাঝে, যেখানে পিতা ও পুত্র মিলে সামনে ও পিছন থেকে একসাথে তাদের পিষে ফেলতে পারে। বস্তুত চিঠিটি ছিল বাদশাহের কুটনৈতিক চালের একটি অংশ এবং চিঠিটি এমন ভাবে বহন করার পরিকল্পনা সাজানো হয় যেন তা আকবরের হাতে পৌঁছানোর আগে রাজপুত নেতাদের হাতে পৌঁছায়।
চিঠি পরিকল্পনা মত বহন করা হলো বিদ্রোহী শিবিরে। তখন গভীর রাত। শাহজাদা আকবর গভীর ঘুমে । যা হওয়ার তাই হতে লাগল। চিঠি বহনকারী দূত ধরা পড়ল রাজপুতদের হাতে। চিঠির বক্তব্য পড়ার সাথে সাথে তাদের হৃদয়ের ভয়, আশংকা দিগন্ত বিস্তৃত হলো। তাদের মনের প্রশ্ন– সত্যিই কি শাহজাদা আকবর তাদের ধোঁকা দিয়ে খোলা ময়দানে নিয়ে এসেছে? যদি তাই হয় তাহলে সমূলে ধ্বংস হওয়া ছাড়া উপায় কিছু নেই। তবে তারা নিশ্চিত হতে চাচ্ছিল। চিঠির কথা শাহজাদা আকবরকে জানানো দরকার। তারা মতামত শোনা দরকার। তারা ছুটল শাহজাদার তাঁবুর দিকে। কিন্তু তাঁবুরক্ষীরা গভীর রাতে শাহজাদা জাগাতে অস্বিকৃতি জানালো। রাজপুতরা বিভ্রান্ত। তারা এবার ছুটল শাহজাদার উজিরে আজম তাহাব্বুর খানের তাঁবুতে । দেখা গেল– তাঁবু খালি। জানা গেল, তিনি ইতিমধ্যে বাদশাহের ছাউনির উদ্দেশ্যে চলে গিয়েছেন।
চিঠির বাস্তবতার আশংকায় ও পরিণতির ভয়াবহতা চিন্তা করে রাজপুতরা রাতারাতি পালানোর সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ফেলল । আর অপেক্ষা নয়। তারা সব কিছু নিয়ে গোপনে ময়দান ছাড়তে লাগল। একই সময়ে শাহজাদা আকবরের অধিকাংশ সেনা একে একে সুলতান আলমগীরের ছাউনিতে চলে আসতে লাগল । সারা রাত জুড়ে চলল এই আশ্চর্য্য সৈন্যবদল খেলা। বেখবর শাহজাদা আকবর তখনো সুখনিদ্রায় বিভোর।
ভোর হল। শাহজাদা আকবর জেগে উঠল। তাঁবুর বাইরে এসে ময়দানে চোখ ফেরাল আকবর। দেখল, তার আশপাশে হাতে গোনা যায় এমন সংখ্যক সৈন্য অবস্থান করছে মাত্র। পুরো মাঠ খালি পড়ে আছে। রাজপুত শিবির শূন্য। তার বার্তাবাহক খবর আনল– অন্যদিকে সুবিস্তৃত ময়দান পূর্ণ করে আছে বাদশাহ আলমগীরের বাহিনী, যারা তার সাথে যুদ্ধের অপেক্ষা করছে । ভীষন আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়ল শাহজাদা আকবর। অতি দ্রুত ময়দান ছেড়ে পালানোর পথ খুঁজতে লাগল সে। তার হিন্দের বাদশাহ হওয়ার স্বপ্ন অতি নির্মমভাবে ধুলিস্যাত হয়ে গেল । আপাতত প্রাণ বাঁঁচানোই তার স্বপ্ন । দ্রুত ছুটে চলল তার ঘোড়া। কে বলবে? হয়ত বাদশাহর সেনা ইতিমধ্যেই পিছু নিয়েছে তার! শাহজাদা যত পথ পেরোতে লাগল, তাকে তাড়া করতে লাগল আতঙ্ক, হতাশা। যার কোনো উপশম সে খুঁজে পাচ্ছিল না।
কিছুদিন পরে ঘটনা। রাজপুত মিত্র জোটের দূত এসেছে হিন্দের প্রকৃত বাদশাহ আলমগীরের দরবারে। দূতের কাছে জানা গেল, রাজপুতরা তাদের বিদ্রোহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেছে, এবং নিরঙ্কুশ আনুগত্য বজায় রাখার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
বাদশাহের নিকট রাজপুতদের বশ্যতার প্রস্তাব গৃহিত হলো। হিন্দে শান্তি ফিরে এল। কাছে কিংবা দূরে অবস্থানকারী মোগলদের শত্রুরা আরেকবার জানতে পারল দরবেশ বাদশাহ আলমগীরের ঠান্ডা স্নায়ুর উপাখ্যান। যিনি যুদ্ধের ময়দানেও সেভাবেই খুশু খুযু সহকারে নামাজ আদায় করেন, যেমনটা আদায় করেন নিজ রাজধানীর জামে মসজিদে।