গভীর নিশুতি রাত। ঘন কালো অন্ধকার। শের খান আফগানীর বাহিনী যতটা সম্ভব নিঃশব্দে ভেঙ্গে ফেলছে কীর্তিনাশা নদীর উপরে থাকা কাঠের ব্রীজটি। এই ব্রীজটি পারি দিয়েই তাদের বাহিনীর শেষ সৈন্যটিও কিছুক্ষণ আগে এপারে এসে পৌঁছেছে । আরো এসেছে ভারী ভারী কামান। আর দানবাকৃতির হাতিগুলো এসেছে নদীতে সাঁতার দিয়ে। উদ্দেশ্য ঘুমন্ত মোগল বাহিনীকে গোপণে পেছন থেকে ঘিরে ফেলা। তীব্র আক্রমণে পর্যদুস্ত করা।
আজ থেকে প্রায় ৪৮৪ বছর আগের কথা বলছি। জায়গাটির নাম ছিল চৌসা। পশ্চিমবঙ্গের বিহারের চৌসা। গভীর রাতে সেখানের নদী অববাহিকার বিস্তীর্ণ ময়দানটিতে ঘুমিয়ে আছে মোঘল বাহিনী ও তাদের সম্রাট হুমায়ুন। অববাহিকার অনতিদূরেই একত্রে এসে মিলিত হয়েছে গঙ্গা ও কীর্তিনাশা নদী।
কীর্তিনাশার ব্রীজটি তীরের দিকে বেশি কিছুটা অক্ষুন্ন রেখে গুড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছে শের খানের বাহিনী । কায়দা কানুন ভালোই জানে তারা। শের খানের সেনারা বেশ খুশি। রাতের অন্ধকারে অতর্কিত হামলা করা হবে ঘুমন্ত মোঘল বাহিনীর উপর। তাদেরকে তাড়িয়ে নেয়া হবে কীর্তিনাশা নদির দিকে। ব্রিজ দেয়া হয়েছে ভেঙে। ফলে নদীই হবে হাজারো মোগল সেনার সলিল সমাধি! সেনারা বুঝতে পেরেছে তাদের নেতা শের খানের চাল কত নিঃখুঁত! অথচ উজ্জ্বল দিনে সম্রাট হুয়ামুনের সাথে সমঝোতা আর আনুগত্যের মিথ্যা অভিনয় করেছেন শের খান।
তবে নরমদিল উন্নত স্বভাবের সম্রাট হুমায়ুনের ব্যাপারে শের খানের হৃদয়ে বেশ দূর্বলতা আছে। তাই সেনাদের কঠোর আদেশ দেয়া হয়েছে, যেন হুমায়ুনের তাঁবুতে কোনো আক্রমণ করা না হয়। তাকে পালিয়ে যাবার সুযোগ করে দেয়া হয়। তবে মুক্তি নেই ঘুমন্ত মোঘল সেনাদের। তাদের জন্য অপেক্ষা করছে মৃত্যু।
ঘুটঘুটে অন্ধকার। গভীর রাত্রি। আক্রমনের জন্য প্রস্তুত শের খানের বাহিনী। আক্রমন করা হবে সর্বশক্তি দিয়ে। আচমকা ও তীব্র। ঘুমের ঘোরে থাকা মোঘল সেনারা হয়ত তরবারি ধরার সুযোগই পাবে না, অশ্বারোহী সেনারা সময় পাবে না তাদের ঘোড়াকে জিন পরানোর। তীব্র হামলায় সবাইকে তাড়িয়ে নেয়া হবে কীর্তিনাশা নদীর দিকে। ব্রিজ পারি দেয়ার চেষ্টা করে অনেকেই। কিন্তু তারা তো জানে না ব্রীজ মাঝখান থেকে ভাঙ্গা। আচমকা হবে তাদের পতন। খরস্রোতা নদী তাদের গিলে ফেলবে।
একজন মুসলিম হয়ে যুদ্ধে আরেক মুসলিমের জান নেয়া তখনকার দিনের আঞ্চলিক রাজা বাদশাহদের কাছে খুবই নগন্য ব্যাপার হয়ে গিয়েছিল । আর রাজা বাদশাহর অনুগত সেনারাও এই ব্যাপারে নৈতিকতার ধার ধারত না। ভয় করত না মজলুমের অভিশাপের। কিংবা আখিরাতের মহা-হিসাবের। দুনিয়ার সামান্য লাভের জন্য নিজের ধর্মীয় ভাইয়ের শরীরে আঘাত হানত মারনাস্ত্র দিয়ে। অথচ এমনটি হওয়া মোটেই কাম্য ছিল না। এই কষ্টের কথা একপাশে রেখে আবার ফেরা যাক গল্পে ।
চারদিকে চিৎকার আর আর্তনাদের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। ক্লান্ত ঘুমন্ত সম্রাট হুমায়ুন হঠাৎ ঘুম ভেঙে জেগে উঠলেন। তিনি বুঝতে পারলেন না কী হয়েছে। কেউ একজন হঠাৎ মৃত্যুর দুঃসংবাদের মত শোনালো, শের খানের বাহিনী আমাদের উপর আক্রমন করেছে। কোনো রকম প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব হয় নি। আমরা সম্পূর্ণ রূপে পরাজিত হয়েছি! হুমায়ুন দেখলেন, কথাগুলো বলেছে তার বিশ্বস্ত এক খাদেম। যে সর্বদা তাকে পানি খাওয়ানোর দায়িত্বে নিয়োজিত থাকে। এই খাদেমের কথা অবিশ্বাস করার মত নয়। খাদেম আবার গাঢ় স্বরে বলল, মহামান্য! আপনাকে দ্রুত পালিয়ে যেতে হবে। দ্রুত। সময় খুব কম।
ঘোড়ার পিঠে চড়ে ছুটতে ছুটতে হুমায়ুন এসে পৌঁছালেন নদীর কাছে। ঠায় দাঁড়িয়ে সেখানে কিছুক্ষণের জন্য দেখলেন কিয়ামতের বিভীষীকা। সৈন্যরা নদী পারি দিতে ব্রীজের উপর দিয়ে ছুটছে আর নদীতে পরে যাচ্ছে। কেউ কেউ তীব্র খড়স্রোতা এই নদীতে ঝাপ দিয়ে বাঁচার বৃথা চেষ্টা করছে। মোঘল বাহিনীর প্রশিক্ষিত হাতিগুলো নদীতে পড়ে কেমন পাগলের মত ঘুরছে, যেন তাদের আগে কখনো সাঁতারের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় নি।
পেছনে ছুটে আসছে শের খানের বাহিনী। কচুকাটা হচ্ছে মোঘল সেনারা। তারা শুধু জান বাঁচাতে মরিয়া হয়ে ছুটছে। কিন্তু ছুটে পালাবে কোথায়? সামনের নদী তাদের গতি রোধ করে দাঁড়িয়ে আছে। এই নদীই হবে তাদের কবর।
হুমায়ুন বুঝলেন আর সময় নেই। তিনি ঘোড়া সহ ঝাঁপিয়ে পড়লেন নদীর বুকে। মুহুর্তেই ঘোড়াটি ডুবে গেল। পরিশ্রান্ত হুমায়ুন কিছুক্ষণ হাত পা নাড়ানোর চেষ্টা করে ভেসে থাকতে চাইলেন। কিন্তু তার অসার শরীর ক্রমেই ডুবে যাচ্ছে। তিনি চোখের সামনে দেখছেন মৃত্যুর বিভীষিকা। এমন সময় একটা আওয়াজ তার কানে এল। কে একজন বলছে, আমি আপনার দিকে একটি বাতাস ভর্তী মশক ছেড়ে দিচ্ছি, আপনি মশক ধরে নদী পার হওয়ার চেষ্টা করুন।
লোকটি একটি মশক এগিয়ে দিয়েছে হুমায়ুনের দিকে। হুমায়ুন দেখলেন এটা ধরে ভেসে থাকা যায়। তিনি প্রাণপণ আকড়ে ধরলেন বাতাস ভর্তী মশক।
অচেনা লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি আমাকে চেন?
হ্যাঁ, আপনি সম্রাট হুমায়ুন।
তুমি কে?
আমি নিজাম। ভিসতি ওয়ালা নিজাম।
নদীর তীব্র স্রোতে ভিসতি ভেসে যেতে শুরু করেছে । ক্রমেই ভিসতি নিজামের থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন হুমায়ুন। তিনি চিৎকার করে তার উদ্দেশ্যে বললেন, শোনো ভিসতি নিজাম, যদি আবার কখনো সিংহাসনে বসতে পারি, তাহলে তোমার উত্তম কর্মের বদলা আমি দেব। তোমাকে একদিনের জন্য হলেও দিল্লীর সিংহাসনে বসাবো। তুমি আমার সাথে দেখে করবে। অবশ্যই করবে।
নদীর স্রোত আর তীব্র কোলাহলে ধীরে ধীরে মিশে গেল হুমায়ুনের কন্ঠস্বর। এই কন্ঠস্বর ভিসতিওয়ালা নিজামকে নিশ্চয়ই আপ্লুত করেছিল।
দিন পেরিয়েছে। পেরিয়েছে কত রাত। গুনে গুনে মাস।
আগ্রাতে আজ দরবার বসেছে। দরবার আলো করে আছেন সম্রাট হুমায়ুন। দীর্ঘদিন জ্বরে ভোগার পরে তিনি আজ সুস্থ্য বোধ করছেন। সবাই আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা আদায় করছে। অসীম কুদরত তার। অথচ হুমায়ুনের জ্বর ছাড়ার কোনো লক্ষণই ছিল না। চৌসার যুদ্ধের পর আহত শরীরে তিনি বহু গ্রাম গ্রামান্তর ঘুরে, ক্ষুধা, তৃষ্ণা সহ্য করে আগ্রায় ফিরতে সক্ষম হয়েছেন। সুস্থ্য হতে হতে কয়েক মাস পেরিয়ে গেছে। এখন তার অবস্থা স্থিতিশীল। সবাই অত্যন্ত খুশি। আরো খুশির ব্যাপার হচ্ছে– তার ভাইরা তার সাথে থাকার ঘোষনা দিয়েছে। অতীত ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়েছে। সম্রাট তাদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। দরবারে বিরাজ করছে অত্যন্ত আবেগঘন পরিবেশ।
সম্রাটের খাস এই দরবার চলাকালে বাইরের প্রহরীর সাথে কথা বলছে এক নগ্নপদ, হীনবস্ত্র মানুষ। সে নাকি সম্রাট হুমায়ুনের সাথে দেখা করতে চায়। কথা বলতে চায়। প্রহরী তাকে ঢুকতে দিচ্ছে না। অনেক আকুতি করছে লোকটি। সে দাবি করছে সম্রাট নাকি তাকে দেখামাত্র চিনবে। প্রহরীর বিশ্বাস হচ্ছে না। কিন্তু লোকটিও নাছোড়বান্দা।
কয়েকঘন্টা পরের দৃশ্য । আগ্রার দরবারের প্রত্যেক আমির, উমারা হতবাক, বিহবল হয়ে আছেন। কারণ হুমায়ুন নয়, সিংহাসনে বসে আছে ভিস্তিওয়ালা নিজাম নামের এক লোক। হুমায়ুন তাকে একদিনের সম্রাট বলে ঘোষনা দিয়েছেন। সবার উপর নির্দেশ জারি করা হয়েছে, নতুন বাদশাহ ভিস্তিওয়ালা নিজামের প্রতিটি নির্দেশ যেন যথাযথ আনুগত্যের সাথে পালন করা হয়। সবাই বেশ হতভম্ভ। এমন ঘটনা তো স্বপ্নেও কল্পনা করা যায় না! আর বাদশাহ হুমায়ুনের খেয়াল বড়ই আজীব!
সম্রাট হুমায়ুনের ভাই বোনেরা কোনোমতেই মেনে নিতে পারছেন না। এসব কী হচ্ছে? কামরান মির্জার হৃদয় পুড়ে যাচ্ছে। তার গোপন মনোবাসনা ছিল ভাই হুমায়ুনকে সরিয়ে সে সিংহাসনে বসবে। এজন্য তার অতীতের বহু চেষ্টা প্রচেষ্টা ব্যার্থ হয়েছে। আর আজ কিনা এক দরিদ্র ভিস্তিওয়ালা আগ্রার সিংহাসন দখল করে আছে। তাকে সম্মান করা হচ্ছে ঠিক সম্রাটের মতই।
কামরান মির্জা হয়ত ভাবছেন বড় ভাই হুমায়ুনকে বলবেন, হিন্দুস্তানের অধিপতির এমন কাজকর্ম যৌক্তিক নয়। শোভনীয় নয়। বড়োজোড় নিজাম নামের লোকটিকে স্বর্নমুদ্রা দিয়ে বিদায় করা যেত!
যাই বলা হোক, হুমায়ুন হয়ত উত্তর দেবেন, সব জায়গায় যুক্তি চলে না। যুক্তির চেয়ে হৃদয় বড়। আমি যে কথা ভিস্তি নিজামকে দিয়েছি, তার নড়চড় হবে না।
আসলেই বড় অদ্ভুত স্বভাবের মানুষ ছিলেন বাদশাহ হুমায়ুন। তার কথার নড়চড় হয় নি। ভিস্তিওয়ালা দরিদ্র এক মানুষকে তিনি তার কথামত একদিনের জন্য বানিয়েছিলেন হিন্দুস্তানের বাদশাহ।
দরিদ্র ভিস্তিওয়ালা নিজাম সিংহাসনে বসে আছে। তার মাথায় বাদশাহের মুকুট। সবাই তাকে বাদশাহর মতই সম্মান করছে। তামিল করছে তার হুকুম। রাজকর্মচারীরা বিস্ফোরিত নয়নে সহ্য করছেন সবকিছু । ব্যাপারটি অসহ্য হলেও কিছু করার নেই। আর একটা দিনের ব্যাপারই তো মাত্র।
তবে একজন ব্যক্তির কাছে কোনোভাবেই ভিস্তিওয়ালা নিজামের বাদশাহ হওয়ার ব্যাপারটি নিছক একদিনের খেলা মনে হচ্ছে না। সে রাগে ফুঁসছে। এই সিংহাসন দখল করতে সে কত ষড়যন্ত্রই না করেছে। সব ফাঁস হয়েছে। তার মহাক্ষমাশীল ভাই হুমায়ুন প্রতিবার তাকে মৃত্যুদন্ড থেকে নিস্তার দিয়েছে। তো কী হয়েছে! তার ভাই হুমায়ুন বাদশাহ হওয়ার যোগ্য নয়! বাদশাহকে হতে হয় কঠিন, কঠোর স্বভাবের। এই স্বভাব তার নিজের আছে। সে কামরান মির্জা। মহামতি বাবরের সন্তান কামরান মির্জা।
পরদিন রাজমহলে আবার চিরচেনা রূপ ফিরে এসেছে। সবকিছু স্বাভাবিক। রাজকর্মচারীরা নিজ নিজ কাজে ব্যাস্ত সময় পার করছেন। বাদশাহ হুমায়ুন আছেন বেশ খোশ মেজাজে। ভিস্তিওয়ালা নিজামকে তিনি তার সৎকর্মের বদলা দিতে পেরেছেন। দুটির গাধার পিঠ বোঝাই করা স্বর্নমূদ্রা, নিরাপত্তারক্ষীসহ তাকে তার দেশে ফেরার ব্যাবস্থা করা হয়েছে। উপকারীর প্রতিদান এভাবেই দিতে হয়।
গতদিনের অস্বস্তির পর আজ কামরান মির্জা কিছুটা স্বস্তি ফিরে পেয়েছেন । তার ব্যক্তিগত সেনারা চমৎকার একটি কাজ সম্পাদন করেছে। ডাকাত বেশে নির্জন জায়গায় ভিস্তিওয়ালা নিজামের কাফেলাকে আক্রমণ করেছে তারা । নিজামের নিরাপত্তারক্ষীরা আসল কাহিনী বুঝতে পেরে পালিয়ে গেছে। গাধার পিঠবোঝাই স্বর্ন মুদ্রা ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। ভিস্তিওয়ালা নিজাম নিহত হয়েছে। তার লাশ ফেলে দেয়া হয়েছে ভাগাড়ে।
ভিসতিওয়ালা নিজাম তার উচ্চভিলাস থেকেই সিংহাসনে আড়োহন করার সাহস দেখিয়েছিল। ভাগ্য একদিনের জন্য হলেও তাকে বানিয়েছিল বাদশাহ। উচ্চাভিলাস ছাড়াও হয়ত সম্রাট হুমায়ুনের প্রতি ছিল তার নিঃখাদ আস্থা, ভালোবাসা। কিন্তু এ সবকিছুই তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায় । কারণ সে তার মহামূল্যবান জীবনটাই হারিয়ে ফেলে। কিন্তু ইতিহাস তাকে হারিয়ে যেতে দেয় নি। ইতিহাসের পাতা থেকে ভিস্তিওয়ালা নিজাম হয়ত আজও চিৎকার করে বলছে, হে আগামীর মানুষেরা! তোমরা সাবধান হয়ে যাও! সবার প্রতি, সবকিছুর প্রতি সরল আস্থা রাখার ভুল কখনো করোনা। সব কিছু নিয়ে উচ্চাভিলাস কখনো খুবই আত্মঘাতি। বিশেষত ক্ষমতাকেন্দ্রিক উচ্চাভিলাস আর উচ্চাকাঙ্ক্ষা। সাবধান মানুষ! সাবধান!