Posts

গল্প

ফজু মিয়া

September 4, 2025

ইহতেমাম ইলাহী

41
View

ফজু মিয়া

দুপুর গড়িয়ে গেছে। সূর্য প্রায় হেলে পড়েছে। গ্রামের এক প্রান্তে থাকা টিনে ঘেরা বাড়িটিতে বিরাজ করছে শুনশান নিরবতা। ফজু মিয়া খালি গায়ে উঠানে বসে আছে। উদাস মনে বাড়ির পেয়ারা গাছটার দিকে তাকিয়ে কী যেন দেখছে সে। দৃষ্টিতে একটা ছন্নছাড়া ভাব। তার বড় ছেলেটা সজ্জাসায়ী, অসুস্থ্য । বিছানায় শুয়ে থেকে থেকে কেঁদে উঠছে সে। 

ফজু মিয়ার স্ত্রী সকাল থেকে কিছুটা শব্দ করে কাঁদছিল। এখন বোধয় কাঁদছে না, অথবা নিঃশব্দে কাঁদছে। ফজু মিয়া তার স্ত্রীর চলাফেরার শব্দ শুনছে। মাঝে মধ্যেই দুই সন্তানের মা– এই মেয়েটি কল পাড় যাচ্ছে। কী যেন ধুচ্ছে। আবার ঘরে যাচ্ছে। টুংটাং আওয়াজ হচ্ছে। মনে হচ্ছে সে কাজের মধ্যেই আছে। যদিও আজ তার কাজ থাকার কথা না। মেয়ে মানুষের কাজ বলতে তো রান্নাবাড়া করা। কিন্তু ঘরে আজ কিছু নেই যে রান্নাবাড়া হবে । ফজু মিয়ার ছোট বাচ্চাটি কোলের শিশু। এই বাচ্চাটিও হয়ত ঘুমিয়ে আছে। কারণ তার কান্না শোনা যাচ্ছে না। হঠাত কি ভেবে ফজু মিয়ার বুকটা ছ্যাত করে উঠল। সে ভাবল, এটা কি মাস? চৈত্র মাস। কত তারিখ এটা মনে পড়ছে না তার। সে স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করল,

   রিফাতের মা। আজি মাসের কত তারিখ?
  চৈত মাসের ১৭ তারিখ আজি।
  হামার (আমাদের) সুমাইয়ার আজি ৬ মাস হইছে না?
  হুম।

ফজু মিয়া হতভম্ভ হয়ে গেল। তার মনে হচ্ছে শরীরের উপর অতি ভারী কোনো কিছু চেপে বসেছে। সে না পারছে বসে থাকতে, আবার না পারছে উঠে দাঁড়াতে। তার পেটে ক্ষুধা জানান দিচ্ছে। সকালের দিকে তার ছেলেটা দুইটা বিচি কলা খেয়েছে শুধু । আর তারা স্বামী স্ত্রী আছে পানি খেয়ে। আজ মেয়েটার ৬ মাস হলো। সে এখন দুধের পাশাপাশি অন্য খাবার খেতে পারবে, কিন্তু আজ ঘরে কোনো খাবার নেই। ফজু মিয়ার অসহ্য বোধ হচ্ছে। 

দিনমজুর ফজু মিয়ার সংসারে দিন আনি দিন খাই অবস্থা। দুইবেলা ঠিকমত খাবার জোটে। এতেও আনন্দ ছিল। তার স্ত্রী বাড়ির উঠোনে হাস মুরগী পালত। এটা ওটা সবজি লাগাত। ভালোই দিন যাচ্ছিল তাদের। কিন্তু ছেলেটার হঠাৎ টাইফয়েড জ্বর হওয়ার পর থেকে সব এলোমেলো হয়ে গেল। হাসপাতাল, ডাক্তার, ওষুধ সব মিলে প্রচুর খরচ হলো। বাড়ির সব কিছু বিক্রি করে দিতে হলো। সে দিন পনের’ কোনো কাজে যেতে পারল না। ফলে বেশ ধার-দেনা হয়ে গেল। সেই দেনাও শোধ করা যায় নি ঠিকমত। দেনা শোধ করতে গেলে পেটের ভাত আর জুটছে না। এমনই অবস্থা তার।  এর ওর বাড়ি থেকে চাউল ধার করে এনে বেশ কয়েকদিন চলেছে। কিন্তু এভাবে আর কত দিন? মানুষের কাছে চাইতে গেলে তারা মুখ অন্ধকার করে ফেলে। তার স্ত্রী এজন্য আজ সকাল থেকে কাঁদছে। সে বলেছে, ছেলে-মেয়ে নিয়ে না খেয়ে মারা যাবে, তবু কারও বাড়ি যাবে না।

ফজু মিয়া সকাল থেকে এদিক ওদিক ঘুরে কোনো কাজ জুটাতে পারে নি। আশাহত হয়ে বাড়ি ফিরে এসেছে সে । তার ছেলেটা এখনও অসুস্থ্য, দূর্বল । ওষুধ তো দূরে থাক। তিন বেলা খাওয়াই জুটছে না তার। ফজু মিয়ার চোখের পেছনে হঠাৎ কষ্টের মত কি যেন ঝিলিক দেয়। চোখ পানিতে ভরে উঠতে চায়। কিন্তু সে শক্ত পোক্ত মানুষ। তার চোখে পানি আসে না। 


বাচ্চা মেয়েটা হঠাৎ কেঁদে উঠল। ফজু মিয়ার স্ত্রী তাকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়েছে। বাচ্চাটার কান্না থামছেই না। হয়ত ক্ষুধা লেগেছে তার। তার মা তাকে চুপ করানোর চেষ্টা করছে– কান্দে না মা, কান্দে না। ফজু মিয়া অবাক হয়ে খেয়াল করল, তার স্ত্রীর কন্ঠেও কান্না খেলা করছে। বাচ্চাটার কান্না চুপ হয়ে গেল একসময়। 

ফজু মিয়া তার স্ত্রীকে ডাকল। স্বামীর কথা শুনে ভদ্রমহিলা ঘর থেকে বাচ্চাসমেত বের হয়ে এল। ফজু বলল, রিফাতের মা! তোমরা কয়টা দিন রিফাতের নানার বাড়িতে গিয়া থাকো। আমি কাম কাইজ কইরা কিছু ক্যাশ করি। কি কও?
রিফাতের মা উত্তর দেয়, বাপের বাড়ি যে যামু, তার ভাড়ার টাকা কই? ছোট পোলাপান নিয়া হাঁইটা হাঁইটা যামু?   

স্ত্রীর কথা শুনে ফজু মিয়ার মেজাজটা চড়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে উত্তরে কি বলবে  খুঁজে পাচ্ছে না। তার স্ত্রীর কথা ভুলও না। আগামীকাল সে বাপের বাড়ি যাবে কিন্তু আজ কি তার ছেলেটা জ্বর গায়ে না খেয়ে থাকবে? মেয়েটার বয়স ৬ মাস হলো আজই। তার জন্য কোনো খাবার নাই। ফজু মিয়ার এত কষ্ট অনুভব হচ্ছে যে, তার শরীরের প্রতিটা কোষেই সেই কষ্টময় ব্যাথা অনুভূত হচ্ছে। অথচ কেমন পাথরের মত বসে আছে সে।


ফজু মিয়ার স্ত্রী তার পেছনে এসে দাঁড়াল। সে হয়ত কিছু বলতে চায়। ফজু মিয়া মাথা ঘোরাল না। 

ফজু মিয়ার স্ত্রী বলল, ভাড়ার টাকাটা জোগাড় করে দেন। কাইল সকাল সকাল রিফাতের নানার বাড়ি যামু। আপনে কয়টা দিন কষ্ট কইরা থাকেন। 

স্ত্রীর সহজ কথাগুলো শুনেও ফজু মিয়ার রাগ হচ্ছে। অথচ রাগ হওয়ার মত কথা তার স্ত্রী বলে নি। মনে চাচ্ছে দু কথা শুনিয়ে দেয়। 

ফজু মিয়া  ঘরে গিয়ে একটা শার্ট গায়ে দিল। 

তার স্ত্রী জিজ্ঞেস করল, কই যান? 
ফজু মিয়া উত্তর দেয় না। সে হনহন করে বাইরে বেড়িয়ে যায়। 

ফজু মিয়ার স্ত্রী দেখছে তার স্বামীর চেহারা শুকনো, চোখগুলো রক্ত বর্ণ। শুন্য ক্ষুধার্ত পেট নিঃশ্বাসের সাথে উঠানামা করছে। স্বামীর জন্য তার মায়া অনুভব হয়। 


ফজু মিয়া যাচ্ছে গ্রামের ছোট বাজারটার দিকে। ওখানে গিয়ে বসে থাকবে। এ ছাড়া আপাতত কোনো কাজ নেই। সন্ধ্যা হলে সেখানে কৃষাণ, মজুর শ্রেণির লোকেরা আসে। চা খায়, আড্ডা দেয়। দল বেঁধে এটা সেটা গল্প করে। হয়ত তাদের কাছে কোনো কাজের খবর পাওয়া যাবে। ভাগ্য ভালো থাকলে হয়ত আগামীকালের কাজ মিলে যাবে। ফজু মিয়া দ্রুত পায়ে হাঁটছে। তার দৃষ্টি মাটির দিকে নিবদ্ধ। 

ফজু মিয়ার পেটে ক্ষুধা জানান দিচ্ছে। তার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। ছোট মাসুম বাচ্চা ছেলেটার জন্য রাতের কি খাবার জোগাড় করা যায়, তার মাথায় আসছে না।  স্ত্রী, পুত্র-কন্যার শুকনো মুখ হঠাত তার চোখে ভেসে উঠে । ফজু মিয়ার অন্তর খুবই বিগলিত হয়ে পড়ে। তার কান্না আসছে। সে হঠাত কি মনে করে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল।  

এই ফজু মিয়া! কে যেন ডাকল। কোনো মহিলার কণ্ঠস্বর। 
ফজু মিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। দেখল ওজুমা বু’জি (দাদি) ডেকেছে। ফজু এগিয়ে গেল।
    এই ফজু! কিছু কাঠ আছে চিড়ে (ফেঁড়ে) দিতে পারবি? দেড়-দুই মণ হবে। চিড়ে দে, ১০০ টাকা নিস!
ফজু মিয়ার চেহারা হঠাৎ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। সে জিজ্ঞেস করে, দের দুই মণ? বৃদ্ধা জবাব দেয়, আরো আছে। আইজ পারবি না। কাইল চিড়িস (লাকড়ির জন্য ফেঁড়ে দেয়া) একসময়। 
ফজু উত্তর দেয়, বু’জি আড়াই-তিন মণ আইজ চিড়ে দিমু। দুইশটা টাকা দিবেন। কাইল কোন কাইজ-কাম থাকে, কাইলকার কথা কওন যায় না। 
বৃদ্ধা জবাব দেয়, আচ্ছা। আয়, কাঠ গোলাঘরে আছে। সব বের কর ধীরে ধীরে। ফজু বলে, আচ্ছা।

কুড়ালের ফলাটি মধ্যম আকৃতির। চকচকে ফলা। বাঁশের শক্ত লাঠির হাতল পরানো হয়েছে। ফজু মিয়া উল্টে পাল্টে দেখল কুড়ালটা। “হেইরে আল্লাহর নাম!” বলে কুড়ালটা মাথা বরাবর উঠিয়ে দিল এক কোপ। লাকড়ি ফাঁড়ি করা শুরু হয়ে গেছে । ধুপ ধাপ আওয়াজ হচ্ছে। ওজুমা বু’জি দূরে দাঁড়িয়ে আছে। কাঠের টুকরা দ্রূত বেগে ছিটকে আসে কখনো কখনো। এজন্য সাবধান থাকতে হয়। কাঠগুলো চেড়াই করা হচ্ছে তীব্র গতিতে। গরম লাগছে ফজুর। সে শার্ট খুলে ফেলল। কুড়াল উঠালো। দিল এক কোপ। বৃদ্ধা বলে উঠল, কিরে ফজু, কিছু খাইস নাই রে? পেট দেখি হ্যাক হ্যাক করে তোর। এই শরীলে (শরীরে) কুড়াল চালাচ্ছিস কি মনে করে? 

ফজু হাসে। তার কুড়াল চালানো থামে না। তার হাসি চেহারায় ছড়িয়ে যায়। এই হাসিতে বিষাদ বা কষ্ট মিশে নেই। বরং নিঃখাদ আনন্দ বোঝা যায়। না খাওয়া শরীর তার কেমন যেন দুলছে, ঝিম ঝিম লাগছে। এই ঝিম ঝিম দুলুনি তার কুড়াল চালানোয় নতুন একটা ছন্দ এনে দিচ্ছে। 

ঘন্টা পেরিয়ে যায়। ফজু মিয়া থামে না। তার দৃষ্টি মোটা মোটা কাঠে নিবদ্ধ। কুড়াল উঠছে, সজোরে আছড়ে পড়ছে কাঠের উপর। দু ভাগ হয়ে যাচ্ছে নিমিশেই। ফজু  মিয়া কাজে নিমগ্ন। তার নিমগ্ন চোখ দুটিতে আনন্দময় এক স্বপ্ন খেলা করছে। সেই স্বপ্নে আজ রাতে তার স্ত্রী পুত্র পেট ভরে খাবার খায়। তার সদ্য ৬ ছয় মাসে পা দেয়া শিশু কন্যাটির বাড়তি খাওয়ার সূচনা হয়। আনন্দময় এই স্বপ্নদৃশ্য ফজুকে আচ্ছন্ন করে রাখে। তার কুড়াল চালানোর গতি বাড়তে থাকে। 





 

Comments

    Please login to post comment. Login