Posts

গল্প

অশ্রুজলের যোদ্ধা

September 4, 2025

ইহতেমাম ইলাহী

43
View

 যোদ্ধা

 

খ্রিষ্টীয় ১২’শ শতাব্দির কোনো একটা সময়। মিশরের ফাতেমী (মূলত উবায়দী) খলীফা আল আযিদ শাসন করছেন। তিনি ধর্মে কট্টোর শিয়া। আহলুস সুন্নাহর আলিম আর সাধারণ জনগনের উপর তার পূর্বসূরীরা চালিয়েছে নির্মম নির্যাতন। ইসলামের মত পবিত্র ধর্মে অনেক কাটছাঁট করা হয়েছে। ধর্মের নাম করে নানান অশ্লীল-ফাহেশা কর্মকান্ড সমাজে ছড়িয়ে পড়েছে । আযানের ‘হাইয়া আলাল ফালাহ’ বাক্যের পরিবর্তে ‘হাইয়া আলাল খইরিল আমাল” বাক্য বলার নির্দেশ জারি করা হয়েছে। মুসলিম মুয়াজ্জিনরা বুকে পাথর চাপা দিয়ে এই আদেশ মেনে চলছেন। অন্যথায় তাদের হত প্রাণদন্ড। 


খলীফা আযিদ যখন শাসন করছেন, তখন তাদের উবাইদি শিয়া সম্রাজ্য শুধুমাত্র মিশরে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এশিয়া মাইনরের সিংহবত বীর যোদ্ধা ও বিশুদ্ধ ইসলাম ধারণকারী সুলতান আল্প আরসালান ও তার বংশীয় সালজুকদের  মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা তাদের রাজ্য সংকীর্ন করে তুলেছেন। মিশরেরর শিয়া শাসন এখন নাজুক অবস্থায় পতিত হয়েছে। খলীফা আযিদ অত্যন্ত বৃদ্ধ। তার প্রধান উজির শাওয়ারই মূলত দেশ চালাচ্ছে। শাওয়ার লোকটা ছিল মজ্জাগত বজ্জাত আর মুনাফিক। শয়তানী, চুক্তি ভঙ্গ, জিঘাংসা ইত্যাদি তার স্বভাব। মিশরের জনগন আর অন্যান্য উজির, দায়িত্বশীলরা সবাই তার প্রতি ক্ষিপ্ত। কিন্তু লোকটি তার সুচতুর ছলনা দিয়ে নিজের স্বার্থ টিকিয়ে রাখছে। 

খ্রিষ্টান ক্রুসেডাররা মিশরের এই নাজুক অবস্থা জানত। তার ভাবছিল এই অবস্থায় মিশর দখল সহজ হবে। তাই তারা দখলকৃত শামের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিশাল সেনাবাহীনী আর ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে মিশরের উদ্দেশ্যে রওনা দিল। মিশরের জনগন চিন্তিত হয়ে পড়ল।  চিন্তিত হলো খলীফা আযিদ। তিনি শাওয়ার উপর দেশ রক্ষার ব্যাপারে ভরসা করতে পারছিলেন না। তিনি গোপনে শামের মুসলিম ভুমির কেন্দ্রের শাসনকর্তা মহান নুরুদ্দীন জেংগির নিকট সাহায্য চাইলেন। যদিও এই নুরুদ্দীন শিয়া আকীদার কট্টোর বিরোধী । কিন্তু ক্রুসেডারদের হাতে বলি হওয়া থেকে নুরুদ্দীনের সাহায্য নেয়া ছাড়া আপাতত উপায় নেই। 

নুরুদ্দীন (রহ) সেনা সহায়তা পাঠাতে সম্মত হলেন । তাঁর প্রধান সেনাপতি আসাদুদ্দীন নেতৃত্ব দেবেন সেনাবাহিনীর। সেনাপতি আসাদুদ্দীনের সাথে যুক্ত হয়েছিল তার আপন ভাতিজা । নাম তার সালাহুদ্দীন। 

দিনের পর দিন গড়াল। মাসে পর মাস। মিশরের ত্রিমুখী যুদ্ধে অনেক জল গড়াল। যুদ্ধ ও কুটনীতি শত্রুতা, মিত্রতার গতিপথ অনেক দিকে মোড় নিল। শাওয়ার তার স্বভাবজাত শয়তানী চাল দিচ্ছিল শুরু থেকেই । ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে মিশরকে সাহায্যকারী শামের মুসলিম বাহিনীকে মিশর থেকে কৌশলে বের করে দেয়ার পায়তারা করছিল সে । সে সুযোগ বুঝে শামের বাহিনীকে বিপদে ফেলে তাদের পেছনে ক্রুসেডারদের লেলিয়ে দিল। ক্রুসেডাররাও সুযোগ হাতছাড়া করতে নারাজ।

শামের বাহিনী বেশ বিপত্তিতে পড়ে গেল। তাদের সেনা ছিল ভাগ করা। এই ফ্রন্টে সেনা খুবই কম। অন্তত ক্রুসেডারদের তুলনায় অনেক কম। বাহিনীর অন্যতম দায়িত্বে ছিলেন তরুন সালাহুদ্দীন। আমিরদের অনেকেই তাকে যুদ্ধ না করার পরামর্শ দিল। সেনাস্বল্পতার কথা তুলে ধরল। ভিন্ন পন্থা অবলম্বনের প্রস্তাব করল। সালারদের দেখা দিল মতভেদ । যুদ্ধসভা শেষ হচ্ছিল না। অবশেষে আলাপ-আলোচনার  এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলো যুদ্ধ হবে।  যুক্তি– মুসলিমরা সংখ্যার উপর নির্ভর করে না। বরং নির্ভর করে আল্লাহর সাহায্যের উপর। সঠিক নিয়্যতে ও কৌশলে যুদ্ধ করাই আসল ব্যাপার। তরুন সেনাপতি সালাহুদ্দীনের এটাই মত।


 

ক্রুসেডাররা ছিল উতফুল্ল। তাদের বিশাল বাহিনী তাদের মনোতৃপ্তির কারণ। তারা ভাবছে মুসলিমদের এবার কচুকাটা করা হবে। শামের সুলতান নুরুদ্দীনকে উচিত শিক্ষা দেয়া হবে। আর দেরি নয়, দ্রুত এগিয়ে চল। দ্রুত। 

মুসলিম শিবিরে সেনা স্বল্পতা সত্যিই প্রকট হয়ে দেখা দিল। সেনাদের তিনটি ভাগ করে ডান বাহু, মধ্যভাগ ও বাম বাহুতে সাজানো হলো। পেছনে কিছু দূরে সেনাদের বিশেষ একটা অংশ লুকিয়ে থাকল। 

যুদ্ধ শুরু হল। ক্রুসেডাররা প্রবল আক্রোশ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল মুসলিম বাহিনীর উপর। মুসলিম বাহিনীর মধ্যভাগ অল্প কিছুক্ষণ যুদ্ধ করেই পরাস্ত হওয়ার ভঙিতে পিছুটান দিল। পালানোর ভান । ডানভাগ, বাম ভাগও একটা জ্যামিতিক বৃত্ত অনুসরণ করে পালাতে লাগল। ক্রুসেডারদের আনন্দ তখন দেখে কে! তারা তাদের সেনাবিন্যাস এলোমেলো করে দিয়ে মুসলিমদের পিছু ছুটতে লাগল যে যেভাবে পারে। দুই বাহিনীই ছুটছে। ছুটছে তো ছুটছে। 

মুসলিম বাহিনী দৌড়াতে দৌড়াতে একটা বিশেষ এলাকায় এসে পৌঁছাল, যেখানে তাদের বিশেষ ইউনিটি লুকোনো আছে। কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী মুসলিম বাহিনীর ডান, বাম, মধ্যভাগ আর রিজার্ভ ফোর্স ঘুরে দাঁড়াল। হঠাৎ। ক্রুসেডার বাহিনী এলোমেলো দৌড়ে আসছি। অন্যদিকে মুসলিমদের বিন্যাস ছিল খুবই গোছানো। তারা প্রবল বিক্রমে ক্রুসেডারদের উপর হামলে পড়ল। ক্রুসেডার বাহিনী হঠাত করেই চোখে সরষে ফুল দেখতে লাগল। এ কি! সম্মিলিত মুসলিম বাহিনীর আক্রমন তারা ঠেকাতে পারছে না। সময় গড়াচ্ছে। যুদ্ধটা হয়ে যাচ্ছে একপেশে। সিরিয়ান তলোয়ার-তীরের আঘাতে ক্রুসেডার সেনারা কাতারে কাতারে লাশে পরিণত হচ্ছিল। বেলা গড়ানোর সাথে সাথেই যুদ্ধের ফলাফল স্পষ্ট হয়ে উঠল। মুসলিম বাহিনী বিজয় লাভ করল। তারা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল। ক্রুসেডার বাহিনীর অনেকে পালিয়ে জান বাঁচাল। 

এই যুদ্ধটি মিশরের ইতিহাস পাল্টে দেয়। মুসলিমরা নতুন করে মিশরে প্রবেশ করে এবং শাওয়ারকে হটিয়ে দেয়। এবং কিছু বছর পর খলিফা আযিদের মৃত্যু হলে ফাতেমী উবায়দি খিলাফাতের সমাপ্তি ঘটে। মিশরের সুলতান হন তরুন সালাহুদ্দীন আইউবী (রহ)।


 

ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়, বড় বড় যোদ্ধারা কখনো নিজেদের সক্ষমতা নিয়ে অহংকারে পতিত হন। ফলাফল হয় লজ্জার হার। তারা ভুলে যান শক্তির প্রদর্শন আর আগ্রাসী নীতি সবসময় ভালো যুদ্ধ কৌশল হতে পারে না। 


মিশর বিজয়ের অনেক বছর পর। সুলতান সালাহুদ্দীন (রহ) শাম এলাকা থেকে ক্রুসেডারদের তাড়ানোর মিশনে নেমেছেন। অসংখ্য ফ্রন্টে যুদ্ধ চলছে। আল্লাহর করুনায় মুসলিমরা সফল হচ্ছে। এমনই কোনো এক সময়  সুলতান সালাহুদ্দীন সামান্য কিছু সেনাসহ একটি ঘাঁটিতে অবস্থান করছেন। হঠাৎ খবর পেলেন সমুদ্রপথ দিয়ে শত্রুদের বড় এক বাহিনী তার দিকে এগিয়ে আসছে। যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে আগামী দিনই। আশপাশ থেকে এত কম সময়ের মধ্যে সৈন্য সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনাও কম। তিনি নিজের সেনাস্বল্পতা অনুভব করলেন। শত্রুদের হঠাৎ আগমণ তার প্রত্যাশিত ছিল না। ইশার নামাজে সময় হলো। সুলতান ইশার নামাযে অংশ নিলেন। নামাজের পর আল্লাহর নিকট দুআ করা শুরু করলেন । তার দুআ দীর্ঘক্ষণ ধরে চলতে লাগল। তিনি আল্লাহর কাছে রোনাজারি করছিলেন, তার চোখ বেয়ে পানি পড়ছিল। মুসল্লীরা যার যার অবস্থানে রাত কাটানোর জন্য ফিরে গেল। ফজরের পূর্বে সুলতানের বন্ধু আবার ফিরে এলেন। তিনি সুলতানকে সিজদাহরত অবস্থায় দেখতে পেলেন। তার দাড়িগুলো ছিল ভেজা, সিজদাহর জায়গাও পুরোটা ভিজে গেছে। ফজরের সময় হয়ে এল। সুলতান ফজরের নামাজের প্রস্তুতি নিলেন। বার্তাবাহক খবর নিয়ে এলো। সবাই সংবাদ শুনতে উৎকর্ণ হলো। বার্তাবাহক জানাল, “রাতে সমুদ্রের তুফানে শত্রুদের সব জাহায ডুবে গেছে, শত্রুবাহিনী সমূলে ধংস হয়ে গেছে।” বার্তাবাহকের কথা শুনে সবার চেহারায় আনন্দের আভা ছড়িয়ে পড়ল। দুশ্চিন্তা রেখা বিদূরিত হলো। মুসলিমদের প্রতি আল্লাহর এই বিশাল গায়েবী সাহায্যে সবাই অনেক আপ্লুত হয়ে পড়ল। তারা আল্লাহর যথাযথ শুকরিয়া আদায় করলেন। 


                                    




 

Comments

    Please login to post comment. Login