"এই শাড়িটা পরো না, রাইসা। পেটের কাছটা কেমন যেন বিশ্রী লাগছে। আলমারিতে তোমার বিয়ের আগের নীল জামাটা তো আছে, ওটা পরলে তোমাকে ঠিক আগের মতো লাগবে।"
স্বামীর কথাটা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রাইসার বুকে ধারালো কাঁচের মতো বিঁধে গেলো। ছয় মাস আগে তাদের সন্তানের জন্ম হয়েছে। এরপর থেকে এই 'আগের মতো' শব্দটা সে প্রতিনিয়ত শুনে আসছে। তার স্বামী আকাশ চায় সে যেন একদিনের মধ্যেই আগের সেই নিখুঁত চেহারায় ফিরে যায়।
আকাশ আবার বললো,
"কাল অনুষ্ঠানে সবাই থাকবে। আমি চাই না কেউ তোমার স্বাস্থ্য নিয়ে আড়ালে কথা বলুক। আমি তোমার ভালোর জন্যই বলছি।"
'ভালোর জন্য বলা' কথাগুলো যে কতটা বিষাক্ত হতে পারে,তা রাইসা প্রতিদিন অনুভব করছিলো। তার শরীরের পরিবর্তনগুলো, মাতৃত্বের চিহ্নগুলো সবকিছুই যেন আকাশের চোখে এক একটা ‘সমস্যা’।
রাইসা কোনো কথা না বলে ধীর পায়ে তাদের শোবার ঘরের দেয়ালে টাঙানো ছবিটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। এটা তাদের বিয়ের পরের ছবি। ছবিতে রাইসার কোমরটা সরু, শরীরে কোনো দাগ নেই। মুখে নিশ্চিন্তির হাসি। আকাশ প্রায়ই এই ছবিটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
আজ রাইসার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেলো। সে দেয়াল থেকে ছবিটা নামিয়ে আনলো। তারপর সেটা হাতে নিয়ে আকাশের সামনে দাঁড়িয়ে শান্ত গলায় বললো,
"এই ছবির মেয়েটাকে তুমি খুব ভালোবাসো, তাই না আকাশ?"
আকাশ একটু অবাক হয়ে বললো, "মানে? ওটা তো তুমিই।"
"না, ওটা আমি নই।"
রাইসার গলাটা কেঁপে উঠলো।
"ওটা তোমার কল্পনার সেই মেয়েটা, যার শরীরে কোনো দাগ নেই।যার ঘুমটা শান্তির, যার জীবনে কোনো দায়িত্ব নেই। কিন্তু ওই ছবির মেয়েটা আমাদের সন্তানকে জন্ম দিতে পারতো না, আকাশ।"
রাইসা নিজের পেটের উপর হাত রেখে বললো,
"আমার শরীরের এই দাগগুলো, এই পরিবর্তন... এগুলো কোনো অসুখ নয় যে লুকিয়ে রাখতে হবে বা লজ্জা পেতে হবে। এগুলো একটা যুদ্ধের চিহ্ন। নয় মাস ধরে একটা নতুন প্রাণকে নিজের ভেতরে তিল তিল করে তৈরি করার যুদ্ধ। নির্ঘুম রাতের যুদ্ধ। অসহ্য যন্ত্রণাকে সহ্য করার যুদ্ধ। এই দাগগুলো আমার মাতৃত্বের পদক। আর তুমি আমার এই পদকগুলোকে 'বিশ্রী' বলছ?"
আকাশ স্তব্ধ হয়ে স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।
রাইসা ছবিটা টেবিলের উপর রেখে দিয়ে বললো,
"তুমি একজন নিখুঁত পুতুল চেয়েছিলে, আকাশ। কিন্তু আমি একজন মা। আমার শরীরটা এখন আর শুধু আমার নয়, এটা আমার সন্তানের প্রথম ঘর। এই ঘরের দেওয়ালে যে চিহ্নগুলো তৈরি হয়েছে, তা পৃথিবীর সবচেয়ে পবিত্র চিহ্ন।"
সে তার মোবাইল থেকে একটা ছবি বের করলো। যেখানে ক্লান্ত, এলোমেলো রাইসা তার সদ্যোজাত সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে। সেই ছবিতে তার শরীরটা নিখুঁত নয়, কিন্তু তার মুখের হাসিটা স্বর্গীয়।
ছবিটা আকাশের সামনে ধরে সে বললো,
"তুমি যদি এই ছবির মেয়েটাকে ভালোবাসতে পারো, তাহলেই আমাদের সম্পর্কটা টিকবে। যে মেয়েটা তার সন্তানের জন্য নিজের শরীরকে বাজি রাখতে পারে, তাকে সম্মান করতে শেখো। কারণ ওই দেয়ালের ছবির মেয়েটা তোমাকে শুধু প্রেম দিতে পারতো, কিন্তু এই আমি তোমাকে একটা পরিবার দিয়েছি।"
আকাশের বলার মতো কোনো ভাষা ছিলো না। তার চোখের সামনে এতদিনের জমে থাকা সৌন্দর্যের ভুল ধারণাটা চুরমার হয়ে গেলো। সে দেখছিলো, তার সামনে তার স্ত্রী দাঁড়িয়ে নেই, দাঁড়িয়ে আছে তার সন্তানের জননী। একজন যোদ্ধা। তার চোখে তখন শুধু শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা।
একটা মেয়ের মাতৃত্বের চিহ্নগুলোকে যে পুরুষ ভালোবাসতে পারে, সে শুধু স্বামী নয়, একজন সত্যিকারের জীবনসঙ্গী। নারীর শরীর কোনো সাজানোর বস্তু নয়, তা নতুন জীবন সৃষ্টির আঁধার। এই সত্যটা যেদিন সব পুরুষ বুঝতে পারবে, সেদিন আর কোনো নতুন মা'কে 'আগের মতো' হওয়ার জন্য চোখের জল ফেলতে হবে না।
(সমাপ্ত.....)