Posts

চিন্তা

ধর্ম-গাধার পৃষ্ঠে এখানে শূন্য পুণ্য-ছালা

September 6, 2025

ফারদিন ফেরদৌস

137
View

মহাত্মা লালন ফকির তাঁর কালামে বলেছেন, 
মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি
মানুষ ছেড়ে ক্ষ্যাপারে, তুই মূল হারাবি। 

কায়মনোবাক্যে এই বিশ্বাস আমরা রাখি যে, 
সবার আগে সভ্য ও সহজ মানুষ হওয়া জরুরি! কিন্তু আজকালকার বাংলাদেশে এই কথা বলা যেন ভয়, আতঙ্ক, শঙ্কা আর ভ্রান্তির কঠিন মেলবন্ধন। এখানে প্রায় সবাই প্র্যাকটিস করছে, কে কত বেশি অমানুষ হতে পারে! কে কার চেয়ে কত বেশি নিচে নামতে পারে! নৃশংস হতে পারে! 

মানুষের মধ্যে এত ঘৃণা ও জিঘাংসা থাকে একশ্রেণীর বাঙালি মুসলমানকে না দেখলে বিষয়টার উদাহরণ তৈরি হতো না। প্রায় ২ সপ্তাহ আগে মারা যাওয়া ব্যক্তির লাশ কবর থেকে তুলে এনে আরক্ষাবাহিনীর সামনে জনসমক্ষে পুড়ায়ে ফেলা হলো। তার আগে টেনেহিঁচড়ে মুখে, গায়ে, লাঠিপেটা করা হলো। জুতা মারা হলো। অভিযোগ হলো তার কবর নাকি ইসলামী রীতিনীতি মেনে হয়নি। সবাই যদি নিখাদ ইসলাম মানত তাহলে সাড়ে আটশ কোটি মনুষ্যের মধ্যে মুসলিম মাত্র দেড়শ কোটি কেন? 

সবচেয়ে দুঃখজনক সত্য হলো সভ্যতা, মানবতা ও ধর্মবিরোধী এই অপকর্মের সাথে যারা জড়িত, তাদের নামের সাথে বেশ কয়েকজন বিএনপি অ্যাক্টিভিস্টের নাম এসেছে। বিএনপির মতো বড় দলের লোকজন এতটা উগ্র, গোঁড়া, ধর্মান্ধ ও চরমপন্থী হতে পারে -এটা অবিশ্বাস্য। 

এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন, 'অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গোয়ালন্দে নুরুল হক মোল্লা, যিনি নুরাল পাগলা নামেও পরিচিত, তাঁর কবর অবমাননা ও মরদেহে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানায়। এই অমানবিক ও ঘৃণ্য কাজটি আমাদের মূল্যবোধ, আমাদের আইন এবং একটি ন্যায়ভিত্তিক ও সভ্য সমাজের মৌলিক ভিত্তির ওপর সরাসরি আঘাত। 

এই ধরনের বর্বরতা কোনো অবস্থাতেই সহ্য করা হবে না। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আইনের শাসন সমুন্নত রাখতে এবং প্রতিটি মানুষের জীবনের পবিত্রতা, জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পরেও রক্ষা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। 

আমরা জনগণকে আশ্বস্ত করছি যে এই জঘন্য অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করা হবে এবং আইনের সর্বোচ্চ প্রয়োগের মাধ্যমে বিচারের আওতায় আনা হবে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে নয়। যারা এই ঘৃণ্য কাজের সঙ্গে যুক্ত, তাদের উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে দ্রুত ও কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।' 

যেহেতু গেল ১৪ মাসে এমনধারার কোনো অপরাধীর শাস্তি হতে আমরা দেখিনি। এর আগেও সারাদেশে শতাধিক মাজার ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ ও বিনষ্ট করা হয়েছে। কোনোটারই সুরাহা হয়নি। কাজেই গোয়ালন্দের এই ঘটনায় জড়িতরাও রাষ্ট্রীয় নির্লিপ্ততায় পার পেয়ে যাবে এমনটাই অনুমান করি। জীবিত জান ও মালের কথা নাইবা বললাম, মৃতদেহের সুরক্ষা দেয়ার সক্ষমতা যেকোনো সরকারের থাকা উচিত। 

মৃতদেহের সম্মাননা বিষয়ে আমাদের ধর্মশাস্ত্র কী বলে? পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ সুবহানাহু তাআলা বলেন- “তোমরা সীমালঙ্ঘন করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালঙ্ঘনকারীদের ভালোবাসেন না।” (সুরা বাকারা ২:১৯০)। আলেমরা বলেন, মৃতদেহ বিকৃত করা সীমালঙ্ঘনের মধ্যে পড়ে। 

অপরদিকে রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন: “মৃতদেহ বিকৃত করো না।” (সহিহ মুসলিম, হাদিস ১৭৩১)। যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত শত্রুর লাশকেও বিকৃত করা ইসলামে নিষিদ্ধ। 

মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলার ব্যাপারে রাসূল (সা.) বলেছেন: “আগুন দ্বারা শাস্তি দেওয়া শুধুমাত্র আগুনের প্রভুর (আল্লাহ্'র) কাজ।”(সহিহ বুখারি ৩০১৬, সহিহ মুসলিম ১৭৩০)।  অর্থাৎ, মানুষকে জীবিত বা মৃত অবস্থায় পুড়িয়ে ফেলা হারাম। মৃতদেহ দাহ (cremation) ইসলামে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। 

চার মাযহাবের আলেমগণ সর্বসম্মতভাবে বলেন, মৃতদেহ বিকৃত করা (mutilation) সম্পূর্ণ হারাম, তা মুসলিম হোক বা বিধর্মী -কারণ রাসূল (সা.) বদরের যুদ্ধের পর এ কাজ নিষিদ্ধ করেছেন। মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলা (cremation) চার মাযহাবের কাছেই কবিরা গুনাহ, কারণ আগুন দ্বারা শাস্তি দেওয়া কেবল আল্লাহ্'র এখতিয়ার, মানুষের নয়। ইসলামী ফিকহ্শাস্ত্রের ধারক হানাফি, শাফেয়ি, মালিকি ও হাম্বলি -সব মাযহাবের এককথা হলো: মানুষ জীবিত থাকুক বা মৃত, তার শরীরের প্রতি সম্মান বজায় রাখা অপরিহার্য। 

তাহলে নুরাল পাগলার মৃতদেহের ওপর ৫৪ বছরের বাংলাদেশের ইতিহাসে কথিত মানুষ নামধারী যারা সবচেয়ে বর্বরোচিত নৃশংসতা দেখালেন -তারা আসলে কোন ধর্ম পালন করলেন? পৃথিবীতে ধর্ম এসেছে মানুষের জন্য। মানুষকে সত্য, সুন্দর ও সহজ পথ দেখানোর জন্য। গোয়ালন্দের ঘটনায় জড়িয়ে যারা মানুষ নাম মুছে দিয়ে পাতকের পদ গ্রহণ করলেন -তাদেরকে দিয়ে ধর্মের কী কাজ? সর্বোচ্চ শুদ্ধাচার, সহনশীলতা, সংবেদনশীলতা, প্রেম ও মায়া-মমতা দিয়ে যদি মানুষ নাম রোশনাই করা না যায় - সমাজ, মানুষ, রাষ্ট্র ও সভ্যতার জন্য ক্ষতিকর আগাছার মতো ওই অমানুষ দিয়ে ধর্মের আদৌ কোনো কাজ নেই। নুরাল পাগলার ওপর আপনারা যা করলেন, তাতে ওই পাগল মানুষটিই সত্য বলে প্রতিভাত হলেন -আপনারাই হারিয়ে গেলেন কালের গর্ভে। বিশ্বজুড়ে বেশি মানুষ আপনাদেরকেই নিন্দামন্দ করছেন। যত ঘৃণা দেখাতে চাইলেন নুরাল পাগলার ওপর -তারচেয়ে শত সহস্রগুণ ঘৃণা আপনারাই কুড়ালেন। 

অথচ দেখেন, নুরাল পাগলার পরিবার, ভক্ত ও অনুসারীরা বলে দিলেন, 'অভিযোগ করব কার কাছে? আমরা অভিযোগ করব না। আমরা মানবধর্ম করি। আমাদের কাছে সবাই আসে। সবাইকে মাফ করে দিলাম। আল্লাহ্ও যেন তাদেরকে মাফ করে দেন। তারা ভেঙে খুশি হয়েছে, হোক।'


ইসলামের ইতিহাসে যুগে যুগে উগ্রবাদী মুসলিমদের হাতে নিহত উল্লেখযোগ্য সুফি-দার্শনিকদের মধ্যে আছেন মানসুর আল-হাল্লাজ (৯২২, বাগদাদে “আনাল হক” বলার জন্য), আয়ন আল-কুদাত হামাদানি (১১৩১, মতাদর্শগত বিরোধে মৃত্যুদণ্ড), শেহাবউদ্দীন সোহরাওয়ার্দী (১১৯১, আলেপ্পোতে দার্শনিক মতবাদ প্রচারের কারণে হত্যা), শাহ ইনায়েত সাইন্দ (১৭১৮, সিন্ধে কৃষক আন্দোলনের কারণে ফাঁসি) প্রমুখ, যাদের সবাই প্রচলিত শরিয়াভিত্তিক ও রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করায় চরমপন্থী ও ক্ষমতাসীনদের হাতে প্রাণ হারান। উগ্রপন্থী মুসলিম কর্তৃপক্ষ বা গোষ্ঠী পুড়িয়ে হত্যা করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো মানসুর আল-হাল্লাজের মৃত্যু। তাঁকে বাগদাদের আব্বাসীয় খলিফার আমলে ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর বিখ্যাত উক্তি ছিল “আনাল হক” (আমি সত্য), যা মূলধারার আলেমরা কুফরি মনে করেন। পরে তাঁকে দীর্ঘ কারাবাসের পর প্রকাশ্যে প্রথমে চাবুক মারা হয়, তারপর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে ফেলা হয়, শেষে দেহ পুড়িয়ে ছাই নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। 

কিন্তু কবর থেকে তুলে কোনো সুফিবাদ চর্চাকারীর মরদেহ পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা একেবারেই বিরল। 

আমাদের বর্তমান সমাজ বাস্তবতায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের 'পাপ' কবিতাটি সবারই উচিত হবে বারবার পড়া এবং অনুধাবন করা।
ধর্মান্ধরা শোনো,
অন্যের পাপ গনিবার আগে নিজেদের পাপ গোনো!
ধর্ম-গাধার পৃষ্ঠে এখানে শূন্য পুণ্য-ছালা
হেথা সবে সমপাপী,
আপন পাপের বাটখারা দিয়ে অন্যের পাপ মাপি! 

পূর্ণিমার চাঁদ ঠেলে অমাবস্যার বন্দনায় যারা মেতেছেন, অন্ধকারকে যারা সারথি করে নিয়েছেন। সূর্যালোক ভুলে গ্রহণের কলঙ্কের সাথে যারা সখ্য গড়ে নিয়েছেন, যাদের একমাত্র আরাধ্য পৈশাচিকতা এবং বিশেষত শয়তানের কাছে যারা আত্মা বিক্রি করে দিয়েছেন -তাদেরকে বলব পবিত্র কুরআনের ফিলোসফি অনুধাবন করে মহান স্রষ্টার কাছে এই প্রার্থনাটুকু করতে, 'আমাদেরকে সরল পথের হিদায়াত দিন (সুরা ফাতিহা ১:৬)। 

লেখক: সাংবাদিক 
৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫
 

Comments

    Please login to post comment. Login

  • Chameli Akter 2 months ago

    আল্লাহ আমাদেরকে হেদায়েত দান করুন। আমিন