বাংলাদেশ কি গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে?
বাংলাদেশের বর্তমান সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতি উদ্বেগজনক মোড় নিচ্ছে। আমরা লক্ষ্য করছি, গৃহযুদ্ধ বা সিভিল ওয়ার লাগানোর জন্য যেসব উপাদান প্রয়োজন, তার প্রায় সবই এখানে তৈরি হয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজে এই ঝুঁকি বহুগুণ বেশি।
ধর্মীয় বিভাজন: সিভিল ওয়ারের দ্রুততম জ্বালানি
রাজনৈতিক দলের মধ্যে সংঘর্ষ হলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় লাগে, কিন্তু ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লে সেটা মুহূর্তেই ভয়াবহ আকার ধারণ করে। কারণ ধর্মের প্রশ্নে মানুষের আবেগ অতিরিক্ত তীব্র। সাম্প্রতিক রাজবাড়ীর ঘটনা—যেখানে একটি কবর থেকে লাশ তুলে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে—এমনকি একজন নিহত হয়েছেন—তা নিছক স্থানীয় সমস্যা নয়, বরং সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ার মতো এক উস্কানিমূলক উপাদান।
বিতর্ক বনাম উস্কানি
একজন মানুষ জীবিত থাকতে বিতর্কিত হতে পারেন, তার পরিবার বা অনুসারীরাও ভুল কাজ করতে পারে। কিন্তু বিতর্কের প্রতিক্রিয়ায় আরেকটি অমানবিক বিতর্ক তৈরি করা যায় না। ইসলামের দৃষ্টিতেও মৃতদেহ অসম্মান করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অথচ এখানে প্রশাসন, ধর্মীয় নেতা এবং রাজনৈতিক পক্ষগুলো বিষয়টি শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান না করে উল্টো জনমতকে উত্তপ্ত করেছে। এর সুদূরপ্রসারী ক্ষতি শুধু একটি অঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকবে না—সমাজের প্রতিটি স্তরে ছড়িয়ে পড়বে।
ক্ষমতার রাজনীতি ও গৃহযুদ্ধের খেলা
ইতিহাস বলছে—যারা দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতা ধরে রাখতে চায়, তাদের জন্য একটি নিয়ন্ত্রিত গৃহযুদ্ধ প্রায়শই রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে ওঠে। কারণ এতে জনগণের দৃষ্টি মূল ইস্যু থেকে সরে যায়, রাষ্ট্রীয় দমননীতি বৈধতা পায় এবং বিরোধী শক্তিগুলো ভাঙতে সহজ হয়। আজ যদি ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে, তবে এর প্রধান সুবিধাভোগী হবে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী এবং তাদের আন্তর্জাতিক মিত্ররা।
আত্মপ্রতারণার ফাঁদ
অনেকে ভাবতে পারেন—“আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে, সংঘাতে আমরা জিতব।” বাস্তবতা ভিন্ন। মারামারির পর মামলা হবে, ভিডিও ভাইরাল হবে, আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় “ধর্মীয় উগ্রপন্থী” ট্যাগ লাগবে। তরুণ প্রজন্মের আস্থা নষ্ট হবে। আর ক্ষমতাসীনরা যখন “জঙ্গি ইস্যুতে” আপনাকে ধরতে পারবে না, তখন এই “ধর্মীয় সহিংসতার ইস্যু” দিয়েই আপনাকে ঘায়েল করবে।
সাম্প্রতিক ধর্মীয় বিরোধের ইঙ্গিত
ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে সুন্নিদের মিছিল, তার বিরুদ্ধে কওমী মহলের প্রতিক্রিয়া, জাতীয় মসজিদের খতিবের বক্তব্য কিংবা চট্টগ্রামের মুফতির প্রকাশ্য সমালোচনা—সবই প্রমাণ করে, ধর্মীয় নেতারা এই মুহূর্তে দায়িত্বশীলতার জায়গায় নেই। তারা জানেন, আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো মুসলিম সমাজে বিভাজন চায়। তবু তারা উস্কানির খেলায় জড়িয়ে যাচ্ছেন। এর ফলশ্রুতিতে মুসলমানদেরই বেশি ক্ষতি হবে, আর ফায়দা লুটবে পশ্চিমা ও আঞ্চলিক সাম্রাজ্যবাদ।
ইতিহাস থেকে শিক্ষা
মধ্যপ্রাচ্যের উদাহরণগুলো আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে—ধর্মীয় বিভাজনকে উসকে দিয়েই ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন ধ্বংস হয়েছে। একবার সিভিল ওয়ার শুরু হলে সেটা আর নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। বিদেশি শক্তি প্রবেশ করে, অস্ত্র সরবরাহ করে, মিডিয়া প্রোপাগান্ডা চালায়—শেষ পর্যন্ত গোটা জাতি জিম্মি হয়ে পড়ে।
করণীয়: দায়িত্বশীলতার পথে ফেরা
যারা নিজেদেরকে সমাজের ধর্মীয় দায়িত্বশীল মনে করেন, তাদের প্রতিটি আচরণে পরিমিতি, ধৈর্য ও বুদ্ধিমত্তা থাকা আবশ্যক।
উস্কানিকে প্রতিরোধ করতে হবে।
দ্বন্দ্বকে সংলাপ ও সমঝোতায় থামাতে হবে।
বিরোধ থাকলেও অন্তত সাময়িকভাবে ঐক্যের সংস্কৃতি বজায় রাখতে হবে।
কারণ, যদি ধর্মীয় গোষ্ঠী নিজেরাই নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাড়াতে থাকে, তবে আসন্ন গৃহযুদ্ধের প্রধান ক্ষয়ক্ষতি তাদের দিকেই টেনে আনা হবে।
👉 আমার দৃষ্টিতে, এখনই সময় আমাদের থেমে গভীরভাবে ভাবার। যারা বুঝদার, তারা যেন ঠাণ্ডা মাথায় বসে সমাজকে অগ্নিপরীক্ষা থেকে বাঁচান। নইলে একবার সিভিল ওয়ার শুরু হলে, সেটা আর কারো নিয়ন্ত্রণে থাকবে না।