মা ছুটে এসে হাতের ভিতরে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে বলে, এখনি বাসা থেকে বের হয়ে যাবি। তোর বাবা ফিরে আসলে অনেক বড় ঝামেলা হবে, আমি সামাল দিতে পারবো না।
হাতের ভিতরে দেওয়া টাকাটা টেবিলের উপর রেখে বলি, আমি কোথাও যাবো না। আর এই দুপুরবেলা কই যাবো? ভাত দাও ভাত খেয়ে যাই।
মা বলেন, ভাত হয়েছে তরকারি হতে এখনো দেরি হবে। এর ভিতরে তোর বাবা ফিরে আসবে। এই টাকা দিয়ে বাহির থেকে কিছু খেয়ে নিস।
মায়ের কথা এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দেই। গামছা নিয়ে গোসলঘরের দিকে যাই। মা অস্থির হয়ে ঘরের ভিতরে ছুটছেন, যদি পারতেন মা তার আচঁলের কোনায় আমাকে বেঁধে লুকিয়ে রাখতেন। অবশ্য সে উপায় নেই।
গোসল থেকে বের হয়ে দেখি ছোটো মামা এসেছে। মা পরিস্থিতি সামাল দিতে না পারবার ভয়ে মামাকে খবর দিয়েছেন।
একটা পুরোনো লুঙ্গী পরে গামছা দিয়ে চুল মুছে নিচ্ছি, মামা বলেন ‘যা শুনলাম ঘটনা কি সত্যি?'
‘কি শুনেছো বলো।’
‘তুই নাকি পরীক্ষা না দিয়ে বের হয়ে আসছিস।’
‘হ্যাঁ মামা পরীক্ষার পেপারে কেবল নাম লিখেছি তখনই দেখলাম বাহিরে বৃষ্টি। বৃষ্টি হলেই লেকের পাড়ের মাঠে একদল বাচ্চারা বল খেলে, ওদের আবার ঘরবাড়ি নেই। মনে হলো আমার কাদামাটি পায়ে মেখে বল খেলা উচিত, সাথে এই বৃষ্টিতে ভিজতে হবে। বের হয়ে সোজা মাঠে চলে আসলাম।'
‘তাই বলে পরীক্ষা না দিয়ে বের আসবি। দুলাভাই যদি জানে কি হবে বুঝতে পারছিস?’
‘বাবা জেনে গেছে আমি নিশ্চিত। আমার হলে যে স্যার গার্ড ছিলেন উনি বাবার বন্ধু। এতোক্ষণে বাবার কানে খবর পৌছে গেছে।’
মামা আমার হাত থেকে গামছা টান দিয়ে নিয়ে নেয়, একটা শার্ট হাতে দিয়ে বলে তাড়াতাড়ি পরে নে। এখনি আমার সাথে যাবি চল।
‘মামা ভাত হয়ে গেছে, তরকারি হতে আর মিনিট দশেক লাগবে। খেয়ে তারপর বের হই?'
মামা আমার কথার কোনো গুরুত্ব দিলেন না। আমাকে নিয়েই ঘর থেকে বের হয়। রান্নাঘর থেকে খাবারের ঘ্রাণ আসছে, খেয়ে যেতে পারলে ভালো হতো।
ঘ্রাণ নিয়েই ঘর থেকে বের হই। মামার সাথে হাঁটতে থাকি, কিছুদূর হাঁটার পরে দুজনে একটা বাসে উঠি। বাস থেকে নেমে সোজা চলে আসি মামার মেসে।
মামা বলেন, তুই এখানে বস। আমি খাবার নিয়ে আসছি, দুপুরে তো খেতে হবে তাই না? হ্যাঁ মামা তাড়াতাড়ি যাও পেটের ভিতরে কাফকা ছুটছে।
‘কাফকা ছুটছে মানে কি?'
‘মানে সহজ, তেলাপোকা ছুটছে।'
মামা বিরক্ত নিয়ে রুম থেকে বের হয়, আমি বুঝতে পারি। বিছানার উপর শুয়ে ফ্যান ছেড়ে দেই, ফ্যানটা ঘটরঘটর শব্দ করে চলতে থাকে।
কিছুসময় পরে মামা খাবার নিয়ে আসেন। বিছানার উপর একটা গামছা বিছিয়ে খেতে বসি।
খাবার খেতে খেতে মামা বলেন, আজকে এমনটা করবার কি কারণ বলতো?
‘একবার তো বললাম। আবার বলবো?’
মামা চুপ করে থাকে।
আমি বলি দেখো মামা তোমার বইয়ের তাক থেকে একবার সাদত হাসান মান্টোর বই পড়ি। এই মানুষটা বেশ কয়েকবার ফেল করেছে তবে তাকে বলা হয় ছোটোগল্পের ইশ্বর। ধরো সাদত হাসান পড়াশোনা করে বড় একটা সরকারি চাকরি করতো, তবে কি সাদত হাসানকে আমরা পেতাম? এই পৃথিবী পেতো ছোটগল্পের গুরুকে?
‘তো এখন তুই কি করতে চাস?'
‘মামা আজকে একটা গল্প লিখেছি। গল্পটা দিয়ে নাটক করলে বেশ ভালোই হবে। তোমার না এক বন্ধু আছে টিভিতে নাটক বানায়। তুমি শুধু তার সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিবে। আমি তাকে গল্পটা দেখাতে চাই।'
‘আচ্ছা দিবো। এবার চুপচাপ খেয়েনে।'
আমার বাসায় ফেরা হয়না। বাবা ভীষণ রেগে আছেন। রাগ করবার মতোই কাজ অবশ্য করেছি, ইন্টারমিডিয়েট ফইনাল পরীক্ষা চলছে, পরীক্ষা না দিয়ে পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে আসছি। আপাতত কয়েকদিন মামার এখানেই আমাকে থাকতে হবে। মা নিষেধ করেছেন যেনো বাসায় না যাই।
এখানে বসেই গল্পটা খুব সুন্দর করে লিখে ফেলি। মামা তার বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেয়, রেদোয়ান আহমেদ তার নাম। ইন্টারমিডিয়েট পড়া একটা ছেলের গল্প দিয়ে তিনি নাটক বানাতে তেমন ভরসা পেলেন না।
আমি হতাশ হলাম। দিনের পর দিন যায় রেদোয়ান আহমেদের থেকে কোনো খবর আসে না। এদিকে মামার মেসে থাকতে আর ভালো লাগছে না, বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করছে। সে উপায় নেই। আমার বড় বোন মায়মুনার সাথে কথা হয়েছে, আপা বলেছে বাবা অনেক রেগে আছে, এখন বাসায় ফিরলে ঝামেলা হবে।
ঝামেলার চেয়ে শান্তিতে এখানে মেসে থাকাই ভালো।
মামা বলেন তুই এই কাজটা করলি কেন বল? মামার এক প্রশ্নের উত্তর বেশ কয়েকবার দিয়েছে, তারপরও যেনো তার মনের মতো উত্তর হয় না। মামা ভেবেছে আমার মাথায় সমস্যা হয়েছে, মা ভাবছেন আমাকে জ্বীন ভূতে ধরেছে। সেদিন মামার মেসে মায়মুনা আপাকে দিয়ে একটা তাবিজও পাঠিয়েছেন।
আমি বলি ‘দেখো আমরা শিক্ষালাভ করি জ্ঞানের আশায়। কিছু মানুষ জ্ঞানী তারা জ্ঞান বিতরণ করে।'
মামা বলেন ‘তুই কি নিজেকে সক্রেটিস ভাবিস?’
আমি মামার কথা এড়িয়ে যাই উত্তর না দিয়ে।
মামা সেদিন তার ভার্সিটি থেকে এসে হাসি মুখে বলেন, তোর জন্যে একটা ভালো খবর আছে। আমি বিছানা থেকে উঠে বলি, কি ভালো খবর? মামা বলেন, রেদোয়ান তোর গল্প দিয়ে নাটক বানাবে আজকে বিকালে তোরে নিয়ে ওর অফিসে যেতে বলেছে।
মামার কথা শুনে আমার খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে।
বিকালে আমি রেদোয়ান আহমেদের সাথে দেখা করি। আগামী সপ্তাহে নাটকের শ্যুটিং শুরু হবে জানায়। রেদোয়ান আহমেদ বলেন, তোমার গল্পটা বেশ পছন্দ হয়েছে। তুমি চাইলে আরো কয়েকটা এরকম গল্প লিখতে পারো। আমি কেবল সুযোগের অপেক্ষায় ছিলাম, আমার লেখা আরো দুটো গল্পের ঘটনা তাকে শুনাই। বুঝতে পারি তার বেশ পছন্দ হয়েছে।
নাটকের সব কাজ শেষ করতে একুশ দিন লেগে যায়। এই একুশ দিন মামার মেসেই ছিলাম। বাসায় ফেরা হয়নি।
আগামী মাসের তিন তারিখ নাটকটা টিভিতে দেখা যাবে। স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে আমাকে তেরো হাজার টাকা দেয়।
এতো টাকা একসাথে দেখে প্রথমে অবাক লাগে,বুকের ভিতরে অদ্ভুত এক সুখ।
মামার মেসের ফ্যানটা ঘটরঘটর করে, এই ফ্যানটা বদলাতে হবে। বাবা খুব বেশি রাগ করলে এখানেই চলে আসি, মন খারাপ থাকলে এই মেসে এসে দুই তিনদিন থেকে যাই।
মামা কিছুতেই টাকা নিবে না, আমি বলি তুমি পরে আবার দিয়ে দিবে? হিসেব বরাবর? দরকার হলে কিছু বেশি দিয়ে দিবে? মামা হেসে বলেন আচ্ছা। যদিও মামার থেকে এই বয়স পর্যন্ত যা নিয়েছি তার ঋণ কখনো শোধ করা হবে না।
আমার বাবা একটা বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক। শহরের একপাশে একটা টিনশেড বাড়িতে আমরা বাড়ি থাকে, আমরা সহ আরো দুটো পরিবার এখানে থাকে।
বাবার একটা চশমা আছে, একবার ভেঙে গেছে। সেই চশমা জোড়া দিয়েই চোখে পড়ে। অবশ্য বেশিরভাগ সময় পকেটে রাখে, বেশি জরুরী না হলে পকেট থেকে বের করে চোখে দেয় না। কারণ চশমাটা ভাঙা। মা বহুবার বলেছে চশমা কিনতে তবে কিনেনি।
মায়মুনা আপাকে দিয়ে কৌশলে বাবার চশমার বিস্তারিত জেনে নেই। বাবার নতুন একটা চশমার দাম রাখে দুই হাজার চারশো টাকা। সাথে চশমার একটা ছোটো ব্যাগ দুইশো বিশ টাকা।
বাসায় আসবার পরে বাবার সামনে যাইনি। ঘরের ভিতরেই চুপচাপ থাকি, মামা এসে বাবাকে বুঝিয়ে গেছেন। কি বলেছেন মামাই জানে, বাবা আর বকাবকি করেনি।
মা রান্নাঘর এসে বলে, তোর নাটকের নাম কি? আমি বলি মা ‘বিকালের নরম রোদ' মা অবশ্য পড়াশোনা করেছেন ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত। মা হেসে বলেন, বাহ সুন্দর নামতো। কখন দেখাবে? আমি বলি আগামীকাল বিকাল পাঁচটায়, আমাদের টিভিতেই দেখা যাবে।
মায়মুনা আপা সকালবেলা উঠেই টিভির ধূলোমুছে পরিষ্কার করে। বাবা প্রতিদিন বিকালে বাজারের লাইব্রেরীতে গেলেও আজকে শরীর খারাপ বলে লাইব্রেরিতে যায়নি।
মামা এসেছেন দুপুরের দিকে, বিকাল পাঁচটা হতেই আমরা টিভির সামনে বসি। বাবা আমার ঠিক পাশেই যদিও তার মুখের দিকে তাকানোর সাহস আমার নেই। বাবা পকেট থেকে তার ভাঙা চশমা বের করে পরতে যাবেন, দেখেন পকেটে চশমা নেই। আপাকে ডেকে বলে, মায়মুনা আমার চশমাটা মনে হয় খাটের উপরে নিয়ে আয়।
আপা চশমা নিয়ে আসে, একটা নতুন চশমা। বাবা বলেন এই চশমা কার? আপা বলে, বাবা আমাদের শোভন কিনেছে তোমার জন্যে। বাবা চশমা চোখে দিয়েই আমার দিকে তাকায়, আমি মুখ ফিরিয়ে টিভির দিকে তাকাই। বাবার দিকে তাকাতে ভয় লাগছে।
একটা দোতলা ছাদ, ছাদের রশীতে কিছু ভেজা কাপড় শুকাতে দেওয়া, ছাদের অর্ধেকে রোদ। ঠিক তখনই নাম উঠে ‘বিকালের নরম রোদ’
নাটক শেষ হয়, বাবা চশমা খুলে চোখ মুছে বলেন। কি ছাতার নাটক লিখেছে চোখে পানি এসে গেছে! নাটকের শেষে সবার চোখেই একটু আধটু পানি জমেছে। তবে বাবার চোখে নতুন চশমা দেখেই নাটকের শুরুতে আমার চোখ ছলছল করে উঠেছিলো।
বাবা চশমা খুলে চোখ মুছে ঘরের ভিতরে চলে যায়। কিছুক্ষণ পরে আমাকে বাবা তার ঘরে ডাকে, আমি চুপ করে খাটের পাশে বসি। বাবা বলে, এই গল্প কি আসলেই তোর লেখা? আমি বলি, হ্যাঁ বাবা। বাবা বলেন, ভালো হয়েছে নাটকের ভিতরে অনেক স্মৃতি দেখতে পেলাম। বাবা হাতে একশো টাকার একটা নোট দিয়ে বলে, এটা দিয়ে কিছু খেয়ে নিবি এখনি দোকানে যা।