ঝড় বৃষ্টি। রাস্তার ধারে পুরনো একটা ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোয় ঝাপসা হয়ে উঠেছে শিশির বিন্দুর মত পানির রেখা।
সেই আলোয় নিজেকে রক্ষার জন্য এগোচ্ছি। আজ চাকরির ইন্টারভিউ ছিল। হয়তোবা এইবারও চাকরিটা আমার কপালে জুটলো না। ক্লান্ত শরীরে বুকের ভিতরে অদ্ভুত এক শূন্যতা নিয়ে বাড়ি ফিরছি। বাড়ি ফোন করলে মায়ের কণ্ঠেও ক্লান্তির ছাপ।
সব মিলিয়ে আজকের দিনটা আমার জন্য খুবই ভারী।
নির্জন রাস্তায় একা হেঁটে চলেছি। মনে হচ্ছে আজ পুরো শহর মন ভার করে রেখেছে। উত্তরের ঠান্ডা বাতাসেও ক্লান্তির ছাপ। অঝোরে বৃষ্টি নেমে এলো। বৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচাতে সামনের দিকে দৌড়াচ্ছি। সামনে পুরনো ল্যাম্পপোস্টের নিচে ছোট্ট এক চায়ের দোকান দেখতে পেলাম।
চায়ের দোকানে গিয়ে দাঁড়ালাম। চায়ের গন্ধ যেন বৃষ্টির ঠান্ডা বাতাস ভেদ করে বুকের ভেতরে ঢুকে গেল।

আমি দাঁড়িয়ে আছি, নজর পড়লো সেই মেয়েটির দিকে। তার চোখে চোখ পড়তে সঙ্কোচ বোধে চোখ সরিয়ে নিলাম। পরনে তার নীল শাড়ি, সাজা পেয়েছে জুঁই ফুলের মালা। মিষ্টি তার লাজুক হাসি। সে হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বলল, “ভিজে গেছেন, এখানে বসুন না।”
কোনো সুমিষ্ট কণ্ঠের মেয়ে আমায় এভাবে ডাকতেই আমি যেন কোথায় হারিয়ে গেলাম। মনের মাঝে কিছুটা ভয় নিয়ে তার পাশে বসলাম। মেয়েটির নাম তাকিয়া।
তার ব্যাগ থেকে একটি রুমাল বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল, “মাথা মুছে নিন, ভেজা মাথায় থাকলে শরীর খারাপ করবে”। রুমাল হাতে নিয়ে হাসিমুখে বললাম, “ধন্যবাদ আপনাকে”। সে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।
অচেনা হলেও কোথায় যেন এক পরিচিত সুর। দুজন পাশাপাশি বসে থাকলাম। কথা বলতে বলতে বোঝা গেল–তাকিয়ারও আজ মন খারাপ, নিজের ভেতরে লুকানো কিছু না বলার গল্প আছে।
“চা ঠান্ডা হয়ে আসছিল। তবুও আমাদের কথা শেষ হচ্ছিল না।”
আমি বললাম,
–“জীবনটা মাঝে মাঝে খুব ভারী হয়ে যায়।”
তাকিয়া উত্তর দিল,
–“তখন এক কাপ গরম চা, আর একজন শ্রোতা থাকলেই যথেষ্ট।”
বাইরে তখনো বৃষ্টি পড়ছে। ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোয় ঝাপসা পৃথিবী, অথচ ছোট্ট দোকানের ভিতরে দুই অচেনা চোখে ধীরে ধীরে ভেসে উঠছিল নতুন এক আলো।
বিদায়ের মুহূর্তে তাকিয়া শুধু মিষ্টি হেসে বলল,
–“শহরটা ছোট, আবারও দেখা হবেই।”
আমি জানতাম- এই গল্প এখানে শেষ নয়।