Posts

গল্প

তেতুল বনে জোছনা

September 11, 2025

saleh muhammed

124
View

আরো জটিল হয় অন্ধকার। যেন তলিয়ে বা বিলীন হয়ে যেতে থাকি। কালো, ত্রুদ্ধ ও সর্বগ্রাসী। ভেতরে আবার কিলবিল করছে অসংখ্য কীটের মতো কি যেন। সাবধানে একটা শ্বাস নেই। বাতাস খুব শীতল। খানিকটা অন্ধকার যেন ফুসফুসে ঢুকে যায়। আমি ইতস্তত পা ফেলি। যতটুকু আগাই তার চেয়ে অনেক বেশি শব্দ হয়। ওদিকে, যেখানে সকাল বেলা দেখেছি একটা বড়ো মতো গাছ থাকার কথা, সেখান থেকে একজন কে জানি প্রবল অথরিটি নিয়ে জানতে চায়, 
"এই কে ওখানে?"
আমি আমার চিরায়ত দুর্বল গলায় বললাম, "আমি, আমি সালেহ।"
" ছালে? কুন্ ছালে?"
" ওই যে ডাক্তার।"
" অ আইছেন আপ্নে? খবর পাঠানো হৈছে কখন আপনাকে?"
আমি খুব ভয় পেয়ে যাই। রোগী মারা গিয়েছে নাকি? তাহলে এরা প্রচুর মারবে। আমার আগে যে ডাক্তার ছিল তাকেও মেরেছিলো এরা। উনি আমার দুই ব্যাচ সিনিয়র। হুমায়ূনের তেতুল বনে জোছনা পড়ে তার গ্রামে ডাক্তারি করার ইচ্ছা হয়েছিল। গ্রামবাসী সাপে কাটা রোগী নিয়ে এসেছিলো। স্টক না থাকায় ডাক্তার এন্টি ভেনম দিতে পারে নাই। সেই অপরাধে মার। ইট দিয়ে মাথা থেতলে ফেললো। ভাই তিনদিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। তারপর মারা যান। আমার গলা এতো শুকনো যে কিছু বলতেই পারছি না।
" রোগী কেমন আছে?"
গাছের নিচের লোকটা হা হা করে হাসলেন। আমি তাকে দেখতে পাই না। তিনি বললেন, 
" রোগী ভালোই আছে। আমার পিতা। একশত তিন বছর বয়স। আমরা ভাবছিলাম মারা যাবে। কেমন জানি করতেছিলো। হাত পা ঠান্ডা। একটু আগে ঠিক হয়ে গেছে। বিড়ি খাইতে চায়। আপ্নে এতো দেরি করলেন কেন? একটা দায়িত্ব নাই আপনার।"
আমি ক্ষীণ কণ্ঠে বলি, "অন্ধকারে রাস্তা হারায় ফেলছিলাম।"
"কাওরে সাথে নিয়ে আসতে পারেন নাই? আমি তো আপনাদের এমডিরে কৈছি সাথে একটা লোক দিতে।"
আমি কি উত্তর দিবো বুঝতে পারি না। আমার সরকারি চাকরি না। প্রাইভেট। ক্লিনিকের মালিক যা বলে তাই। এই জন্যেই হাউজ কলে আসা। একদিন বারো ঘন্টা ডিউটি করলে আটশো টাকা দেয়। না আসলে আজকের টাকা দিবে না। আর সাথে কাওকে নিয়ে আসলে তাকে আমার নিজের থেকে পাঁচশো টাকা দিতে হবে। এলাকা গ্রাম বটে। কিন্তু খরচে কেমন একটা শহর ভাব আছে। আমি মাসে পনেরো দিন খাই। মাঝখানের যেই দিনগুলা খাই না সেগুলি মনে করি রোজা রেখেছি। যদিও পানি খাই। তাই সোয়াব কিছু হয় না। তারপরও টাকা বাঁচার কথা। ভাবসিলাম মাস শেষে দশহাজার টাকা জমবে অন্তত। এক বছর জমাইতে পারলে আমি তিন-চার মাসের ব্রেক নিয়ে পার্ট ওয়ানের জন্য পড়তে পারি। কিন্তু আজকে দেখলাম মাসের শেষে এসে ছয়হাজার টাকা আছে। ওই টাকার হিসাব মিলাতে গিয়েই অন্ধকারে পথ হারিয়ে যায়। তার ওপর আজকে হচ্ছে আমার না খেয়ে থাকার দিন। সকালে রোগী দেখাতে আসা লোকদের সাথে একটা বাচ্চা এসেছিলো। সে চিপ্স খাচ্ছিলো। আমি তাকে দেখে হাসলাম। বাচ্চাটা কি মনে করে জানি আমাকে তখন দুটা চিপ্স খেতে দেয়। ওই-ই খাওয়া সারাদিনে। 
কাছেই একটা টর্চ জ্বলে উঠলো। আমি তাকিয়ে দেখি আরেকটা লোক এসেছে। দৃশ্য কিছুটা স্পষ্ট এখন। একদিকে জল আর চারপাশে জংলা মতো। আমি কাঁধের ওপর একটা অত্যন্ত ভারী মাংসল হাত অনুভব করলাম। হাঁটু একটু কেঁপে যায়। হাত যার, তিনি বললেন, 
" আসেন, আব্বারে দেইখা যান। পেছারের জন্তটা আনছেন না? ওই যে ফুলায়। আমার মনে হয় পেছারের সমস্যা। মাইপা দেখা দরকার।"
আমরা হাটতে শুরু করি। তিনি টর্চ হাতে আগত লোকটাকে ডাক দিলেন,
" কিরে মামুইন্না লাইট ফালাস না কেন ঠিকমতো?"
টর্চের আলোটা আশ্চর্যরকমের সুস্থির হয়ে যায়। আমাদের পদরেখার অনুসারে সেটি মাটি থেকে সরে সরে সমানে যেতে থাকে। আমি দেখলাম এই দুটো লোকই ছয়ফুটের ওপর লম্বা। বনের জন্তুর মতো সুঠাম শরীর। নিশ্চই প্রচুর প্রোটিন খায়। অথরিটি সম্পন্ন লোকটা বললো, 
"আপনাদের আগের ডাক্তারটা আছিলো না? ওটারে কে মারছিলো জানেন?"
" জ্বি না।"
তিনি টর্চওয়ালা লোকটার দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে হে হে করে হাসতে হাসতে বললেন,
" এ হে- হে - হেই যে মামুইন্না বান্দির পোলা। এই হারামজাদায় মারছে।"
তিনি কেমন তালি দিয়ে হেসে লাফিয়ে উঠলেন। আমি স্তব্ধ হয়ে যাই। আমার বিহ্বল ভঙ্গি দেখে মামুন লোকটাও হাসতে থাকে। সাথের লোকটা বললো 
" কাহিনীটা চালু বলতো ডাক্তাররে মামুন।"
মামুন সাথে সাথে বলতে শুরু করে,
"রোগী আমার চাচাত ভাই হয়। সাপে কাটসে। লয়ে গেলাম আপনাগো হাসপাতালে। আপনার ডাক্তার দেখি ইনজেকশন দেয় না। কয় যে ঐটা বলে নাই। উপজেলায় নিয়ে যাইতে হবে। কইলাম ইঞ্জেকশান যা আছে তাই দেন। হাসপাতাল মানেই তো ইঞ্জেকশান। ওটা না থাকে কেমনে। আমরা গ্রামের মানুষ। আমগো অতো বাই নাই। একটা না থাকলে আরেকটা দিলেও চলবো। হেই দিলো আমারে ঝাড়ি। নিজের মাথার দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখায়ে কইলো, তুমার মাথায় কিছু আছে? লেখাপড়া করছো কোনোদিন? ডাক্তার তুমি না আমি? এইসব ফাও কথা। আমিও ঠিক করছি তুই খালি খাড়া মাইগ্গার পুত। যেই মগজের এতো গরম ঐটাই বাইর কইরা ফালামু। সবাইরে কয়ে দিলাম রোগী কোত্থাও যাইবো না। অন্যায় এই গ্রামের লোক মাইনা নিবো না।"
সাথের লোকটি মামুনের কথা কেড়ে নেয়। তিনি সদম্ভে হুংকার তুললেন,
"ঐটাই কথা। অন্যায় এই এলাকার লোকের সাথে করে কেউ যাইতে পারবে না। তা তুমি যতবড় শিক্ষিত কুতুবই হও না কেন। আমার বিশ বছরের রাজনীতিতে এইটা শিখাইতে পারছি সবাইরে। ওসি যখন মামুনরে এরেস্ট করলো আমি পাঁচশো লোক নিয়ে থানা ঘেরাও দিলাম। ওসির টেবিলে বাইরায়া কইলাম, মাংগের নাতি, এইসব ডাক্তার প্রতি বছর পাশ দিয়া বাইর হয়। এইগুলা একটা গেলে একশোটা আসে চাকরি খুঁজতে। কিন্তু মামুনের মতো একটা খড়মি বানাইতে যুগ যুগ লাগে।"
যে ডাক্তারকে মেরেছিলো তার কথা মনে পরে। উনাকে ব্যক্তিগত ভাবে চিনতাম না। ফেসবুকে একটা গ্রূপ আছে ডাক্তারদের। জব পোস্টিং দেয়।  আবার কোথাও কেউ মার খেলেও ওখানে দেখেছি সবাই এসে প্রতিবাদ তটিবাদ করে। সেখানেই ভাইয়ের মাথা ব্যান্ডেজ করা ছবি দেখলাম। ব্যান্ডেজের একদিকে লেখা "হাড় নেই, চাপ দিবেন না।" সাথে উনার নাম পরিচয় ব্যাচ। আর ঘটনার স্ববিস্তারিত বর্ণনা। পোস্টদাতা লাস্টে লিখসিলেন "তেতুল বনে জোছনা পড়ে আমার এই বন্ধু গ্রামে ডাক্তারি করতে যায়। হায়রে পাগল দুনিয়াটা হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাস না।" একই সাথে জানানো হয় এই হাসপাতাল এখন থেকে ব্লাকলিস্টেড। আহ্বান সবাইকে, কেউ যেন এখানে ডিউটি করতে না আসে। আমি একদম সাথে সাথেই হাসপাতালের ঠিকানা বের করে চাকরির এপ্লাই করে ফেলি। ওই ছবির সাথেই হাসপাতালের এমডির একটা পোস্ট-এর স্ক্রিনশট ছিল। সেটা ধরে ওনার প্রোফাইল বের করে মেসেন্জারে নক দিলাম। উনি আসতে বললেন।  
ভাইভার দিন দেখলাম ভালোই লোক হয়েছে। বিস্ময় জেগেছিলো। এটা সন্ত্রাস প্রবন দূর গন্ড এলাকা। তার ওপর এমন একটা ঘটনা ঘটলো। এত মানুষ এই চাকরির জন্য আসবে আমি ভাবি নাই। আমি নিজে এসেছি সেই ঢাকা থেকে। সারাজীবন ওখানেই ছিলাম। বাপ মা বঞ্চিত হওয়ার পর থেকে আর পারছিলাম না। বাড়ি ভাড়া দিতে গেলে খাবারের টাকা থাকে না। পরে তো আর চাকরিই থাকলো না। হাসপাতালের এমডি বললো আমার জায়গায় এখন থেকে পোস্টগ্রাজুয়েট নিবে ওরা। "আপ্নে স্যার পাশ ওরে আসেন।" এমডি লোকটার ব্যবহার ভালো ছিল। যত খারাপ কোথায় বলুক কখনো ঝাড়ি দিতো না। আর স্যার বলতো। 
এই এমডি লোকটা অন্যরকম। ভাইভার দিন দেখলাম সে লুঙ্গি পরে আছে। তার দুই হাত ভরা আংটি। লাল ও কালো চক্র আঁকা গ্লসি একটা শার্ট। চোখে কেমন উদাস দৃষ্টি। একটা ছোট ঘরের মধ্যেও কিভাবে জানি সে অনেক দূরে কিছু একটা দেখছে। আমি প্রথমে বুঝি নাই সে এমডি। তার পাশের অপেক্ষাকৃত অফিসার চেহারার লোকটাকে তাই সালাম দিলাম। লোকটা উত্তর দিল না। শীতল ও সরু চোখে আমাকে দেখলো। সে ঘষঘষে গলায় বললো, 
"আপ্নে আমাদের এমডি স্যারকে সালাম দিসেন?"
তার বাক্যটি শেষ হওয়ার সাথে এক অপূর্ব সিনক্রোনাইজ করে লুঙ্গি লাল শার্ট লোকটার চোখের মনি কৌণিকভাবে আমার দিকে এসেই আবার সেই দূরের কি জানি একটার কাছে ফিরে গেলো। 
আমি ভয় পেয়ে যাই। কাঁপতে কাঁপতে ক্ষীণ গলায় বলি, "স্যার স্লামালেকুম।"
তিনি নিরুত্তর থাকেন। সাথের লোকটা সিনেমাটিক ভঙ্গিতে বলেন, "তা বসেন।"
আমি বসলে তিনি জিগেশ করেন আমি কবে পাশ করছি। আল্ট্রা করতে পারি কি না। ঠিক করে বললে আমি আসলে পারি না। আমি সাতদিনের একটা কোর্স করসিলাম আল্ট্রা নিয়ে। তেমন আগ্রহ নিয়ে করি নাই। ওরা একটা সার্টিফিকেট দেয় ঐজন্যে করা। ফিজিকাল এক্সামিনেশন, হিস্টিরি, সিম্পটম নিয়ে যা পাই সেটার সাথে মিলায়ে মুখস্থো লাইন লেখে রিপোর্ট দিয়ে দেই। আল্ট্রার ছবির কিছুই বুঝি না। খালি জেলি মাখায়ে ঘুরাই।আর তখন সেই প্রথম দৃশ্যে গাছের নিচে দেখা লম্বা লোকটা বলল,
“খাইছেন আজকা?”
আমি আরো এক দফা বিস্মিত হই। এতক্ষণ তিনি আমাকে খেয়াল করে এই অতি গূঢ় রহস্য উদ্ঘাটন করে ফেলেছেন। আমি নিরুত্তর, মাথা নিচু করে রাখি। তিনি অসম্ভব মমতা ভরা কণ্ঠে বলেন, “এই যে বাসায় চইলা আসছি। ডাক্তার সাহেব কষ্ট কইরা আসছেন, খাইয়া যান।” আমি দেশি মুরগি রান্নার ঝোলের ঝালের প্রবল সুঘ্রাণে মুহূর্তে আচ্ছন্ন হই। সাথে মহিলার ও শিশুদের কণ্ঠ। আলো। অনেক আলো এই প্রবল অন্ধকার ভেদ করে। মেঘ কেটে হঠাৎ চাঁদ বের হয়েছে। আমার কাছে মনে হল পৃথিবী আসলেই হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের মতই সুন্দর।
 

Comments

    Please login to post comment. Login