
(১ম পর্ব)
মহাযন্ত্রনায় পড়েছি।
যন্ত্রনায় ফেলেছে আমার বড় ভাই আজাদ ভুঁইয়া। (আমরা ভুঁইয়া বংশের গর্বিত (!) সন্তান) । রাত বাজে ১ টা ১১। আমি গভীর ঘুমে। হঠাৎ ভাইয়ার ফোন কল। মনে চাচ্ছিল ফোনটা আছাড় দিই। দিলাম না। ঘুম ঘুম চোখে ফোন রিসিভ করলাম।
–আসসালামু আলাইকুম। ভাইয়া?
–ওয়া আলাইকুমুস সালাম। আমি না তো কে?
–এত রাতে কল করেছ কেন? ঘুম ভেঙ্গে বুক ধরফর করছে আমার।
–আরে আসল ঘটনা শুনলে তো বুক ধরফর করবে! না শুনতেই বুক ধরফর! হা হা হা ।
–কী হয়েছে?
–আচ্ছা তুই এত রাত এত রাত করছিস কেন? আমার এখানে ১০ টা বাজে মাত্র। আমি তুরস্কে আছি, এটা ভুলে যাস নাকি?
–না, ভুলি নাই।
–শোন! আমাদের আনাতোলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে নাসিরুদ্দীন হোজ্জাকে বাংলাদেশ সফরে পাঠানো হবে!
–হ্যাঁ?
–হুম। কাজটা করছে তুর্কি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের ছাত্র-শিক্ষকরা। বিশ্বসাহিত্য বিশেষত তুর্কি সাহিত্য আরো সমৃদ্ধ করতেই এই উদ্যোগ। নাসিরুদ্দীন হোজ্জা বাংলাদেশ ঘুরবেন, নানা কাহিনী তৈরি হবে, সেই কাহিনী দিয়ে নতুন নতুন গল্প তৈরি হবে, সাহিত্য সমৃদ্ধ হবে!
ঘুমের ঘোরে কথা শুনতে বিরক্ত লাগছে। চেষ্টা করছি কত দ্রুত ফোন রেখে দেয়া যায়। ভাইয়া একবার কথা বলা শুরু করলে ছাড়তে চায় না। বললাম, তুমি তো ইকোনমিক্স পড়ো। সাহিত্য বিভাগের কাজের সাথে তোমার কী?
– সিম্পল জিনিস বুঝলি না? আরে সাহিত্য বিভাগের কাজের সাথে আমাকে জড়ানো হয়েছে কারণ আমি বাংলাদেশি। নাসিরুদ্দীন হোজ্জা তো বাংলাদেশেই যাচ্ছেন। বাংলাদেশ ভ্রমণে তুই হবি তার গাইড!
– ভাইয়া, তুমি রাতে আমার সাথে মজা করার জন্য কল দিয়েছ, তাই না? নাসিরুদ্দীন হোজ্জা, বাংলাদেশ ভ্রমণ এগুলো সব বকোয়াজ।
– না না। মজা করছি না। নাসিরুদ্দীন হোজ্জার মতো বিখ্যাত লোক রাষ্ট্রীয় মেহমান হিসেবে চাইলেই যেতে পারেন বাংলাদেশে। কিন্তু উনি তা চান না। সাহিত্য বিভাগ থেকে বলা হয়েছে হোজ্জা একজন মহান চরিত্র, তিনি গল্পে সাধারণ মানুষদের প্রতিনিধিত্ব করেন। তাই বাংলাদেশেও সাধারণ ভাবেই থাকবেন, ঘুরবেন ফিরবেন!
– তো, তুমি বলছ নাসিরুদ্দীন হোজ্জা সাহেব আমাদের বাড়িতে উঠবেন। আর আমি তাকে দেশ ঘুরিয়ে দেখাবো?
– আইনেন হাকলেসিন কারদেশশিম!
– মানে কী?
– তুর্কি ভাষায় বললাম! অর্থ হলো, একদম যথাযথ বলেছ ভাই!
ফজর নামাজ শেষে বাড়ি আসার পড় রাতের ঘটনা মনে পড়ল। ভাবছি রাতে আজগবি স্বপ্ন দেখেছি কি না। ফোন চেক করি। বোঝা যাবে যে ভাইয়া কল করেছিল, নাকি করে নি।
রিসিভ কলে ভাইয়ার নাম্বার দেখাচ্ছে। সাথে দেখি হোয়াটসএপেও ম্যাসেজ–
‘মুরাদ শোন, হোজ্জা সাহেব যাবেন সামনের মাসে। এই ক’দিনে উনি বাংলা কিছুটা শিখে নিতে চান। আমি তাকে বলেছি, আমার পক্ষ থেকে যত সম্ভব সাহায্য করব। আর হ্যাঁ! তুই তো আরবি ভাষার ছাত্র। হোজ্জা খুব সম্ভবত আরবি জানেন। শুনেছি তিনি সালজুক তুর্কিদের শাসনামলে একজন কাজী ছিলেন। আরবি না জানলে কি কাজী হওয়া যায়? তবুও তাকে জিজ্ঞেস করে নিব। তোর সাথে আরবিতে বাতচিৎ করতে পারবে! তুই দোভাষী হিসেবে কাজ করলি, কেমন!
উনি মাসখানেক থাকতে পারেন। অতি যত্ন ও আপ্যায়নের সাথে রাখবি তাকে আমাদের বাসায়। মা-বাবা আপত্তি করলে বুঝিয়ে বলবি যে, নাসিরুদ্দিন হোজ্জা সাহেব একজন বিখ্যাত মানুষ। তাকে বাসা বাড়িতে থাকতে দেয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার।
মাকে বলবি আমার বিয়ের ব্যাপারে তাড়াহুড়া না করতে। পাত্রী দেখে না বেড়াতে। বিয়ে আমি খুব দ্রুত করছি না।
ওহ ভালো কথা, হোজ্জা সাহেবকে ২/৩ দিনের মধ্যে তোর সাথে কথা বলিয়ে দিব। আরবিতে বিস্তারিত কথা বলে নিবি! পারবি না!’
ভাইয়ার ম্যাসেজের রিপ্লাই কী দিব? আমার তো মাথায় হাত। সামনের মাসে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা। এর মধ্যে সে আমাকে হোজ্জার গাইড হওয়ার দায়িত্ব দিয়ে দিল। আগে ভাগে বলা কওয়া কিছুই নেই। যন্ত্রনা! একেই বলে মহাযন্ত্রনা!
(নতুন পাতা)
হোজ্জাকে সাথে নিয়ে এয়ারপোর্টের বাইরে এসেছি। ফুট ওভারব্রিজ পার হবো। উবারে গাড়ি ভাড়া করেছি। গাড়িতে উঠতে হবে ওপার থেকে । এক্সকেলেটর মানে চলন্ত সিড়িতে পা রাখতে রাখতে হোজ্জা বললেন, বিমানবন্দরের ভেতরেও এরকম সিঁড়ি আছে। বড়ই আজীব বস্তু!
হোজ্জা তার সময়ে এমন চলন্ত সিঁড়ি দেখেন নি। এজন্যই তার কাছে হয়ত আজীব লাগছে। আমি বললাম, জ্বী, আজীব!
হোজ্জা বললেন, ঠিক যেন দুনিয়ার মত!
–কীভাবে হোজ্জা?
–দেখো! এই সিঁড়িতে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। মনে হয় স্থির। কিন্তু সিঁড়ি আমাদের ব্রিজের উপর টেনে নিয়ে যাচ্ছে। দুনিয়াতেও মনে হয় যে, আমরা স্থীর অবস্থান করছি, কিন্তু দুনিয়া আমাদের ঠিকই মৃত্যুর দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে!
হোজ্জার উত্তর শুনে আমি চুপ হয়ে গেলাম! বুঝতে পারলাম, হোজ্জা শুধুমাত্র একজন মজার মানুষই নন। বরং খুব জ্ঞানীও বটে । ইন্ট্রোভার্ট প্রকৃতির আমি হোজার গাইড হওয়া আর ঘুড়ে বেড়ানোকে কষ্টকর বোধ করেছিলাম। ভাইয়ার প্রতি একটা লুকানো রাগ ছিল। কিন্তু হোজ্জার সাথে প্রাথমিক আলাপচারিতায় আমার কষ্ট বা রাগ মনে হয় কেটে যাচ্ছে! প্রত্যাশা করছি, তার সাথে সময় ভালোই কাটবে।
হোজ্জা বললেন, যথেষ্ঠ ক্লান্তি বোধ করছি! তোমার আবাসস্থল পর্যন্ত কীভাবে যাবো? হেঁটে যেতে হবে?
–না হোজ্জা। হেঁটে যেতে হবে না।
–আচ্ছা, আমার জন্য গাধার ব্যাবস্থা করতে পেরেছ? আমার গাধাটা তো সাথে আনতে দিল না।
হোজ্জার প্রিয় বাহন হলো গাধা। সবার জানা। ভাইয়ার পরামর্শে আর কিছুটা বুদ্ধি খাঁটিয়ে আমি একটা ব্যাবস্থা করেছি। হোজ্জার জন্য পছন্দসই বাহনের ব্যাবস্থা। বাহন আমাদের বাড়িতে অবস্থান করছে। জানি না, হোজ্জার পছন্দ হবে কি না। হোজ্জা আনমনে হাঁটছেন। বললাম, হোজ্জা, আপনার জন্য ডিজিটাল গাধার ব্যাবস্থা করা হয়েছে ।
–আচ্ছা।
–Honda C50 । আমার দাদা চালাত এই ডিজিটাল গাধা। এখন মাঝে মাঝে আমার বাবা চালায়। আপনার গাধার চেয়ে গুনে মানে কোনো অংশেই কম না। সমানে সমান। তবে ভ্যাটভ্যাট শব্দ করে চলে।
হোজ্জা হয়ত কিছু ভাবছেন। আমার কথার প্রতি খুব একটা মনোযোগ নেই তার। হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, সমস্যা নেই, মুরদা বৎস। গাধার খুড়ের টপ টপ টপ শব্দ আর ডিজিটাল ঘোরার ভ্যাট ভ্যাট শব্দ তো একই হলো।
আমার মুখে কোনো উত্তর এল না। এই ডিজিটাল গাধাটির ভ্যাটভ্যাট কত ভয়ানক তা আর এখন বলতে সাহস পাচ্ছি না হোজ্জাকে। দেখা যাক, যখন এই গাধার পিঠে তাকে চড়াবো তখন কী বলেন। অপেক্ষায় থাকি।
আমরা ওভারব্রিজ থেকে নেমে উবারের কারে উঠে বসেছি। হোজ্জা বললেন, অদ্ভুত বাহন! টানার জন্য গরু নাই, ঘোড়া নাই, চাকা গড়গড়িয়ে চলে।
গাড়িতে উঠার কিছুক্ষণ পরেই ক্লান্ত হোজ্জা ঘুমিয়ে পড়লেন। গাড়িতে এসি ছাড়া হয়েছে। মনে হচ্ছে তিনি আরাম পাচ্ছেন। রাস্তায় মোটামুটি জ্যাম । গাড়ি থেমে থেমে চলছে । আমিও চোখ বন্ধ করব। তবে ঘুমাবো না।
পল্টনে এসে গাড়ি একেবারে থেমে গেল। কঠিন জ্যাম লেগেছে বোধয়। বিশ মিনিট কেটে গেছে গাড়ি আগানোর নাম নেই । হোজ্জার ঘুম ভেঙ্গে গেছে। আমি তার দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে বললাম, ঘুম কেমন হয়েছে, হোজ্জা?
–আলহামদুলিল্লাহ, ভালোই। গাড়ি থেমে আছে কেন?
হোজ্জার চেহারায় ক্লান্তিভাব কিছুটা কেটে গেছে । তাকে উৎফুল্ল লাগছে। বললাম, হোজ্জা, যানজট লেগেছে। আমাদের দেশে এটা খুবই কমন দৃশ্য।
হোজ্জা দীর্ঘনিশ্বাস ছাড়লেন।
-হুমম। আমাদের সময়ে এরকম কিছু ছিল না। টপ টপ টপ করে আমার গাধা যেতেই থাকত যেতেই থাকত।
–জ্বী, হোজ্জা!
–এখন তোমাদের দেশে যতসব নতুন ঝামেলা তৈরি হয়েছে। এক বৎস তো তোমাদের দেশকে দোজখপুর ই নিয়ামত বলেছিল। তাই না?
হোজ্জা তার কথা কোথায় থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন বুঝছি না। বললাম, জি, ইবনে বতুতা বলেছিলেন। তবে তার এই কথায় আমরা এ দেশবাসী মনে কষ্ট পেয়েছি! উনি বলেছিলেন আমাদের দেশের আবহাওয়া খুবই অদ্ভুত ও অসহনীয়। গ্রীস্ম, বর্ষায় বৃষ্টি, স্যাঁতস্যাঁতে পরিবেশ ইত্যাদি। এজন্য নাকি বাঙ্গালা দোজখ। কিন্তু এই আবহাওয়া আমাদের নিকট অতি পছন্দের। আচ্ছা ভালো কথা, হোজ্জা, আপনি ইবনে বতুতাকে “বৎস” বলছেন কেন জানতে পারি? উনি তো অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি।
–তুমি দেখি কিছুই জানো না, মুরাদ! আমার জন্ম ১২০৮ সালে। সে অনুযায়ি ইবনে বতুতা আমার নাতির পুত্রের সমান বয়সী। সে তোমাদের দেশে এসেছিল ১৩৪৬ সালে। তার জন্ম ১৩০৪ সালে। তার জন্মের বহু আগে আমার মৃত্যু হয়েছে। অবশ্য আমার মৃত্যু কবে হয়েছে এই নিয়ে আমি কিছুটা দোটানায় ভুগি। কোনো ঐতিহাসিক সূত্র বলছে আমার মৃত্যু ১২৭৫ সালে, কোনো সুত্র বলছে ১২৮৫ সালে। এজন্য নিশ্চিত হতে পারছি না ১০ বছর বেশি বেঁচেছিলাম নাকি কম।
হোজ্জার কথা শুনে আমার মাথা গুলাচ্ছে। উত্তরে কী বলব বুঝতে পারছি না। অবশ্য হোজ্জার কথার উপর কখনো কারো কিছু বলার থাকে না। আমিও চুপ থাকি। তা-ই নিরাপদ। হোজ্জা হঠাৎ কিছুটা উসখুস করতে লাগলেন।
–হোজ্জা, কোনো সমস্যা হয়েছে?
–এসিড বন্ধ করতে বলো।
–এসিড কী হোজ্জা?
–শীত করছে। আর সহ্য হচ্ছে না।
বুঝলাম হোজ্জা এসি কে এসিড বলে ফেলেছেন। আমি কথা বাড়ালাম না। এসি বন্ধ করা হলো। হোজ্জা বললেন, জানালা খুলে দাও।
জানালা খুলে দেয়া হয়েছে। জ্যাম কিছুটা ছাড়ি ছাড়ি করছে। তবে ছাড়বে বলে মনে হচ্ছে না। বাইরের গাড়ির ভ ভ আওয়াজ আসা শুরু করেছে। হরেনের প্যা প্যা শব্দ। আমি ভয়ে আছি, হোজ্জা না বিরক্ত হয়ে যান। হঠাৎ দমকা বাতাস উঠল। অনেকগুলো ধুলা আমাদের গাড়িতে ঢুকে গেল! হোজ্জা হাতের ইশারায় আমাকে গাড়ির জানালা বন্ধ করতে নিষেধ করলেন! তিনি বাইরে তাকিয়ে আছেন।
আমাদের গাড়ির সামনেই একটা বিশালদেহী বাস দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষণে ক্ষনে দুর্গন্ধযুক্ত কালো ধোঁয়া ছাড়ছে। সামনে পেছনে ডানে বামে অসংখ্য ছোট বড় গাড়ি । বাতাস খুবই বিষাক্ত হয়ে গেছে। শ্বাস টানা যায় না ঠিকমত। অতিদ্রুত জানালা বন্ধ করা দরকার। হোজ্জাকে বললাম, হোজ্জা, জানালা বন্ধ করে দেই?
হোজ্জা হাসলেন। বললেন, যা দেখার আমি দেখে ফেলেছি, আর মান সম্মান রক্ষার চেষ্টা কোরো না। এই তোমাদের রাজধানী? আমাদের সময় রাজধানী বলতে বোঝাত সবচেয়ে সুরম্য সুসজ্জিত নগরী। আর তোমাদের রাজধানী নাকি বায়ু দূষনে চ্যাম্পিয়ন হতে চেয়েও পারে না? দ্বিতীয় পজিশন থেকে প্রথম হওয়ার জন্য ধাক্কা ধাক্কি চেষ্টা করছ তোমরা? চেষ্টা চালিয়ে যাও। চেষ্টায় কি না হয়!
আমি হতভম্ভ হয়ে গেলাম। হোজ্জার সাথে চলা বেশ মুশকিল দেখছি। ভাবছি এত তথ্য কে তাকে দিয়েছে? যে দিয়েছে সেই লোককে যদি ধরতে পারতাম। দেশের মান সম্মান আর রক্ষা করা যাচ্ছে না।
হোজ্জা বললেন, যানজট ছাড়বে বলে তো মনে হচ্ছে না। মুরাদ বৎস! দেশ থেকে অন্য দেশ যেতে আকাশপথে যেমন বিমান যাত্রার ব্যাবস্থা আছে, সেই ব্যাবস্থা তোমরা এখানে করতে পারো না? তাহলে অতি আরামে এয়ারপোর্ট থেকে তোমাদের বাড়ির ছাদে শো করে উড়ে চলে যেতাম! কী! এই বুদ্ধি তোমাদের মাথায় কেন আসে না?
হঠাৎ জ্যাম ছেড়ে গেল। গাড়িগুলো যেন চলার জন্য মাতাল হয়ে গেছে । হোজ্জা মাতাল গাড়িগুলোকে দেখছেন। আমিও নির্বিকার ভঙ্গিতে বাইরে তাকিয়ে আছি। আমাদের সামনের ডান দিকের বাসটা যাত্রা শুরু করতে দেরি করেছে কেন বুঝছি না। যা ব্যাটা যা। যাস না কেন? পেছন থেকে আরেককটা বাস এসে দিল সেটাকে সজোরে ধাক্কা। আমি সাথে সাথে হোজ্জার দিকে তাকালাম। বললাম, হোজ্জা দেখেছেন! আমাদের আধুনিক মানুষের বুদ্ধি কম না। এজন্যই শহরের অভ্যন্তরে বিমানের ব্যাবস্থা নেই। ভেবে দেখুন এই জ্যাম যদি আকাশপথে লাগত তাহলে বাসের বদলে বিমানে বিমানে ধাক্কা লাগত। তাহলে উপর থেকে বিমান নিচে পড়ে গেলে যাত্রীরা কি কেউ বাঁচত?
হোজ্জা কোনো কথা বলছেন না।। মনে হয় আমার যুক্তি তার মনঃপুত হয়েছে! হোজ্জাকে যুক্তিতে হারিয়ে দিতে পেরে আমি মনে মনে আনন্দ অনুভব করছি।
জ্যাম ছাড়ার পর গাড়িগুলো পাগলের মত ছুটছে । রাস্তা গাড়ির দূর্গন্ধযুক্ত ধোঁয়ায় ভরে গেছে । একটা ডাস্টবিনের পাশ দিয়ে যাচ্ছি, সেখান থেকেও দূর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। ভয়ানক সেই গন্ধ। হঠাৎ খুব উঁচু নিচু রাস্তায় এসে পড়লাম। গাড়িতে প্রবল ঝাঁকুনি হচ্ছে। পাশে দেখলাম এক রিকশাওয়ালা যাত্রীসহ চিপার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। তাকে যেতে হচ্ছে ভয়ানক ভাঙ্গাচোড়া রাস্তা দিয়ে । ব্যাপক ধাক্কা খেল রিকশা। রিকশাওয়ালা চিৎকার করে বলল, জয় বাংলা!
সবাই রিকশাওয়ালার দিকে তাকাচ্ছে। হোজ্জা বললেন, সত্যিই আজীব দেশ! দুরবস্থায় পড়েও এই লোকটি দেশের জয়গান গাচ্ছে!
আমাদের এলাকায় প্রায় চলে এসেছি। একটা ব্রিজের নিচ দিয়ে ঢুকতেই সামনে থেকে ধোঁয়া আসতে লাগল কুয়াশার মত। বুনকো বুনকো ধোঁয়া। কীসের ধোঁয়া? ভ ভ আওয়াজ কানে আসে। মশা মারার ওষুধ স্প্রে করছে মনে হয়! দেখতে দেখতেই ব্রিজের নিচের টানেল ধোঁয়ায় অন্ধকার হয়ে গেল। টানেলেই ধোঁয়া দিয়েছে সিটি কর্পোরেশনের ধোঁয়াওয়ালা। চারিদিকে ঘোলা। কিছু দেখা যায় না। ড্রাইভার গাড়ির লাইট জ্বালিয়ে দিয়েছে। হোজ্জা বললেন, দোজখপুর ই নিয়ামত! দোজখপুর ই নিয়ামত!
আমার চেহারা লজ্জায় লাল হবার জোগাড়। হোজ্জা আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন ।
‘বুঝলে মুরাদ ? বৎস ইবনে বতুতা ৭০০ বছর আগে তোমাদের দেশকে এই উপাধি না দিয়ে বরং এই সময় দিলে ভুল করত না। ছেলেমানুষ তো! ভুল সময়ে সঠিক কথাটি বলে ফেলেছিল। তবে আমি তাকে ক্ষমা করলাম।’
হোজ্জাকে থামানো দরকার। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। হোজ্জা এসেই আমাদের দেশের এত এত বদনাম করে যাচ্ছেন। বললাম, হোজ্জা, দেশের যা ক্ষতি হয়েছে, তার বেশিরভাগ করেছে একটি বিশেষ খানদান ও তাদের লোকেরা! আমরা এবার কাতারে কাতারে প্রাণ দিয়ে তাদের শাসন উৎখাত করেছি। দেশকে আমরা নতুনভাবে গড়তে চাই। আপনি আমাদের দুর্নাম করবেন না। মনে ব্যাথা পাই। বরং আপনি দুআ করুন।
হোজ্জা বললেন, বৎস, কষ্ট পেও না। তোমরা এবার যা সাহসিকতা দেখিয়েছ, যে অভ্যুত্থান করেছে তা শুনে আমি বড়ই খুশি হয়েছি। আমি মনে করি আমাদের তুর্কি জাতীর মত তোমরাও একটি সাহসী জাতি! আর এজন্যই তো বই এর পাতা থেকে উঠে তোমাদের দেশে বেড়াতে আসার উৎসাহ পেয়েছি! না হলে কতকাল গেল, কতজন নিমন্ত্রণ করল! আমেরিকা করল, চায়না করল, ফ্রান্স করল। আমি নাক সিঁটকালাম। বলো, ভালো করেছি না?
হোজ্জার উত্তরে আমি খুশি হলাম। আমি বললাম, আমাদের দেশে আপনাকে স্বাগতম প্রিয় হোজ্জা! তিনি বললেন, মারহাবা! মারহাবা!
হোজ্জা আমার হাতে মোসাফাহা করলেন শক্ত করে। আমি তার চোখে আনন্দের খেলা দেখতে পেলাম। সেই আনন্দে খাঁদ নেই। কারণ, দু’চোখের কোণাতেই আনন্দ অশ্রু জ্বলজ্বল করছে।