
(২য় পর্ব)
হোজ্জার চাওয়া মত বাসা সাজানো হয়েছে। বাসা হলো আমাদের বিল্ডিং এর দ্বিতীয় তলার উত্তর সাইডের ফ্লাট। দুই রুম এক ডাইনিং স্পেস। বাসা ফাঁকা ছিল। এই মাস আর সামনের মাসে ভাড়াটিয়া উঠানো হবে না। রুম বরাদ্দ থাকবে নাসিরুদ্দীন হোজ্জার জন্য। তার সার্বক্ষনিক খেদমতে থাকব আমি। বাসা সাজাতে আমার মোটেও বেগ পেতে হয় নি। কারণ হোজ্জা বলে দিয়েছেন শুধু একটা ৫ ফুট বাই ৭ ফুট তোষক ফ্লোরে দিয়ে এর উপর বিছানার চাদর আর বালিশ দিয়ে দিতে। যথাযথ ভাবে দেয়া হয়েছে।
হোজ্জা বসে আছেন। লেবুর শরবত খেতে দিয়েছি। তিনি খেয়ে বললেন, অতি উপাদেয়!
বললাম, ঘর আপনার কথা অনুযায়ী ফাঁকা রাখা হয়েছে হোজ্জা। না হলে কিছু প্রয়োজনীয় আসবাব রাখতাম। হোজ্জা বললেন, অন্য কিছুর দরকার নেই। তবে একটা বড় সাইজের আলমারি হলে ভালো হত।
–বিশেষ করে আলমারি কেন হোজ্জা? মূল্যবান কিছু রাখবেন আলমারিতে?
-আমার আর মূল্যবান কিছু কী-ই বা আছে? কিছুই তো নেই। চোর যদি ঘরে আসে কিছুই পাবে না। এই লজ্জায় আমি লুকাবো কোথায়? আলমারিতেই তো!
–হোজ্জা, চোরেরই তো লজ্জা নাই, অন্যের জিনিস চুরি করতে এসেছে। আপনি কেন লজ্জা পাবেন?
–চোরের লজ্জা নাই, এজন্যই আমার লজ্জা পেয়ে শুন্যস্থান পূরন করতে হবে না? হবে তো। আমি অতি দায়িত্বশীল একজন ব্যক্তি। শুন্যস্থান ফাঁকা রাখি না।
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খাচ্ছি। হোজ্জার সাথী হতে হলে মনে হয় ভ্যাবাচ্যাকার উপরেই থাকতে হবে। আল্লাহ মা’লুম। বললাম, হোজ্জা, চোরের ভয় নেই। প্রত্যেক তলার সিঁড়িতেই সিসি ক্যামেরা আছে। ধরার পরার ভয়ে চোর আসবে না।
হোজ্জা যা বললেন তা শুনে আমার আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। তিনি বললেন, বৎস মুরাদ, ভেবে দেখো তো, চোর যদি গভীর রাতে এসে সব সিসি ক্যামেরার সরঞ্জাম খুলে চুরি করে নিয়ে যায়। তাহলে কীভাবে আটকাতে পারবে?
আমি চুপ করে গেলাম। প্রসঙ্গ ঘুরানোর জন্য বললাম, হোজ্জা, যুহরের সময় হয়ে যাচ্ছে। আপনি গোসল করে নিন। নামাজ পড়ে এসেই দুপুরের খাবার খাবো ইন শা আল্লাহ। অনেক পদের খাবার রান্না হয়েছে।
হোজ্জার নামাজ পড়তে বেশ সময় লাগছে। আমার সুন্নাত নফল শেষ হওয়ার পরেও বসে আছি। এক পর্যায়ে নামাজ শেষ হলো তার। মসজিদের বাইরে বের হয়ে দেখি হোজ্জার জুতা নেই। অনেক খোঁজাখুঁজি করলাম। না, নেই। চুরি হয়েছে নিশ্চয়ই। মসজিদের বাইরে একটা জটলার মত হয়ে গেল। হোজ্জার জুতা চুরি হয়েছে । হোজ্জা কাঁদতে লাগলেন। আমি অবাক হলাম। হোজ্জা কাঁদবে কেন? তিনি না লজ্জা পাওয়ার কথা? আর হোজ্জার জুতা বলতে পুরাতন এক জোড়া খড়ম। এই খড়মের জন্য কাঁদা!
চুপ থাকতে পারলাম না। বললাম, হোজ্জা! কাঁদছেন?
হোজ্জা বললেন, আহা বেচারা চোর! এত কষ্টে আছে, জুতা চুরি করতে হচ্ছে তাকে। তাই বলে আমার এই পুরাতন খড়ম জোড়া! আহা, চোরটির দূর্দশার কথা ভেবে কান্না পাচ্ছে। চোরের জন্য বড় দয়া হচ্ছে। চোরের প্রতি আমি কোনো অভিযোগ রাখলাম না।
চারদিকে ছোট জটলা। হোজ্জা চোখ মুছছেন। লোকেরা দাঁড়িয়ে উৎসুক চোখে দেখছে । আমি চুপ করে আছি। হোজ্জাকে কীভাবে বোঝাই যে, চোরের জন্য এত কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই? চোর এত মাসুম না।
‘হোজ্জা! চলুন বাসা যাই।’
হোজ্জা সাড়া দিলেন।
বাসার কাছাকাছি চলে এসেছি এমন সময় কে একজন ডাকল। পেছন ফিরে দেখি– চিকন শরীরের এক ছেলে। মুখে মাস্ক। কাঁধে স্কুল ব্যাগ। সে এগিয়ে আসছে। বললাম, কী চান ভাই? কে আপনি?
ছেলেটা কথা না বলে ব্যাগ খুলতে লাগল। আমি হোজ্জার হাত ধরে পেছনে সরে গেলাম। ব্যাগ থেকে কি না কি বের করে।
আমাদেরকে অবাক করে দিয়ে ব্যাগ থেকে এক জোড়া খড়ম বের হলো। ঠিক হোজ্জার খড়মের মত দেখতে!
বললাম, কোথায় পেলেন এই খড়ম?
ছেলেটি বলল, এগুলো এই হোজ্জার খড়ম। চুরি হয়েছিল।
‘আপনি কিভাবে পেলেন?’
‘কীভাবে আর পাবো। আমিই চোর।’
‘তুমিই চোর! এখন খড়ম ফেরত দিতে চাও?’
‘জি। হোজ্জা মসজিদের সামনে বললেন, চোরকে মাফ করে দিয়েছেন। এজন্য ভাবলাম ভালো একটা লোককে কষ্ট দিয়ে লাভ কি? তাই ফেরত দিতে এলাম। তাছাড়া এই খড়ম বিক্রি করে এক টাকা পাবো না।’
‘Oh, I see! তুমি চুরি করার পর আবার মসজিদের সামনের জটলায় থেকে আমাদের কথাও শুনেছে! সাহস তো কম না!’
ছেলেটা মাথা চুলকাচ্ছে। হোজ্জা জিজ্ঞেস করতে বললেন, এত জুতা ছেড়ে এই পুরাতন খড়ম চুরি করতে গেছে কেন সে? জিজ্ঞেস করলাম। উত্তরে যা শুনলাম, তা হলো– চোর বালকটির মনে হয়েছে দামি জুতা বাসায় রেখে চোরকে উল্লু বানানোর জন্য পুরাতন খড়ম নিয়ে এসেছে কোনো মুসল্লী। উল্টা সেই মুসল্লীকে উল্লু বানাতে এবং শায়েস্তা করার জন্য সব বাদে খড়ম চুরি করেছে সে। শাস্তি হলো– খড়মের মালিক খালি পায়ে হেঁটে বাসা যাবে। ময়লা রাস্তা মাড়াবে!
আমি হোজ্জার পায়ের দিকে তাকালাম।
তার পায়ে আমার জুতাজোড়া। আমিই তাকে দিয়েছি।
চোর বালকটি এবার আমার পায়ের দিকে তাকাল। স্বভাবতই দেখতে পেল– আমার পা খালি। আমি রেগে তাকালাম তার চোখ বরাবর। ছেলেটা সঙ্কুচিত হয়ে সরে গেল। আমি কিছু বলার আগেই সে বলল, সরি ব্রাদার।
হোজ্জা আমার পিঠ চাপড়ে বললেন, মুরাদ রেগো না, এই ছেলে চোর হলেও কিন্তু সৎ আছে। সব কথা বলে দিল হরহর করে। তাকে আমার পছন্দ হয়েছে। খুবই সম্ভাবনাময় ছেলে।
হোজ্জা চোরকে শুধু সম্ভাবনাময় বলে প্রশংসাই করলেন না, কিছুক্ষণের মধ্যে একটি অসম্ভবকেও সম্ভব করলেন। তিনি চোর বালকটিকে দুপুরের দাওয়াত দিলেন। আমাদের সাথে খাবারে শরীক হতে বললেন। আশ্চর্য্য! ছেলেটাও ইতস্তত করল না। আমাদের পিছু পিছু চলে এল।
আমি একটা ঘোরের মধ্যে আছি বলে মনে হচ্ছে। হোজ্জার সাথে থাকলে অনেক কিছুই আজীব আশ্চর্য্য ঘটবে, কিন্তু এমন আজীব ঘটনা ঘটবে তা কল্পনাও করি নি। চোর ধরা পড়লে তার পিটুনি খাওয়ার কথা ছিল। সে নাকি এখন আমাদের সাথে দুপুরের লাঞ্চ খাবে।
(চলবে)