Posts

উপন্যাস

পল্টনে জ্যামবন্দি নাসিরুদ্দীন হোজ্জা (রম্য উপন্যাস) ৩য় পর্ব

September 11, 2025

ইহতেমাম ইলাহী

49
View

(৩য় পর্ব) 
পাবদা মাছ, কাতল মাছ, টাকি মাছের ভর্তা, ডাল ভুনা, খাসির মাংস, লাউ শাক, ডিমের কোর্মা, টমেটো চাটনি, আলু ভর্তা, বেগুন ভর্তা, সালাদ সাথে সাদা ভাত। আমার মায়ের কর্ম! সব খাবার যথেষ্ঠ পরিমাণে মওজুদ। মা’কে এর কমে রাজি করানো সম্ভব হয় নি। তার যুক্তি হলো, হোজ্জা ভিনদেশী মানুষ, নিজ দেশে ফিরে গিয়ে যেন বাংলাদেশের নাম করে। খেতে বসেছি আমি, হোজ্জা এবং বিশিষ্ট ছেলেটি। (ছেলেটির নাম কবির, এখন থেকে এই নামেই তার কারগুজারি উল্লেখ করব। খাবারের দিকে তাকিয়ে তার চোখ বেশ আনন্দিত মনে হচ্ছে।) হোজ্জা বললেন, তিন জন মানুষ এত আইটেম খাবার কীভাবে খাবো। বললাম, আপনি তো খেতে বেশ পছন্দ করেন হোজ্জা। তাই এত আয়োজন।

  ‘তাই বলে এত খাবার। এত খেলে তো মনে হয় আর নড়াচড়া করতে পারব না। শুয়ে শুয়ে দিন কাটানো তো ভালো বিষয় নয় হে। আর এমনিতেও বুড়ো হয়েছি।’

আমি বললাম, আচ্ছা, সব খেতে হবে না হোজ্জা। আপনি যেটা পছন্দ করেন সেটা দিয়েই খেতে পারেন।
নাসিরুদ্দীন হোজ্জা রুটি খেয়ে অভ্যস্ত। রুটির সাথে কোনো তরকারি। সহজ খাবার। কিন্তু ভাতের সাথে কোন আইটেম দিয়ে খেতে শুরু করবেন, কোন আইটেম দিয়ে শেষ করবেন– এই নিয়ে বোধয় তিনি কিছুটা দোটানায় আছেন, স্পষ্টই বুঝতে পারছি। 

খাবার পরিবেশনের ব্যাপারে আমি যথেষ্ঠই পারদর্শী। হোজ্জাকে পারফেক্ট সময়ে পারফেক্ট আইটেমটা প্লেটে দিয়ে সব আইটেমই খাইয়ে দিচ্ছি।  কবিরও আরাম করে খাচ্ছে। তার চেহারায় লাজুক ভাব। ফাঁকে দিয়ে নিজেও খাচ্ছি। হোজ্জা কবিরকে বললেন, কী করো তুমি,  বৎস?

আমি ভাবছি, চোর আবার কী করে? চুরিই তো করে। হোজ্জার আজীব প্রশ্নের মানে হয়?

কবির বলল, পার্ট টাইম চুরি করি। পার্টটাইম পড়ালেখা। হোজ্জা বললেন, আজীব! বড়ই আজীব। এই লাইনে এলে কীভাবে? 

কবির বলল, ভাবছেন আমি জুতা চোর। পুরাতন জুতা চুরি করে পোষায় না কারো। কত টাকা আর বিক্রি হয় পুরান জুতা। ইদানিং মসজিদে মসজিদে সি সি ক্যামেরা। 

আমি তাকে থামিয়ে বললাম, এই তুমি সি সি ক্যামেরার সরঞ্জাম ইত্যাদি চুরি করেছ কখনো?
  –হ্যাঁ! করেছিলাম একবার।
  –ওহ!
  –বাড়িওয়ালার উপর রাগ ছিল ভাই! সুযোগ মত শেষ রাতে ৫ তলা পর্যন্ত সব ক্যামেরা, রেকর্ডার, মনিটর যা যাবতীয় সব চুরি করেছিলাম।
  –সেই বাড়িতে কেয়ারটেকার ছিল না?
  –না ছিল না। 

আমি হতভম্ভ। হোজ্জার দিকে লজ্জিত ভঙ্গিতে তাকালাম। হোজ্জার চেহারা ভাবলেশহীন। তিনি সুন্দর ভঙ্গিতে পাবদা মাছ ভেঙ্গে মুখে দিচ্ছেন। তার খাওয়া দেখে বুঝতে পারছি– রান্না অনেক মজা হয়েছে। আমি খাসির রেজালা তুলে দিলাম তার প্লেটে। তিনি কবিরের দিকে তাকালেন। বললেন, এখন তাহলে জুতা চুরি ধরেছ? 

কবির খেতে ব্যাস্ত। মুখ ভরা খাবার। সে পানি খেয়ে নিল। বলল, আমরা মূলত যাই মোবাইল ফোন, মানিব্যাগ চুরির আশায়।
–Oh! I see (আমি ও হোজ্জা একসাথে বললাম! হোজ্জা বললেন আরবি ভাষায়)
–ফাঁকে দামি জুতা পেলে তাও নিয়ে নিই।
আমি বললাম, তুমি এই লাইনে এলে কীভাবে কবির ভাই!?

আমি তার প্লেটে ডাল দিলাম, তার খাওয়া প্রায় শেষ। সে লাউ শাক তুলে নিতে নিতে বলল, আমার এক আত্মীয় থাকে বর্ডার এলাকায়। বিশাল চোরাচালান। সে আবার হোজ্জার ভক্ত। ভালো কথা, হোজ্জার সাথে তাকে দেখা করায় দিতে চাই, সমস্যা আছে?

‘সমস্যা আছে।’ হোজ্জা রুঢ় কন্ঠে বললেন। চোরাচালান লোকটা আমার ভক্ত হলো কীভাবে? বানিয়ে বানিয়ে কথা বলছ হে?’

হোজ্জার চেহারায় রাগ ফুটে উঠছে। কবির কাচুমাচু করে বলল,  না হোজ্জা। শুনেন, সে কত বড় চোর। আমাকেও চোর বানায় দিছে সে। একদিন ডিওএইচএস মসজিদে আমাকে নিয়ে ঢুকল। ধনীদের এলাকা। যুহরের ওয়াক্তে নামাজের শেষে শেষে ঢুকেছি মসজিদে। এক চাকরীজীবি লোক তাড়াহুড়া করে দাঁড়াল মোবাইল মানিব্যাগ সামনে রেখে। আমার আত্মীয় পেছনে নামাজে দাঁড়াবে দাঁড়াবে ভাব করছে। যেমনি চাকরীজীবি লোকটি সিজদায় গেল, অমনি মোবাইল মানিব্যাগ টান দিয়ে নিয়ে নিল সে। মুহুর্তে মসজিদে থেকে বেরিয়ে গেল অন্য গেট দিয়ে। আমি তো যা  ভয় পেয়ে গেছি সেদিন। আমার বুক ধুকপুক শুরু করেছে। থামছিলই না। সেখান থেকে পাশের আরেক মসজিদে আসরের নামাজের সময় ঢুকলাম। নামাজ শেষ হয়ে গেছে। আমরা ওজুর ভান করে ওজুখানায় বসে আছি। দেখলাম এক দাড়িওয়ালা হাফেজ সাব ওজু করে তার ব্যাগ মসজিদের বারান্দায় একটা পিলারের কাছে রেখে ভিতরে নামাজ পড়তে গেল। ব্যাগের কথা ভুলে গেছে হয়ত!  বারান্দায় কেউ নাই। আমার সেই আত্মীয় আমাকে এমন একটা ধাক্কা দিল! ধাক্কা দিয়ে বলল, যা জিনিস নিয়ে ভাগ। এমন ভাবে ধাক্কা খেয়েছি, ঠিক ব্যাগের সামনে এসে পড়লাম। মাথা কাজ করছিল না। ব্যাগ নিয়ে সোজা ভেগে গেলাম। রিকশায় উঠে খুব ভয় লাগছিল। যদি ধরা পড়ি সব শেষ। ভয়ে ভয়ে ব্যাগ খুললাম। দেখি রাবারে বাঁধা টাকার তোড়া। গুনে দেখলাম ২৩ হাজার ৫০০ টাকা। এই যে চুরির জিনিসের প্রতি লোভ হলো। এই লোভ আর কমে না।


হোজ্জা ও আমার দুজনের চোখই বড় বড় হয়ে গেছে। এই ছেলে তো ভয়ানক চোর। জিজ্ঞেস করলাম, ভয়ানক চোর ভাই তোমরা। কিন্তু তোমার আত্মীয়কে চোরাচালান বললে যে?
  –সে মাঝে মাঝে ঢাকা এসে চুরি করে আবার ভাগে। মূলত সীমান্ত এলাকায় চোরাচালানে যুক্ত সে।
  –সে হোজ্জার ভক্ত কীভাবে ? 

কবির কী বলে– তা শুনতে আমরা আগ্রহ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছি। সবার খাওয়া শেষ। বললাম, দাঁড়াও হাত ধুয়ে নিই সবাই। তারপর তোমার গল্প শুনি। 

খাওয়া শেষে আধশোয়া হয়ে আছি সবাই। কবির বলল, এত কথা বলে দিচ্ছি। পরে আমাকে ফাঁসাবেন না তো?
বললাম, হোজ্জা ফাঁসানোর লোক না। তুমি নিশ্চিন্তে বলো সব। 
‘হোজ্জাকে নিয়ে আমার চিন্তা নাই। আমি ভাবতেছি আপনার কথা। আপনি তো আর হোজ্জ না।’
বললাম, আমি হোজ্জা না হলেও হোজ্জার শিষ্য। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো।
কবির বলল, একটা গল্প আছে না? হোজ্জা ইরানি সীমান্তে চোরাচালান করে অনেক টাকাপয়সা বানিয়ে ফেলে। সীমান্তের প্রহরীরা ধরতে পারে না হোজ্জা কী চোরাচালান করেন। তারা দেখে– হোজ্জা প্রতিদিন গাধার পিঠে করে খড়ের বস্তা নিয়ে যাওয়া আসা করেন।  প্রহরীরা ছেড়ে দেয়।
    –তা তো দেবেই।
  –মূল কাহিনী হলো, হোজ্জা প্রতিদিন গাধা চোরাচালান করেন। গাধার পিঠে থাকে খড়ের বস্তা। গাঁধার পিঠে খড়ের বস্তা রাখা হয় ধোঁকা দেয়ার জন্য।  প্রহরীরা বস্তা খোঁজাখুঁজি করে, কিছু পায় না।

হোজ্জাকে কাহিনী সংক্ষেপে বুঝিয়ে বললাম। তিনি শুয়ে পড়েছিলেন। তিনি শোয়া থেকে উঠে বসলেন। তাকে ক্ষিপ্ত মনে হচ্ছে। তিনি বললেন, এই গল্প মিথ্যা। আমি এমন কাজ করি নি। আমার নামে কে এসব বানিয়েছে। খুবই কষ্টকর ব্যাপার। আমি মানুষটা অতি চালাক বা অতি বোকা হতে পারি, তাই বলে চোর না

আমি হোজ্জাকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম। বললাম, আপনি কখনোই চোরাচালান করতে পারেন না। এগুলো মিথ্যা গল্প।
কবির মনে হয় কিছুটা মুষড়ে গিয়েছে। চুপচাপ মাথা নিচু করে আছে। আমি মনে মনে চাচ্ছি হোজ্জার রাগ না কমুক। এই বিশিষ্ট ব্যক্তি কবির দ্রুতই আমাদের থেকে আলাদা হলেই ভালো। তাকে বললাম, তোমার আত্মীয় আর কোনো গল্প পেলো না? বেছে বেছে এই গল্পই অনুসরণ করল। আসলে গল্পটা বানানো হলেও মূল সমস্যা তোমার আত্মীয়ের, চুরি স্বভাব তার চরিত্রেই আছে। 

কবির বলল, হ্যাঁ, চিন্তা করেন, সে আমাকে পর্যন্ত চোর বানিয়ে দিয়েছে। সে সীমান্তে সাইকেল চোরাচালান করে। সাইকেলের মধ্যে থাকে বালুর বস্তা। সীমান্তরক্ষীরা বালুর বস্তা খুঁজে কিছু পায় না। তাকে ছেড়ে দেয়। 

হোজ্জা বেশ রেগে আছেন। তার চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে। তাকে কিছুটা বিমর্ষও লাগছে। আমি হোজ্জার মনোযোগ অন্যদিকে ফেরানোর উদ্দেশ্যে বললাম, খাবারগুলো আমার মা বানিয়েছেন। কেমন রান্না হয়েছে হোজ্জা? খেতে ভালো লেগেছে? 
  –হুম, রান্না ভালো হয়েছে– কিন্তু তোমার মা’কে ধন্যবাদ দিতে পারছি না। তাকে অধন্যবাদ। ধন্যবাদের বিপরীত।

হোজ্জার কথায় রাগ ঝড়ে পড়ছে। কবিরের উপর তৈরি হওয়া রাগ শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে পড়বে বুঝছি না! আমি পরিস্থিতি সামলাতে হিমশিম খাচ্ছি। চুপ থাকাই মনে হয় ভালো এখন।
হোজ্জা আবার বললেন, খাবারগুলো খেয়ে  আমার পেটের ক্ষুধা মিটেছে কিন্তু মনের ক্ষুধা মিটে নি। এত এত আইটেম, সব চমৎকার স্বাদ, সব গুলোই অল্প অল্প খেতে গিয়ে কোনোটাই ভালোমত খেতে পারলাম না। জিভের বিভিন্ন পয়েন্টে বিভিন্ন খাবারের স্বাদ লেগে আছে ।  জিভ সেই স্বাদ আরও পেতে চাইছে। এদিকে পেট ঢোলের সাইজ নিয়েছে। বড়ই অস্বস্তি । খাবার খাওয়ার পরেও আফসোস থেকে গেল। এক দুই আইটেম দিয়ে পেট ভরে খেলে বরং শান্তি পাওয়া যায়। তোমার মা আমার এই অস্বস্তির জন্য দায়ী। আমি দরিদ্র মানুষ, নিজের বাড়িতে যখন থাকব তখন তো এত এত খাবার পাবো না। রুটি, ডাল সবজিই আমি খাই। কোনো কোনো দিন মাংস জুটে। তোমাদের এই বহুপদী  খাবার খেয়ে মুখের যা রুচি তৈরি হবে, আমার বাড়ির সস্তার খাবার তো আর মুখে রুচবে না। তখনও থেকে যাবে আফসোস। আফসোস! বড়ই আফসোস। 


 

আমি এবার সত্যি সত্যি ঘাবড়ে গেলাম। হোজ্জার দৃষ্টিভঙ্গি বড়ই আশ্চর্য্য । তবে তাকে ভুলও বলা যাচ্ছে না। বললাম, হোজ্জা! রাতে তাহলে মাত্র দুই আইটেম করব। এতে সুবিধা হবে। হোজ্জা বললেন, রাতে আরো খাবার!  এত খাবার খেলে আমার ঘুম ভাঙ্গবে না সহজে। ঘুম খাওয়া চক্র চলতে থাকবে। ঘুম খাওয়া ঘুম। ঘুম খাওয়া ঘুম।
আমি আতংকিত বোধ করছি। হোজ্জার রাগ বোধয় কমছেই না । বললাম, রাতে কিছুই খাবেন না, হোজ্জা?
হোজ্জা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, এক পোয়া ছাগলের দুধ কি ব্যাবস্থা করে দিতে পারো? গরম করে আবার ঠান্ডা করবে। সেই দুধ দিয়ে গলা ভেজাবো।

গরুর দুধে চলবে কি না, হোজ্জাকে জিজ্ঞেস করব ভাবছি। ছাগদুগ্ধ তো দেশ থেকে উঠেই গেছে। এর মধ্যেই কবির বলল, হোজ্জা, আমি ছাগদুগ্ধের ব্যাবস্থা করতে পারব। আমার মায়ের পোষা রামছাগলের বাচ্চা হয়েছে মাসখানেক আগে।
হোজ্জার চেহারা উজ্জ্বল হয়ে গেল। বললেন, যাক, আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কাজের ছেলে আছো। খালি চুরিটা ছাড়ো। অন্য কোনো কাজ পার না?
কবির বলল, হোজ্জা, লজ্জার কথা আর কি বলব, পকেটমারির ট্রেনিং নিই মাস দুয়েক হলো! কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে চুরি পকেটমারি বন্ধ করে দিতে হবে।  তবে অন্য কোনো কাজ জানি না। 

হোজ্জা বললেন, আচ্ছা। দেখি কি করা যায়। খেয়েছ, এখন ঘুম দাও কিছুক্ষণ। আসরের পরে বের হবো ঘুরতে। 


ঘরের ফ্লোরের দু’দিকে দুটি বিছানা। হোজ্জা শুয়ে পড়েছেন। ছেলেটিও শুবে হয়ত। আমি শোয়ার আগে চারতলায় আমাদের ফ্লাটে গিয়ে মোবাইল মানিব্যাগ রেখে আসব। বলা যায় না, সরষের মধ্যে ভুত অবস্থান করছে। মানে ঘরের মধ্যে চোর । যদিও সে চুরি ছেড়ে দিবে বলেছে। তবুও সাবধানের মার নেই– এই নীতিবাক্য মেনে চলা অপরিহার্য্য মনে করছি।  


(চলবে)

Comments

    Please login to post comment. Login