Posts

উপন্যাস

চোখের তারায় জোনাকির আলো (১ম পর্ব)

September 11, 2025

ইহতেমাম ইলাহী

50
View

(১ম পর্ব)

 ‘হাসান ভাই, এই হাসান ভাই’
  ‘হুমমম’
ধরফর করে উঠল হাসান। মোবাইলে ঘড়ি দেখল । ফযরের ওয়াক্ত আর ৭ মিনিট বাকি। ডেঙ্গু জ্বর পরবর্তী ভীষন ক্লান্তি তার শরীরে। চোখ-শরীর তাকে বিছানায় টেনে ধরছে।  কিন্তু শরীরকে অগ্রাহ্য করতে হবে এখন। দুই মিনিটে ওজু, ৪  মিনিটে নামাজ। ওয়াক্তের মধ্যে নামাজ,  হৃদয়ের আপাত প্রশান্তি।

সালাম ফেরানোর পর হাসান দোটানায় পড়ে গেল। এক্ষুনি বিছানায় শুবে, নাকি বসে কিছুক্ষণ যিকির আযকার করবে? শরীরে কেমন একটা উত্তাপ, ঝিম ঝিম অনুভূতি। দেয়ালে পিঠ লাগিয়ে চোখ বন্ধ করল সে। সাথে সাথেই মাথায় এটা সেটা চিন্তার ঢেউ আসতে শুরু করল। ডেঙ্গুর পর থেকে  ভাবনার একটা আবেশ তাকে আচ্ছন্ন করে রাখছে খুব ভালোভাবেই । অবশ্য সে ভাবতে ভালোবাসে। ক্লান্ত শরীরে ভাবনা গুলো কেমন নিজ থেকেই আসে, নিজ থেকেই চলে যায়। কোনো বিষয়ে ভাবতে অতিরিক্ত চেষ্টার দরকার হয় না। ভাবনার আবেশে দরকারি কিছু বিষয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিশ্লেষন সহজেই হয়ে যাচ্ছে। এতে উপকারই হয়। যেমন গতকাল ভাবল মানিক চাচার কথা। এলাকার সম্পর্কে চাচা। বয়স চল্লিশ হবে। পেটানো শরীর, শক্ত-পোক্ত চেহারা। দীর্ঘদিন হলো ঢাকায় থাকে। বাদামতলিতে ফলের ভ্যান টানে, গাবতলিতে সাপ্লাই দেয়। অকশনের মালও বিক্রি করে। অকশনের মাল হলো ফেলনা ফল, দেখতে ভালো না, অথবা কিছুটা নষ্ট, মান খারাপ। বাদামতলির ফলের ব্যাবসার নাড়ি-নক্ষত্র চাচার জানা। কী একটা মামলায় পড়ে ছয় মাস লুকিয়ে ছিলেন। এখন নন্দীপাড়ায় একা বাস করছেন। রিকশা চালান। গাবতলির বাসা ছেড়ে দিয়ে, চাচী, চাচাত বোনদের গ্রামের বাড়িতে রেখে এসেছেন।  এখন তার হাত শূন্য। ফলের ক্যারেটের কি একটা ব্যাবসা পেয়েছেন, পুঁজি দরকার। পুঁজির জন্যই হাসানকে কল করলেন গত পরশু।
  ‘হ্যালো, হাসান।’
  ‘আসসালামু আলাইকুম চাচা।’
  ‘ ওয়া আলাইকুমুস সালাম।  বাপজান আছো কেমন?’
  ‘এইতো আলহামদুলিল্লাহ, ভালো। শরীর দূর্বল। বেশ দূর্বল।’
  ‘আহহা। অফিসে যাইতে হয় ?’
  ‘হ্যাঁ, বাসায় দুই সপ্তাহ হয়ে গেল। আর তো মিস দেয়া যায় না।’
  ‘শইল্যের দিকে নজর দিবা, চাকরি গেলে পাওন যাইবো। শরীর বাবা অমূল্য।’
  ‘হুম। আপনার কি অবস্থা চাচা?’
  ‘এইতো রে বাবা অবস্থা। তোমার এইখানে আইমু এই মুখ নাই। ফলের ব্যাবসা করলে এলাকার নেতাগো লগে লাইন দিয়া চলতে হয়। এই লাইন দিতে গিয়া, মিটিং এ গেলাম। লাগল মারামারি, কোপাকুপি। আমি ফাইসা গেলাম। তিন নাম্বার আসামি হইলাম। এখনো পলায় আছি। বাড়ি ঘর সব ছাড়তে হইল। হা*র রাজনীতি।’
  ‘রাজনৈতিক নেতাদের সাথে চলতে গেলে একসময় না একসময় বিপদ আসবেই চাচা। এখন থেকে এগুলা এভয়েড করে চলেন। ইন শা আল্লাহ ভালো থাকবেন।’
  ‘দুআ কইরো ভাতিজা। একটা ব্যাবসা পাইছি, জায়গায় বেইচ্চা, জায়গায় লাভ। আমার মতন এই ব্যাবসা কেউ চিনে? হা হা।’
  ‘ কিসের ব্যাবসা চাচা?’
  ‘ ফলের ক্যারেটের ব্যাবসা। সব মহাজন আমগো ভাই ব্রাদার না পাগলা? হা হা… এইবার আল্লাহ দিলে তোমার চাচা একখান বেড়াছেড়া কইরা দিবো…  খালি হাতে রিকশা নিয়া ঘুরোনের লোক আমি না… বুঝলা না?’
    ‘হুম।’
  ‘ সমস্যা হইল হাতে টাকা নাই। ব্যাবসায় পুঞ্জি তো লাগে……’

হাসানের ভাবনার আবেশ কাটতে কাটতে কখন যে সময় পেরিয়ে যায়, বোঝা যায় না। এটা খারাপ দিক। আজও এটা সেটা ভাবতে অনেক সময় গেল তার। গলা শুকিয়ে গেছে ততক্ষনে । কী আর করার? পানি খেয়ে কিছু দুআ-আযকার করে দ্রুত শুতে হবে । অফিস সারে নয়টায়। পৌনে নয়টায় এলার্ম সেট করা আছে ।  


 


                                                          (২)

আতহার সাহেবের বয়স পয়তাল্লিশ। ছিপছিপে শরীর, চেহারা। গালে পাতলা দাড়ি।  থুতনির নিচে গলার দাড়ি তুলনামুলক ঘন । মাথায় টুপি পরেছেন। চোখে কিছুটা কম দেখেন তিনি। কিন্তু আজ চশমা আনতে ভুলে গেছেন । অফিসের এমডি রুমে বসে ল্যাপটপে সেলস-শিট দেখছিলেন। চশমা ছাড়া স্ক্রিনে তাকাতে কিছুটা কষ্ট হচ্ছে। নিজের ভুলোমনা স্বভাবের জন্য তিনি কিছুটা বিরক্ত। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে আজ তার মন বেশ ভালো। তার তিন বছরের ছোট মেয়েটার জ্বর ক’দিন ধরে। কিছু খেতে চায় না। খালি কাঁদে। আজ সকালে জ্বর ছেড়ে গেছে। নিজে থেকে খেতে চেয়েছে।

    ‘বাবা, বাককানি (বাকরখানি) খাব।’
    ‘বাহ, মা শা আল্লাহ। আর কিছু খাবে মা?’
    ‘ বাকখানি খাবো।’
    ‘ আচ্ছা নিয়ে আসব মা, ইন শা আল্লাহ।’

বাচ্চার মায়ের একান্ত চেষ্টায় তার তিন ছেলে-মেয়ে শুধু ঘরের খাবার খেতে অভ্যস্ত। বাইরের হাবিজাবি খাবার খাইয়ে বাচ্চার অভ্যাস আর দাঁত কোনোটাই নষ্ট করতে চান না আতহার সাহেবের স্ত্রী। মনে হচ্ছে ভদ্রমহিলা সফল হয়েছেন। বাইরের খাবার বলতে আতহার সাহেব মৌসুমি ফল আর বাকরখানি নিয়ে যান কখনো কখনো বাসায়। এতেই বাচ্চারা খুশি। অবশ্য বাকরখানি তার নিজের পছন্দের খাবার।

আতহার সাহেব স্কাইপে লিখলেন –  আসসালামু আলাইকুম, হাসান হাতের কাজ সেরে আমার রুমে এসো। হাসানের শরীরের হালচাল জিজ্ঞেস করতে চান তিনি। আর কাজের খবর নেবেন।

পনেরজন কর্মচারীর অফিসে হাসানকে আতহার সাহেব বেশ পছন্দ করেন। তবে অন্যদের তিনি তা বুঝতে দেন না। হাসানকেও বুঝতে দেন না। যদিও তার ধারণা – হাসান বুঝতে পারে। ছেলেটা চুপচাপ হলে কি হবে? মাথা খাঁটিয়ে যেকোনো সমস্যার সলিউশন বের করতে ওর জুড়ি নেই। অন্তত এই অফিসে পান নি তিনি । তার ইচ্ছা হাসানকে প্রমোশন দিয়ে নিজের কাজের কিছু বোঝা হালকা করবেন । তবে প্রমোশন পাওয়ার জন্য যোগ্য করে তুলতে হবে তাকে। অনেক কিছু শেখাতে হবে। সময় লাগবে। কয়েকজনের পদে-দায়িত্বে কিছু হেরফের করতে হবে, কিছুদিন অফিসে কাজের মধ্যে ভজঘট হবে। হোক, সমস্যা নেই। নিজের কাজের বোঝা তিনি কমাতে চান। সপ্তায় ছয় দিন অফিসিয়াল কাজের ব্যস্ততা আর ভালো লাগে না। তার মনের কোণে জমে থাকা বিভিন্ন ইচ্ছা অপূর্ন রয়ে গেছে কতদিন হলো। তিনি এবার ইচ্ছাগুলো পূরণ করতে চান ধাপে ধাপে। এ জন্য চাই অবসর। আর তার কিছু কাজ বুঝিয়ে দিবেন কাউকে । দায়িত্বের সাথে পালন করবে এরকম একজনকে।  বিশ্বস্ত, যোগ্য । এখনকার মানুষজনের বিশ্বস্ততা থাকলে যোগ্যতা থাকে না। আবার যোগ্যতা থাকলে বিশ্বস্ততা পাওয়া যায় না। এই সমস্যা সব জায়গাতেই। পারফেক্ট মানুষ খুবই কম । হাসান কি এরকম একজন? হতে পারে, সম্ভাবনা বেশি – আতহার সাহেব অনেকদিন থেকে ভাবছেন। তার মনে ক্ষুদ্র দুশ্চিন্তাও আছে। হাসান শেষ পর্যন্ত এই অফিসে থাকবে তো? বেশ স্বাধীনচেতা আর একরোখা ছেলে। কিন্তু ভদ্র হওয়ায় বোঝা যায় না সহজে। তবে তিনি বুঝেন। তাই তার এই আশংকা। আকাশ চেনা পাখিকে খাচায় তুষ্ট রাখা যায় না।  

দরজায় নক পড়ল। হাসান এসে পড়েছে ।
  ‘আসসালামু আলাইকুম স্যার।’
‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম। বোস।’
‘স্যার, আলহামদুলিল্লাহ কাজ করার মত শক্তি শরীরে ফিরেছে। গত পনেরদিনের সবার কাজের হিস্টোরি দেখেছি। গ্যাপের জায়গাগুলোর দায়িত্ব সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছি। চিটাগাং এর ক্লায়েন্টের মালামাল আটকে আছে। তিনি কিছুটা অখুশি। তার সাথে কথা হয়েছে। আশা করি আগামীকাল আমাদের ট্রাক রওনা দেবে। তবে মনে হয় প্রাইসিং এ তাকে কিছুটা ছাড় দিতে হবে। তার অখুশি ভাব টা কমবে আশা করি এতে।’ 
  ‘ক্যাটালগ তৈরি করেছ?’
  ‘ক্যাটালগ তৈরি করি নি এখনো স্যার। প্রাইস পার্সেন্টেজ লেস করে পাঠিয়ে দেব আপনার কাছে। আপনি মার্জিনগুলো দেখে দিয়েন ইন শা আল্লাহ। 
‘হ্যাঁ পাঠিয়ে দাও।’
‘জি’
‘তোমার চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। তুমি চাইলে কিছুদিন বাসায় হাফ টাইম অফিস করো।’
‘ ঠিক আছে ইন শা আল্লাহ, শুকরিয়া।’
‘ যাও।’

আতহার সাহেব চট্টগ্রামের বিনইয়ামিন সাহেবের ফাইল খুললেন। দেখতে কষ্ট হচ্ছে। ভাবলেন আজই দুই সেট এক্সট্রা চশমা বানাবেন। এক সেট অফিসে, আরেক সেট থাকবে ব্যাগে। বাসারটা বাসায়। 

(চলবে ইন শা আল্লাহ)

Comments

    Please login to post comment. Login