
(২য় পর্ব)
হাসানের শরীরের আড়ষ্ট ভাবটা কাটছে না। আধা ঘন্টা পরপরই ক্লান্তি বোধ হচ্ছে। বিশ্রাম নিয়ে আবার কাজ শুরু করতে হচ্ছে। ডেক্সটপের আলোতে চোখগুলো ক্লান্ত হয়ে যায় দ্রুত। অবশ্য সে হাফ অফিস করেই বাসা ফিরবে। তার অফিসে যাওয়া আসাও খুব সহজ। পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ। সে ডেমরার এই এলাকায় এসেছে দুই বছর হলো। জায়গাটা তার খুব পছন্দ হয়েছে। শীতলক্ষার ক্যানাল বয়ে গেছে মেইন রোডের পাশ দিয়ে । ক্যানালের পাশ দিয়ে পাকা হাটার রাস্তা। নানান গাছগাছালি। অফিস যাওয়া আসা ছাড়াও প্রায় প্রতিদিন সকালে সে ক্যানালপারের পথে হাঁটে । সকালের রোদ চোখে আর গা’য়ে লাগায়। সকাল সকাল গায়ে সূর্যের আলো লাগিয়ে মস্তিষ্ক থেকে হ্যাপি হরমোন নিঃসরণ করানোর ব্যাপারে হাসান সিরিয়াস। কারণ তার একাকী জীবনে সুখের (হ্যাপিনেসের) ঘাটতি দিন দিন বাড়ছে বলে ভাবে সে। সামনের জুনে হাসানের বয়স পঁচিশ হবে। মা-বাবা, ছোট দু-ভাইবোন থাকে গ্রামে। ঢাকা শহরে সে একা।
পরদিন ফজর নামাজের পর হাসান সাহস করে হাঁটতে বের হলো। বাসায় থেকে থেকে শরীরের অবস্থা আরো বেশি খারাপ হচ্ছে। সূর্যের আলো শরীরে লাগিয়ে সে ঘামবে খানিকক্ষণ। শরীর সুস্থ্য, স্বাভাবিক করতে এই চিকিৎসার বিকল্প নেই। চারদিকে এখনো ধুসর স্নিগ্ধ আলো। সূর্য উঠে নি। হাসান হাঁটছে মাথা নিচু করে। অভ্যাসটা তার অনেক দিনের। তারা বাবা তাকে কড়া সাবধানবানী দিয়েছে হাঁটা নিয়ে। হাসান চেষ্টা করেছে কিছুটা সোজা হয়ে হাঁটার, কিন্তু অভ্যাসটা যাচ্ছে না। নিচু হয়ে হাঁটার সুবিধা হচ্ছে– রাস্তার ওপাশ থেকে যে মেয়েরা বা মহিলারা আসতে থাকে, তারা চোখে পড়বে না। কিন্তু এই যুক্তি কিভাবে বোঝায় বাবাকে? হাসান হাঁটতে হাঁটএ ক্যানালপাড় ছেড়ে মেইন রাস্তায় চলে এসেছে। রাস্তা ফাঁকা। রাস্তার উত্তর পাশে গভীর খাল। খালটা জংলি গাছে ভরা। কিছুদূরেই দেখা যাচ্ছে কয়েক টন ওজনের কতগুলো লোহাকাঠে গুঁড়ি । সারি সারি ফেলে রাখা। এখানে একটা টিম্বার কম্পানী আছে। তাদেরই কাজ। হাসান নিমগ্ন। পাশ থেকে কে যেন ডাকল । সে গা করল না। মনের ভুল হবে । কে ডাকবে তাকে এত সকালে? সুর্যের আলো ফুটতে শুরু করছে কেবল। আবার স্পষ্ট ডাক শোনা গেল– হাসান ভাই। হাসান এবার পাশ ফিরে দেখল– পুলিশের গাড়ি। রাস্তায় আর কোনো মানুষ নেই। গাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে দুজন পুলিশ অন্যদিকে তাকিয়ে সিগারেট ফুঁকছে। আর অন্যরা গাড়ির ভেতরে। গাড়ির ভেতর থেকেই কেউ ডেকেছে তাহলে। কিন্তু পুলিশ তাকে ডাকবে কেন? সে গাড়ির দিকে তাকিয়ে ভাবছে কি করবে। তার হৃদয় কিছুটা সংকুচিত বোধ করছে। সে কি ভয় পাচ্ছে? কিন্তু তার তো ভয় পাওয়া উচিত নয় । সে নিজেকে সাহসীই ভাবে। তাহলে?
এইতো মাত্র তিন মাস হল আজাদকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল । আজাদের সাথে হাসানের সম্পর্ক বন্ধুর মত । সে এলাকারই ছেলে। একদিন ইশার নামাজের আগে দুজন লোক দাঁড়িয়ে আজাদের দোকান ফলো করছিল। এই দুজনের পরিচয় জানা যায় ইশার নামাজের পর । তারা সিভিল পোশাকে ডিবির অফিসার। নামাজ শেষে আজাদ যখন বেরিয়ে এল, অতি সুন্দর ভাবে তার কাছে জানতে চাওয়া হলো–
‘ভাইজান, আপনার নাম আজাদ?’
‘জি, আমি আজাদ।’
‘আপনার বাবার নাম সদরুদ্দীন মোল্লা?’
‘জি, আপনারা কারা?’
‘পুলিশের লোক। ডিবি ব্রাঞ্চ। আপনার নামে ওয়ারেন্ট আছে, থানায় আসেন কথা হবে।’
হাসান ছিল আজাদের পাশেই। আজাদের হতভম্ভ দৃষ্টি দেখছিল সে । হাসান নিজেও হতভম্ভ। কিন্তু অফিসার দুজনকে বেশ আনন্দিত মনে হলো। আনন্দ ভাগাভাগি করতে তারা একে অপরের দিকে তাকাল কয়েকবার।
‘আপনারা যে পুলিশ তার প্রমান?’ বলল হাসান।
অফিসার দুজন তাদের কার্ড দেখালো। আজাদ, হাসান দুজনই কার্ড দেখার চেষ্টা করছে। তাদের পুরোপুরি বিশ্বাস হলো– যখন তারা দেখল সামনেই ৫/৬ জন উর্দি পরিহিত পুলিশ গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে। পুলিশবাহিনী আসামী নেয়ার জন্য মোটামুটি প্রস্তুত ।
‘কী অভিযোগ আমার নামে?’ আজাদ বলল।
‘থানা আসেন জানবেন। আপনার ফ্যামিলির কাউকে সাথে নেন। গাড়িতেই যাবে– সমস্যা নাই।’
‘আশ্চর্য। কী মামলা আমার নামে বলবেন না?’
‘ভাই, বিস্তারিত জানবেন সব। আপনার কাউরে ফোন দেন।’
এরপরের ঘটনা সংক্ষিপ্ত। আজাদ হাজত খাটল দুই মাস সাত দিন। জামিনের দিন সব বন্ধু বান্ধব খুশির সাথে দেখা করল । হাসান নিজ উদ্যোগে মিষ্টি নিয়ে গেল তাদের বাসায়। মিষ্টির মিষ্টতায় কেটে যাক জেল-হাজতি জীবনের তিক্ততা! মামলার পেছনের রহস্য উন্মোচন করল আজাদ । রহস্য খুব জটিল না। তবে মামলা জটিল। ছেলে হিসেবে অতি ভদ্র আজাদ এক চলন্ত বাসে পেট্রোল বোমা ছুঁড়ে মেরেছে । তার একজন বডিবিল্ডার বন্ধু জিজ্ঞেস করল – দোস্ত কবে গেলি বোমা ছুঁড়তে? আমারে নিলি না সাথে?
আরে আর হাসাইস না ভাই– বলে আজাদ নিজে হাসল। সাথে হাসল সবাই।
মামলা রহস্যের গোঁড়া হলেন আলমস গ্রুপের চেয়ারম্যান আলম খান। ভদ্রলোকের আচরণ অতি মধুময়, বেশি বেশি পান চিবানোয়, কথা বলেন থেমে থেমে। পানের রস, কথার রস একাকার হয়ে যায়। তার হাসিমুখ দেখে বিগলিত হতে হয়। কিন্তু হাসির সময় তার চোখ গুলোতে হঠাৎ হঠাৎ খেলা করে ক্রূরতা। এটার সবার নজরে পড়ে না। আজাদের বাবা সদরুদ্দিন মোল্লার নজরেও পড়ে নি। আলম খান আলমস হোটেলের জন্য ধাপে ধাপে দশ লাখ টাকার চাউল বাকিতে নিয়েছিল মোল্লা চাচার চাউলের দোকান থেকে। সেই টাকা দেয়ার নাম নেই ৩ বছর। চাচা বহুত বলে কয়ে যখন কিছুই পেলেন না, তখন মামলা করলেন । আলম খান কয়েক লাখ টাকা খাইয়ে দুই দিন পরেই জামিন নিয়ে ফিরল এবং বাইকে করে চাচার দোকানের সামনে দিয়ে ঘুরে গেল। চাচাকে জিজ্ঞেস করল– বড় ভাই কেমন আছেন? দিনকাল ভালোই যায়? মুখে তার তেলতেলে হাসি। এই ঘটনার এক সপ্তাহের মধ্যেই আজাদ গ্রেফতার হলো।
আজাদের এই ঘটনাই হাসানের ভয় পাওয়ার কারণ। সেদিন সে-ও রাতে থানায় গিয়েছিল আজাদের ব্যাপারে জানতে। পুলিশ উলটা পালটা জেরা করতে শুরু করল তাকেও। সে দ্রুত কেটে পড়েছিল আজাদের ইশারায় ।
পুলিশের গাড়ি থেকে আবার ডাক এল– হাসান ভাই না? হাসান এগিয়ে গেল।
‘হাসান ভাই ?’
‘জি।’
‘আমি আজমল।’
‘আরে, আজমল। ডেমরা থানায় পোস্টিং নাকি?’
‘জি ভাই। দুই মাস হলো।’
আজমল গাড়ি থেকে নেমে এলো। আজমলের চোখ মুখে নির্ঘুম-ক্লান্তি ভাব। কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছে সে। মেসে পৌঁছেই ঘুমাবে । আজমল হাসানের হাই-স্কুলের জুনিয়র। তবে বয়সে সমান সমান হবে অথবা হাসানের বড়ও হতে পারে। কয়েকবছর আগে পুলিশ কনস্টেবলের চাকরী হয়েছে আজমলের। আজমল যে ঢাকায় আছে, এটা মানিক চাচা জোশের সাথে জানায় বছর খানেক আগে । আজমল মানিক চাচার আপন ভাগনে।
‘তোমার বাবা-মা আছে কেমন, আজমল?’
‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো। ভাই গাড়ি ছেড়ে দিবে, আপনার নাম্বার টা বলেন কল দিই।’
নাম্বার দেয়ার ইচ্ছা নেই হাসানের। পুলিশের সাথে যোগাযোগ রাখার কোনো প্রয়োজন নেই। কিন্তু আজমল ফোন হাতে অপেক্ষায়। নাম্বার বলতেই হল।
‘আমার নাম্বার টা সেভ রাখেন বড় ভাই। কোনো সমস্যা বা দরকার হলে কল দিবেন।’
‘ দেখা যাবে… ।’
হাসান প্রসঙ্গ পাল্টাতে চায়। জিজ্ঞেস করল – মানিক চাচার খবর জানো?
‘হ্যা, মামার তো যা কাহিনী!’
গাড়ির বাইরের পুলিশ দুজন গাড়িতে উঠল। গাড়ি স্টার্ট হয়ে গেল। আর কথা বলার সুযোগ নেই। আজমল সালাম দিয়ে গাড়িতে উঠেল গেল। হাসান স্বস্তি পেল কিছুটা । কয়েকজন পুলিশ পিট পিট করে দেখছিল হাসানের দিকে। সন্দেহ আর চালবাজি পূর্ণ দৃষ্টি তাদের চোখে। পুলিশ কি কখনোই স্বাভাবিক ভাবে তাকাতে পারে না? নাকি তাকায়? মানুষের অন্তর থাকে পুলিশদের প্রতি কু-ধারণায় পূর্ণ। এই কুধারণার কারণেই কি পুলিশের চোখ সবসময় অস্বাভাবিক লাগে? হতেই পারে। Each one sees what he carries in his heart.
(চলবে ইন শা আল্লাহ)