ভবিষ্যতের বাংলাদেশ। চারদিকে ধুলো, শুকনো জমি আর ফেটে যাওয়া নদীর তলদেশ। আকাশে মেঘ আছে, কিন্তু সেগুলো কেবল বিদ্রূপের মতো ভেসে বেড়ায়—বৃষ্টি নামানোর শক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছে। মানুষ পানির জন্য হাহাকার করছে।
একটি ছোট গ্রামে থাকে রহিম নামের এক কৃষক। একসময় সে ধানের জমিতে হাঁটু পর্যন্ত পানিতে দাঁড়িয়ে ফসল তুলত। আজ তার জমি ভাঙা মাটির ফাটলে ভরা। ঘরে থাকা হাঁড়িতে এক গ্লাসের মতোই পানি আছে—এটাই তার পরিবারের শেষ ভরসা।
রহিমের ছোট ছেলে রাফি কয়েক দিন ধরে জ্বরে কষ্ট পাচ্ছে। গলা শুকিয়ে যায়, ঠোঁট ফেটে গেছে। রহিম সেই শেষ ফোঁটা পানিটা বারবার হাতে নিয়ে ভাবে—এই পানি ছেলেকে খাওয়ালে হয়তো সে বাঁচবে, নইলে নয়।
কিন্তু হঠাৎ পাশের বাড়ি থেকে কান্নার শব্দ আসে। সেখানে থাকে হালিমার পরিবার। হালিমার ছোট মেয়ে আয়েশা শোকে কাতর হয়ে পড়েছে। তার গলা শুকিয়ে কাঠ, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। রহিম জানে, ওদের ঘরে এক ফোঁটা পানিও নেই।
তার বুকের ভেতর দ্বন্দ্ব শুরু হয়। নিজের ছেলেকে বাঁচাবে, নাকি প্রতিবেশীর সন্তানকে? পৃথিবীতে যদি মাত্র এক গ্লাস পানি থাকে, সেটি কার জন্য ব্যয় হবে?
রাত গভীর হয়। চারদিকে অন্ধকার। রহিম হাঁড়ি হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসে। রাফি তখন দুর্বল গলায় বলে ওঠে,
—“আব্বা… পানি খাও…”
কিন্তু রহিম সন্তানের দিকে তাকাতে পারে না। সে জানে, রাফির চোখে বেঁচে থাকার আকুতি আছে, কিন্তু তার অন্তরের ভেতর থেকে অন্য এক কণ্ঠ তাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে হালিমার ঘরের দিকে।
সে দরজার ফাঁক দিয়ে হাঁড়িটা বাড়িয়ে দেয়। হালিমা ভয়ে বলে ওঠে,
—“ভাই, এটা তো তোমাদের শেষ পানি!”
রহিম শুধু একটা কথা বলে,
—“আল্লাহ আমাকে বিচার করবেন। এখন এই পানি আয়েশার জন্য।”
হাঁড়ির ঠাণ্ডা পানি আয়েশার শুকনো ঠোঁটে ছোঁয়ানো মাত্রই মেয়েটা হালকা নিশ্বাস নেয়। চোখের কোণে হাসির ঝিলিক দেখা যায়।
রহিম তখন নিরব দাঁড়িয়ে থাকে। তার বুকের ভেতর ঢেউ ওঠে। নিজের ছেলেকে ফেলে আসার কষ্ট, কিন্তু একই সাথে একটা অদ্ভুত শান্তি। যেন সে মানবতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে।
সকালে গ্রামে সবাই খবর পায়—আয়েশা বেঁচে গেছে। কিন্তু রাফি আর নেই। রহিম নিজের সন্তানকে হারালেও মানুষ তাকে বীরের মতো মনে রাখে। তারা বলে,
—“যে নিজের সন্তানকে হারিয়ে অন্যের সন্তানকে বাঁচায়, সে-ই সত্যিকারের মানুষ।”
গ্রামের মাটিতে যখন আবার একদিন বৃষ্টি নামবে, মানুষ নিশ্চয়ই রহিমের কথা মনে করবে। তার সেই শেষ ফোঁটা পানি শুধু একটি মেয়েকে নয়, পুরো গ্রামের বিবেককে বাঁচিয়ে দিয়েছিল।