Posts

কবিতা

দুষ্টুমিষ্টি ছেলেবেলা | এম এম মাহবুব হাসান

September 12, 2025

এম এম মাহবুব হাসান

358
View


দুষ্টুমিষ্টি ছেলেবেলা

  • এম এম মাহবুব হাসান


 

সেই ছেলেবেলা—

যখন সময়ের ঘড়ি যেন থেমে থাকত,

সূর্যের আলোয় ধুলো উড়ত

মাঠের বুকে।

আমরা দৌড়াতাম, খেলা করতাম,

হাসির ঝিলিক ছড়িয়ে দিতাম

গ্রামের প্রতিটি অলিগলিতে।


 

ডাঙুলি খেলার লাঠির ঠকঠক শব্দে

কেঁপে উঠত অলস বিকেল।

কড়ি খেলার ঠকঠক টুংটাং শব্দে

ভাঙত অল্পস্বল্প জমে থাকা ধনভান্ডার।

কে জিতল, কে হারল—

তা বড় কথা ছিল না,

আনন্দ ছিল ঠোঁটে ঠোঁট লাগানো হাসিতে।


মোরগ লড়াইয়ের ভান করে

হাঁটু মুড়ে দাঁড়িয়ে লাফাতাম

একে অপরের দিকে।

হাঁকডাক, হইচই,

হঠাৎ লুটিয়ে পড়া হাসি—

শেষমেশ দাঁড়িয়ে থাকা জনই

হয়ে উঠত আমাদের ছোট্ট রাজ্যের রাজা।


 

‘বুদ্ধিমন্তর খেলা’র কৌশলে

বাঁধতাম বুদ্ধির গিঁট

ছোট্ট হাতের টোকার ভেতরে।

গোল্লাছুটের হুড়োহুড়ি

আমাদের ছুটিয়ে নিয়ে যেত

অপর পাড়ের আলোতে।

ছোয়াছুয়ির ধাওয়া–পাল্টাধাওয়ায়

হারিয়ে যেত দুপুরের গরম,

আমাদের শ্বাসপ্রশ্বাস মিলত

শীতল বাতাসের ফিসফিসে ছন্দে।


 

হাডুডুর হাঁক—

“ধরধর, ধরধর…”

অন্ধকার নামার আগেই মাঠ ভরে উঠত

শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনায়।

কাদামাটির গন্ধে ভিজে যাওয়া শরীর

মায়ের চোখ রাঙানিও সয়ে নিত।

আমরা জানতাম—

এই আনন্দকে কোনো বকুনি ছুঁতে পারে না।


 

বর্ষার ভেজা দুপুরে

বিলে নামতাম মাছ ধরতে।

ভিজে যেত জামাকাপড়,

শরীর কাঁপত, মন নয়।

মাছের পিঠে ঝিকমিক আলো

আমাদের চোখে ছিল বিজয়ের উল্লাস।


 

কলই পোড়া খেতে খেতে

চোখ দুটো ঝলমল করত।

তালশাশের খোলা দিয়ে বানানো গাড়ি

গর্জন তুলে ছুটত মাঠের এপারে–ওপারে।

সাইকেলের পুরনো টায়ার

লাঠি দিয়ে ঠেলতে ঠেলতে

আমরা হয়ে উঠতাম পথের অভিযাত্রী।


 

কলাগাছের ভেলা ভেসে যেত

খালের স্রোতে দূরে,

আমরা ভেসে থাকতাম

ভেলার সঙ্গে স্বপ্নের সমুদ্রে।

ভাদ্র মাসে হাঁসের মতো ভেসে থাকা,

সাঁতরে সাঁতরে সূর্যের শেষ আলো ধরা—

আমাদের খেলার দুঃসাহসিক ভাষা।


 

পৌষের কুয়াশা ভেজা ভোরে

খালি পায়ে দৌড়াতে দৌড়াতে

কোচিং সেন্টারের পথে যাওয়া,

মাঠের ঘাসে লেগে থাকত শিশির,

আমাদের ঠান্ডা পায়ে জমে উঠত গল্প।


 

ঝড়ের রাতে

আম কুড়ানোর দুঃসাহস

আমাদের বানাত সাহসী সৈনিক।

বিদ্যুতের ঝলকানিতে কেঁপে উঠত গাছ,

আমরা দৌড়ে বেড়াতাম অন্ধকারে।

গাছ থেকে কেটে আনা কাঁচা খেজুর

ঝোলায় রেখে পাকানোর সেই কৌশল—

ছিল গোপন এক রাজকীয় আনন্দ।


 

গুলতি হাতে ছুটে বেড়ানো,

মাড়ই পাতায় বক ধরার ফাঁদ পাতা,

শিকারের চেয়ে রোমাঞ্চ ছিল বেশি

বন্ধুদের হইচই আর হাসির কোলাহলে।


 

খেলার ছলে লেগে যেত মারামারি,

কিছুক্ষণ পরেই ভেঙে যেত অভিমান।

রাতের অন্ধকারে কাউকে ভয় দেখানো,

কারো ঘরে উঁকি দেওয়া—

সবই ছিল আমাদের ছোট ছোট অপরাধ,

যা তুলত হাসির ঝড়।


 

আর ছিল সেই অদ্ভুত কাহিনি—

বাবার অবাধ্য হয়ে

লুকিয়ে ভিসিভি দেখার দুঃসাহস।

ম্লান আলোয় সাদা পর্দায়

ভেসে উঠত ছবির নায়ক–নায়িকা।

আমরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে থাকতাম,

যেন ধরা পড়ে গেলেই

শেষ হয়ে যাবে পৃথিবী।

তবু সেই নিষিদ্ধ আনন্দ

ছিল কৈশোরের গোপন বিদ্রোহ।


 

এলাকার হাজামকে দেখলেই

বাড়ি ছেড়ে ছুটে পালানো—

সেই দৌড় যেন ছিল

মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার ছুটে চলা।

কাঁচি হাতে হাজামের হাসি

আমাদের চোখে ছিল ভয়ঙ্কর রাক্ষস।

মায়ের ডাকও থামাতে পারত না

আমাদের বজ্রপাতের মতো দৌড়ানো পা।


 

তবু, এই সব ভয়, দুষ্টুমি আর খেলায়

আমরা গড়েছিলাম আমাদের পৃথিবী—

যেখানে হাসি ছিল ঝরনার জল,

খেলাধুলা ছিল বাতাসের সুর,

আর প্রতিটি মুহূর্তে

ছিল স্বাধীনতার নেশা।


 

আজ, দাঁড়িয়ে প্রাপ্তবয়স্কতার কঠিন বাস্তবে,

এখনও শুনতে পাই—

গোল্লাছুটের হাঁক,

হাডুডুর দমবন্ধ করা ছন্দ,

মাঠের ধুলোয় ভেসে যাওয়া হাসির প্রতিধ্বনি।


 

দুষ্টুমিষ্টি ছেলেবেলা—

তুমি কি তবে শুধুই স্মৃতির খাতায় বন্দি থাকবে?

নাকি ভেতরের সেই চঞ্চল শিশু

আজও গোপনে ছুটে বেড়াবে

কাদামাটির গন্ধে ভিজে,

সাইকেলের টায়ার ঠেলতে ঠেলতে,

কলাগাছের ভেলায় ভেসে ভেসে—

যেখানে প্রতিটি দিন

ছিল একেকটি কবিতা,

একেকটি জয়ধ্বনি,

একেকটি জীবনের অমলিন উৎসব।

Comments

    Please login to post comment. Login