একটি তাৎক্ষণিক গোয়েন্দাগিরি এবং...
পলাশ আহসান
রাত ৯টার মত বাজে। আমার হাঁটার সময়। আজো হাঁটছি স্বাস্থ্য উদ্ধার পরিক্রমায়। কিন্ত আজ হাঁটার গোলকটা নেহায়েত অপারিচিত। না বের হলেই হতো। ছয় সাত ঘণ্টার ঝাঁকুনি ক্লান্ত শরীর খানিকটা বিশ্রাম পেতো। কিন্তু আমি তো চিনি চিনি। তাই চিনির ভয়েই ভাবলাম বিশ্রামের চেয়ে হণ্টনই উত্তম। যাহোক হাঁটছি। চারদিকে জালের মত কংক্রিটের সরু রাস্তা। এরই একটায় আছি। ঘিঞ্জি না হওয়া দূরত্বে একেকটা ভবন। রাস্তাগুলো মালা গেঁথেছে একেকটা ভবন দিয়ে।
এই ক্যাম্পাসে ঢোকার সময় সাইনবোর্ড দেখেছিলাম। এই এলাকা সরকার নিয়ন্ত্রিত। ঢাকা থেকে শ'চারেক কিলোমিটারে দূরে। ঘণ্টাদুয়েক আগে এখানে নেমেছি। এখানে আমার এখানে থাকার ব্যবস্থা। একটা রেস্ট হাউস। চার দিকে আরও ভবন আছে। সেগুলো যে আবাসিক তা বাইরে থেকে দেখেও বোঝা যাচ্ছে। সেই সব ভবনের সামনের রাস্তা ধরেই হাঁটছি ১০ মিনিট হলো। রাস্তার পাশে কখনো মনে হচ্ছে ঘাস আবার কখনো মনে হচ্ছে সবজি ক্ষেত। সেখানে আলো আছে। কিন্তু লাইটপোস্টগুলো এত উঁচু যে আলো নিচে নামতে নামতে আলো-আধাঁরি হয়ে যাচ্ছে।
ঠিক কোথা থেকে হাঁটা শুরু করেছিলাম এখন মনে পড়ছে না। তবে ভবনের নম্বর মনে আছে। ভাবছি হাঁটার কোটা শেষ হলে কাউকে জিজ্ঞেস করে নিলেই হবে। তাছাড়া আছি তো একটা নির্ধারিত ঘেরাটোপে। মানে পাচিলের মধ্যে। বাইরে বের হতে গেলে দেয়াল বাবু পথ আটকে দেবে। যেহেতু হারাচ্ছি না তাই এত ভাবছিও না। চলছে আনন্দ হন্টন।
একটু দূরে একটা ঘর দেখা যাচ্ছে। টিনের চাল। বারান্দাও আছে মনে হচ্ছে। নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম, বসবো নাকী? ভেতর থেকে কে যেন চোখ রাঙালো, ১০ মিনিটে কীসের বসা? একবারে ৪০ মিনিট পর। তবু থামতে হলো। ঠিক থামা নয়। হাঁটার গতি কমিয়ে পায়চারিতে এলাম। একটা নড়াচড়া টের পেলাম। এক কোনায় বসে কে যেন। নীল আলোর আভায় শুধু বোঝা যাচ্ছে একটা অল্প বয়সী মুখ। নীল আলো কোত্থেকে আসছে পরিস্কার নয়। কিন্তু আলোটা আসছে। আমি কিন্তু পায়চারিতেই আছি । সামনে এগোচ্ছি আর মুখটার আকার পরিস্কার হচ্ছে। একটা ঘামে ভেজা ছেলের মুখ। বয়স কত হবে এই আন্দাজ ১৩/১৪
আরও কাছে আসতেই বোঝা গেলো, আলোর খেলায় যেটা টিনের ঘর মনে হচ্ছিল ওটা আসলে টিনের ঘর নয়। এমন কী ঘরই নয়। বেশ লম্বা মাটির ঢিবি। এর ঢালে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে ছেলেটি। হাত সামনের বাড়ানো। নীল আলোর আভা, আসছে বাড়ানো হাতের শেষ সীমা থকে। আলোর উৎস ওর হাতেই। হঠাৎ আমার পায়চারি বন্ধ। কারণ ছেলেটির খুব উত্তেজিত হয়ে পরিস্কার ভঙ্গিতে বলছে, " গুলী কর, গুলী কর"। বলে কী! আমি হতভম্ব।
এমনিই অপরিচিত যায়গা। আলো আধারির মধ্যে গা ছমছমে ব্যাপারটা আগে থেকেই ছিল। এর মধ্যে গুলী। কি করবো দিশা পাচ্ছিলাম না। অভ্যেসবসত বসে পড়লাম। তার পর শুয়ে পড়লাম। পড়লাম না বলে পড়ে গেলাম বলাই ভাল। ভাগ্যিস ক্যাম্পাসের অভ্যেসটা অবচেতন মনে ছিল। আমাদের সময় সব বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মাঝে মাঝেই গোলাগুলী হতো। যে কেউ যখন তখন গুলীর মধ্যে পড়ে যেতে পারতো। আমাদের অভ্যেস ছিল গুলী শুরু হলে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়তাম।
যাই হোক অভ্যেস বসে আমি ততক্ষণে ভূপাতিত। প্রথমে রাস্তায় পড়লেও দুই গড়ান দিয়ে চলে গেলাম রাস্তার পাশে। ভেজা ঘাসের ছোঁয়ায় বুকের ধুপ ধুপ কিছুটা কমলো। মাথা কাজ করছে বোঝা যাচ্ছে। আমার অবস্থান এখন মাটির ঢিবির ঠিক পেছনে। ঢালে উপুড় হয়ে গুলি করছে ছেলেটি। আর কিছুক্ষণ পর পর বলছে গুলী গুলী। তোমার সামনে শত্রু। গুলী গুলী। ছেলেটি মাঝে মাঝে উঠে বসছে। কিন্ত মন তার দুই হাতের নীল আলোয়।
আমার ৮৫ কেজের শরীর মাটিতে পড়লে ধপাস শব্দ হওয়ার কথা। তবু বুঝলো না নীল আলোর মুখ। সে গুলী গুলী শব্দের মধ্যেই আছে। কাকে গুলী করছে এইটুকু বাচ্চা ছেলে? আজকাল কিশোর অপরাধের যে বহর, ছেলেটি গ্যাং কালচারের কেউ নয়তো? আরেকটু কাছে যাওয়া দরকার। দূর থেকে অনেক কিছু পরিস্কার হচ্ছে না। কিন্তু ওর যে উত্তেজিত মুখভঙ্গি তাতে সাহস হচ্ছে না। ছেলেটির কোন দিকে মনোযোগ নেই। যত মনোসংযোগ করে কাজটি করছে তাতে মনে হচ্ছে কানের কাছে বোমা ফটালেও টের পাবে না।
আরে এটা একটা সুযোগ। ভাবলাম আস্তে আস্তে এগোই। না না উঠবো না। কনুই এ ভর করে ক্রল করেই এগোই। কনুই চামড়া ছড়ে জ্বলুনি হচ্ছে। রক্ত বেরিয়ে গেলো কী না কে জানে। কিন্তু ক্রল করার মধ্যে একটা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব তৈরি হচ্ছিল। ছোট বেলায় যখন কাঠের রাইফেল নিয়ে বিজয় দিবসের ডিসপ্লে করতাম তখন এরকম অনুভুতি হতো। যাই হোক ছেলেটার আট দশ ফুটের মধ্যে চলে এসেছি। কীন্তু এ কী!
যেসব বন্ধুরা আমাকে বোকা বলে তারাতো ঠিকই বলে৷ ওই ছেলে গুলী করছে একপক্ষকে। অন্যপক্ষের গুলী কই? আরে এটা এত দেরিতে কেন ভাবলাম? কোন শব্দতো পেলাম না। আমিতো গুলীর শব্দ চিনি। আমি এতক্ষণ যে গুলী গুলী শব্দ শুনছি সেটা তো ওই ছেলের মুখেই। তাহলে কি কোন গুলী হয়নি? ছি ছি ছি বন্ধুরা এই গল্প জানলে আমার খবর আছে। আমি তখনো পড়ে আছি শিশির ভেজা ঘাসে। উঠে পড়বো ভাবছি। তখনই আবার ভাবলাম তাহলে ওই ছেলে করছে টা কি। শুধু শুধু উত্তেজিত হয়ে গুলী.. গুলী.. করবে কেন? আরেকটু দেখা দরকার। যাক এখন একটু ভালো লাগলো। মনে হচ্ছে আমি অত বোকা নই।
হঠাৎ শুনলাম "এই রাখো রাখো আর হবে না। আমাদের জেতার আর সম্ভাবনা নেই। তোমার মত পার্টনার নিলে যুদ্ধে জেতা সম্ভব নয়" কী বললে আবার হামলা? না আজ আর না। আমি ক্লান্ত। এখন খাবো ঘুমাবো। কি বললে? আরেকবার? তোমার তো যুদ্ধ করার নেশা হয়ে গেছে। ঠিক আছে ৫ মিনিট রেস্ট নেই। বলে ছেলেটি উপুড় হয়েই শুয়ে পড়লো। আমি আরেকটু সাহসী হলাম। ছেলেটির আরও কাছে গেলাম। আবারও হাতের জ্বালা সহ্য করে, কনুইএ ভর করে মাটির ঢিবির আরও কাছে গেলাম।
ছেলেটি ততক্ষণে উঠে বসেছে। ওকিন্তু একাই কিন্তু কথা বলছে আরেক জনের সঙ্গে। সে কই? একবার কানে হাত দিলো। সেখানে একটা হেড ফোন সেট করা। কথা শুরু করলো, এবার কিন্ত আস্তে এগোতো হবে। তাড়াহুড়ো করা যাবে না। মাথা ঠাণ্ডা রাখবা। তুমি একটু বেখেয়াল আছ। যুদ্ধের সময় কোন দিয়ে শত্রু ঢোকে টের পাওনা। ভাই কড়া নজর রাখতে হবে তো। শুরু করো। আমার মনে ওরা দুজন দুযায়গায় থেকে যুদ্ধ করছে। এই ছেলেটা লিডার।
ছেলটি আবার উত্তেজিত হয়ে পড়লো। অপর পক্ষকে বলছে, তুমি ওদিকটা দেখো আমি এদিকটা দেখছি। গুলী গুলী। গ্রেনেড নাও, গ্রেনেড মারো। ৬ বদমায়েশ শেষ। ধন্যবাদ বন্ধু। গুলী গুলী। তোমার ডান দিকে শত্রু।
মারো। কংগ্রাচুলেশনস। দেখলে আগে আমার কথা শুনলে আগের বারেরটা হারতে না। আমি গ্রুপ লিড করলে আমাদের সঙ্গে কেউ পারবে না। শুধু আমার কথা শুনবে। আফজাল, রবিন, মনু ওদের আমার গ্রুপে জয়েন্ট করাও। বলো আমার বিরুদ্ধে লড়ে কেউ টিকে থাকতে পারবে না।
ছেলেটি আবারও বলছে, আমি প্রচুর অস্ত্র রাখি। দরকার হলে নেবে আবার ফেরত দেবে। আমি সোর্স চিনি। অস্ত্র শেষ হওয়ার আগেই অস্ত্র এনে রাখি। তোমার কাছে গ্রেনেড আছে? আমার নিজের কাছেই প্রচুর জমা আছে। আমাকে চিনলে না বন্ধু। আমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। কী হচ্ছে এখানে। ঝেড়ে দৌড় দেব সে উপায় আপাতত নেই। ছেলেটা টের পেয়ে যাবে। এতক্ষণ যে হারে গুলী আর গ্রেনেড মারলো ওর একটাই তো আমার মুখ সারা জীবন বন্ধের জন্যে যথেষ্ট। ছেলেটা বলছে, আজ মনে হয় বাসায় যেতে পারবো না। অনেক রাত হয়ে গেলো। এখানে ঘুমিয়ে পড়বো। এখন ফোন রাখছি।
আমি মাটির সঙ্গে মিশে জমে আছি। শুধু মাথাটা উচুঁ করে রেখেছি। ছেলেটিও আপাতত চুপ। কিন্ত সামনে তাকিয়ে নিচের দিকে আঁকি বুঁকি কাটছে। আমিও খুব দ্রুত ভাবছি, কী এই গুলী আর গ্রেনেডের উৎস? সীমান্ত এখান থেকে খুব কাছে এই ছেলে কী চোরাচালান চক্রের সদস্য? একথা বলতেই মাথায় এলো ছেলেটি টেলিফোনে কাউকে ডিটেকশন দিচ্ছেন। হ্যাঁ হ্যাঁ ফোনই তো। গোয়েন্দা বাহিনীর কেউ নয় তো? কোন দেশি গোয়েন্দা? বিদেশি গোয়েন্দা না কী? বাংলাদেশের সীমানায় মধ্যে বিদেশি গোয়েন্দার গুলী আর গ্রেনেড চালানোর পরিকল্পনা?
এখান থেকে ১৫ কিলমিটার দূরে সীমান্ত। রাস্তাঘাট ভাল। ১৫ কিলমিটার যেতে ৩০ মিনিট যথেষ্ট। সেই এলাকার কোন এক সরকারি ক্যম্পাসে বসে বিদেশি গোয়েন্দার যুদ্ধ? আর সেই ক্যাম্পাসে আমি? দরকার নেই আমার মাস্টারি করার। চুলোয় যাক সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ। যে সাংবাদিকরা এরকম ষড়যন্ত্রের খবর রাখে না তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কিছু হবে না। আমি আসলে এখানে এসেছি সরকারি একটা প্রতিষ্ঠানের হয়ে সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ দিতে।
যাহেক এখন এই বিচ্ছুর চোখ এড়িয়ে পালাতে হবে। ছেলেটা শুয়ে পড়েছে মনে হচ্ছে। আকাশের দিকে মুখ করে আছে। এত দ্রুত ঘুমানোর কথা নয়। আমি গড়াতে শুরু করলাম। লক্ষ্য আপাতত রাস্তা। রাস্তা পেয়ে গেছি। ছেলেটার দিকে ফিরলাম। তখনো মুখ আকাশের দিকে। হাতে সেই নীল আলো নেই। আমি উঠে দাঁড়ালাম। যেন কিছুই হয়নি এমন ভাব ধরে হাঁটা শুরু করলাম। পায়চারি থেকে শুরু এখন প্রায় দৌড়াচ্ছি।
রাস্তার জালে আটকে যাবো ভেবেছিলাম। না তা হলো না। সোজা চলে সরকারি ক্যাম্পাসের মূল গেইটে। রাত ১০টার মত বাজে। আগেই বুঝেছি ড্রেস চেঞ্জ বা কাউকে বলার আনুষ্ঠানিকতায় যাওয়া যাবে না। সরাসরি থানায় যেতে হবে। রিকশা এখনো আছে দু একটা। বললাম থানা চেনেন? একগাল হাসলেন রিকশা ওয়ালা । মনে হলো এর চেয়ে বড় জোকস জীবনে শোনেননি। আমি উঠে বসতেই হাসি থামলো কিন্তু মিলিয়ে গেল না। আঙুল দিয়ে একটা পুকুর দেখালো। আমি অবশ্য পুকুরের দিকে তাকিয়ে থানার সাইনবোর্ড দেখলাম। বুঝলাম ওর হাসির কারণ। এত কম দূরত্বে রিকশা চড়াটাই সম্ভবত ওর কাছে জোকস।
এবার আমি ব্যক্তিত্ব হারানোর ভয় পেলাম। তাই বললাম চলুন আবার এখানে আসতে হবে। কাজ আছে, ঠকাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আপনি রিজার্ভ। রিকশা ওয়ালা চলা শুরু করলো। হন্তদন্ত হয়ে এক মধ্যে বয়সী নারী আসলেন, রিকশা ওয়ালকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন " আঙ্গা নবুর দেকিচাও নাই? রিকশাওয়ালা বললেন, দেকিলাম সন্ধ্যির দিক, পাচিলির মধ্যি গে দেকো। তাদের কথা পুরোপুরি বুঝলাম না। কিন্তু মুখের ভাবানুবাদ আর কয়েকটা বোঝা শব্দ মিলিয়ে বুঝলাম, ভদ্র মহিলা কাউকে খুঁজছেন। রিকশাওয়ালা সমাধান দেয়ার চেষ্টা করলেন।
রিকশার ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম ওই ভদ্রমহিলার কী হয়েছে? প্যাডেল চাপতে চাপতে বললেন আর কন ক্যেনো, এই এক জিনিস হইয়েস নুবাইল। এর মধ্যে ঢুকিগে ছেলেপিলের মাথাডা নষ্ট। ওই বু'র ছেলিডা সেভেনে না এইটি যেন পড়ে। কিন্তু সারাদিন নুবাইল নে পড়ি থাকে। ইডা সামনে নে কিকি যেন কয়। বেশিরভাগ ছেলেপিলের এই অবস্থা। এবারও রিকশাওয়ালার সব কথা বুঝলাম না। এটুকু বোঝা গেলো যে, এই এলাকায় বাচ্চাদের সেলফোনে আসক্তি ভয়াবহ।
যাহোক পুকুরের এপারে থানায় চলে এসেছি। রিকশার ভাইকে বললেম গেটে থাকেন। আমি কাজ মিটিয়ে আসছি। ওসি সাহেবের ঘর কোন দিকে জানতে চাইলাম বাইরে টহলরত একজন কনস্টবলের কাছে। তিনি আমাকেই পাল্টা প্রশ্ন এত রাতে কী? একটা জরুরি তথ্য দিতে হবে, কাকে বলবো? কনস্টেবল বললেন, স্যার এত রাত পর্যন্ত থাকেন না। আজ আছে। দোতালায় উঠে যান, হাতের ডানে বড় ঘরটা। সামনে নেমপ্লেট আছে সাইফুল বদিউজ্জামাল।
আমি সাইফুল সাহেবের ঘর পেয়ে গেলাম সহজে। কিন্ত স্লিপ দেয়ার কাউকে পেলাম না। খানিকটা ইতস্তত হয়ে নক করলাম। ভেতর থেকে অল্প বয়সী একটা ছেলে বের হলো। বোঝা গেলো তিনি ওসি নন। বললেন কোত্থেকে আসছেন। আমার পরণে থ্রি কোয়াটার প্যান্ট কেডস টি শার্ট। তাই ঢাকা থেকে বলা যাচ্ছে না। বললাম এইতো পুকুরের ওপার থেকে। কি দরকার? বললাম ওসি সাহেবক বলি? ওপার থেকে মোটামুটি শান্ত গলায় বললেন নজরুল ওনাকে আসতে দাও।
ওসি এক অল্প বয়স্ক ভদ্রলোক। মুখে ছোট করে ছাটা দাড়ি। দাড়িতে সাধরনত বয়স বাড়ায় কিন্তু এই ভদ্রলোকের কমিয়েছে। ইউনিফর্ম তো নয়ই, পরেছেন নীল জিন্স আর হলুদ পলো শার্ট। কেডস পরেছেন। সব মিলিয়ে পিকনিক মুডে আছেন মনে হচ্ছে। আমার পরিচয় দিলাম। শুনে বললেন কাল সাংবাদিকদের ট্রেনিংএ প্রথম দিনের ট্রেনর আপনি? আমি বুঝলাম ছোট এই মোকামে কী হয়, কী হচ্ছে সবই জানতে হয় পুলিশকে।
হাঁটছিলেন নাকী? জিজ্ঞাসা করলেন ওসি সাহেব। উত্তরের অপেক্ষা না করে আবারো বললেন, ভাই বলবেন না আমি এত হাঁটবো হাঁটবো করি পারি না। এই যে দেখেন আপনি। বাইরে এসেও সময় বের করেছেন। এটার নাম ডেডিকেশন। ভদ্রলোক চা দিতে বললেন। আমাকে বসতে বলে নিজেও বসলেন জমিয়ে। সরাসরি কাজের কথায় যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছি না। তাই কথা বলছিলাম আমা কাজ, পরিবার, পড়াশোনা এসব নিয়ে।
এবার আমি তাড়াহুড়ো করলাম। এর মধ্যে চা চলে এসেছে। ওসি সাহেব চুমুক দিলেন। তার পর বললেন, আমার মনে হয় আপনি একেবারে শুধু শুধু পুলিশের কাছে আসেননি। আপনার জরুরি কথটা আগে শুনি। এরপর আমি সেই মাটিতে পড়ে যাওয়া থেকে শুরু করে, গুলী গুলী থেকে দৌড় দেয়া পর্যন্ত কিছুই বাদ দিলাম না..
আমি শেষ করার পর ৩০ সেকেন্ড আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন সাইফুল। চায়ে চুমুক দেয়াও ভুলে গেছেন। তার পর চমকে দিয়ে ঘর কাপিয়ে হাসি শুরু করলেন। আমিও অবাক। কারণ আমার এমন তথ্যে একজন পুলিশ অফিসারের মুহূর্তের মধ্যে দলবল নিয়ে বেরিয়ে পড়ার কথা। তার বদলে এই অট্টহাসি আমাকে বিব্রত করছে। এক সময় হাসির দমক সামলে বললেন ভাই আপনি কোন জগতে আছেন? আমি তো শুনেই বুঝলাম কী ঘটনা। আমি বেশ অবাক। কি বলে লোকটা? শুনেই বুঝে গেলো?
সাইফুল সাহেব দাঁড়িয়ে গেলেন। বললেন চলেন আমার সঙ্গে। আপনার বিদেশি গোয়েন্দা দেখে আসি। আমিও পেছন পেছন নামলাম। মোটর বাইক স্টার্ট দিলেন৷ আমাকে বললেন উঠে বসতে। আমার রিকশা তখনো দাঁড়িয়ে। তাঁকে ছেড়ে দিলাম। বসলাম সাইফুল সাহেবের বাইকের পেছনে। আমি তখনো অবাক হয়েই আছি। লোকজন নিলেন না ভদ্রলোক। কী প্লান কে জানে? নাকি তারা যা করে, পুলিশকে বলে কয়েই করে। যাকগে এত ভাবার সময় নেই। মোটর সাইকেলের উঠেই যখন পড়েছি।
আমার সেই সরকারি ক্যাম্পাসে মোটর বাইক নিয়ে ঢুকলেন সাইফুল। জিজ্ঞাসা করলেন। কোন দিকে আপনার যুদ্ধ? আমি দেখিয়ে দিলাম। বাইক ডানে মোড় নিতেই সেই নারীকে চোখে পড়লো। যিনি রিকশা ওয়ালার কাছে ছেলেকে খুঁজছিলেন। এখন শক্ত করে ধরে আছেন ১৩/১৪ বছর বয়সী সেই ছেলের হাত৷ হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন ছেলেটিকে। আমি চিনলাম। আরে এতো ওই নীল আলোর যোদ্ধা। যার কাছে প্রচুর অস্ত্র ও গ্রনেড আছে। আমাকে থামতে বলতে হলো না। ওসি সাহেব নিজেই বাইক থামালেন।
ওই নারীও থামলেন। কাছে এসে বললেন ভাই আপনারা কিছু করেন। ছেলিপিলেগুলো গুল্লায় গেলো। কেন সমস্যা কী? বললেন সাইফুল। আমার ঘোর কাটছে না। নারী বললেন, কি এক খেলা আছে ওই নুবাইলে। থাকে একা। কিন্ত কীভাবে যেন লোকজন যোগাড় হয়। তার পর বগ বগ করতি থাকে আর খেলতি থাকে। যে কেউ শুনলি ভাববে কী এট্টা মারামারি হচ্ছে। কী যে নেশা এই খিলার৷ ঘণ্টার পর ঘণ্টা। গোসল নেই খাওয়া নেই, খিছলা চলতেস। বাড়ি আমি আর ওর আব্বা রাগারাগি করি। তাই এই পাচিলের মধ্যি এসি বসে। কোন কোন দিন সাইকেল নে চলি যায় নদীর ধারে। আর এই রাত্রী আমার খুঁজতি বেরোতি হয়। সরকার না শুনলাম বন্ধ করি দেল এই খিলা। তালি উরা পায় কনে?
নবু বল কোথায় পাও। বললেন সাইফুল। তাহলে আমার নিষিদ্ধ যোদ্ধার নাম নবু। নবু মাথা তুললো না৷ কিন্ত কথা বললো। প্লে স্টোরেই তো পাওয়া যায়। আর না পাওয়া গেলিও অন্য সিস্টেম আছে। সে সিস্টেম তোমরা পাও? পাই। সাইফুল রাগলেন না। বললেন তোমরা কতজন খেলো। নবু বললো অনেকেই। গোনা হয়নি। ঠিক আছে এখন বাসায় যাও আমি পরে কথা বলবো। তোমাদের সবার সঙ্গে বলতে হবে। শুধু জেনে রাখ এই খেলাটা তোমাদের জন্যে একদম ভালো না। নবু আর ওর মা চলে গেলো। চলেন এবার আপনাকেও রেখে আসি।
সাইফুল বাইক রেখে আমার ভবনের দিকে হাঁটতে শুরু করেছেন। বলছেন আপনি না সাংবাদিক। এই খবর রাখেন না? আমি এমনিতেই বোকামির লজ্জায় কুকড়ে যাচ্ছিলাম। ওর কথায় আরও লজ্জা পেলাম। বললাম আরে হ্যাঁ ফ্রি ফায়ার নামে খুব জনপ্রিয় একটা ভিডিও গেম আছে৷ আমি জানিতো এটার সম্পর্কে। কিন্তু নবুকে যখন ওই রকম একটা পরিবেশে ওই সব বলতে শুনলাম। ওর উত্তেজনা দেখলাম। তখন মাথা কাজ করেনি। তাছাড়া ঢাকা থেকে এত দূরেও যে এসব অভিশাপ চলে এসেছে বুঝতে পারিনি। ভাই জিনিসটা তো ইন্টারনেট। এর ভালো খারাপ যাই পাবেন সবখানে সমানভাবে পাবেন। সহজ করে কঠিন কথা বলে ফেললেন সাইফুল। আমার থাকার ভবনের সামনে চলে এসেছি। খুব সহজ ভঙ্গিতে হাত বাড়ালেন তিনি। আমি হাত বাড়িয়ে বললাম ভালো থাকবেন।
পলাশ আহসান
palash_ahasan2003@yahoo.com