Posts

উপন্যাস

পল্টনে জ্যামবন্দি নাসিরুদ্দীন হোজ্জা (রম্য উপন্যাস) ৪র্থ পর্ব

September 12, 2025

ইহতেমাম ইলাহী

89
View

আসরের ওয়াক্ত। আসর নামাজ পড়ে বের হয়েছি। কবির চলে গেছে ছাগদুগ্ধ আনতে। এশার আগেই সে চলে আসবে বলেছে। অবশ্য আমি তার কথা বিশ্বাস করতে পারছি না। সে না এলে গরুর দুধ দিয়েই কাজ চালাতে হবে। 

Honda C 50  স্টার্ট দিয়েছি। পা দিয়ে সজোরে কিক মেরে মেরে স্টার্ট করতে হলো। মন্দ না। হোজ্জা আমার পেছনে বসেছেন। হোন্ডা গাধার মত কুৎসিত চি চি করছে না, তবে ভ্যাটভ্যাট শব্দ করছে। এই শব্দও  কুৎসিত। সমস্যা হলো ভ্যাটভ্যাট শব্দটা সার্বক্ষনিক। হোজ্জা বললেন, তোমাদের স্থানীয় রাজা বা বাদশাহর প্রাসাদ অঞ্চল ঘুরিয়ে আনো। বললাম, হোজ্জা এখন রাজা বাদশাহ তো নেই। তবে এলাকার ওয়ার্ড কমিশনার এক ধরণের রাজা বলতে পারেন। তার প্রাসাদতুল্য বাড়ি খুব দূরে নয়। চলুন ঘুরে আসি।

হোন্ডায় চড়ে মধ্যম গতিতে চলছি। হোজ্জা কোনো সাড়া শব্দ করছেন না। পেছন ফিরে খেয়াল করলাম, তিনি আশপাশ দেখছেন। রাস্তায় তেমন জ্যাম নেই। চলে আনন্দ পাচ্ছি। মোটামুটি সুন্দর পরিবেশ। আকাশে মেঘ করেছে। বিকেলের আলো কিছুটা স্তিমিত। মৃদু বাতাস বয়ে যাচ্ছে। সব মিলে চমৎকার। আল্লাহর শুকরিয়া। 

কমিশনারের বাড়ির এলাকায় চলে এসেছি। এদিকের রাস্তা বেশ খারাপ। খানাখন্দে ভরা। রাস্তার পিচ উঠে গেছে অধিকাংশ জায়গায়। ঝাঁকুনি খাচ্ছি। হোজ্জা নিশ্চুপ। তিনি ঘুমিয়ে গেছেন নাকি আবার? ঘুমিয়ে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। কখন যে পড়ে যান ঘুমের ঘোরে…
  ‘হোজ্জা, ঘুমিয়েছেন?'
  ‘ঘুম আসছিল, ঝাঁকুনিতে ঘুম কেটে গেছে।’
  ‘বাহ!  তাহলে ভালোই হয়েছে!’

সব কিছুর উপকার আছে। ঝাঁকুনিরও যে উপকার আছে, তা দেখতে পেলাম আজ। উঁচু নিচু রাস্তা। ঝাঁকুনি সহ্য করে চলছি। সামনের দিক থেকে একটা পিক-আপ আসছে । রাস্তা সংকীর্ণ। বাধ্য হয়ে এক পাশ দিয়ে হোন্ডা চালিয়ে নিতে হচ্ছে আমাকে। সামনে একটা গর্ত পড়ে গেল । উপায় নেই। চালিয়ে দিলাম। মাইল্ড স্ট্রোকের মত মাইল্ড ঝাঁকুনিতে সিট থেকে ফুটখানেক উপরে উঠে গেলাম। ‘সর্বনাশ!’ সম্মিলিত চিৎকার করে উঠলাম আমি এবং হোজ্জা।
পিকাপ আর হোন্ডার সম্মিলিত শব্দ দূষণে আমাদের চিৎকার বোধয় মিলিয়ে গেল। 


 

কিছুদুর গিয়েই হোন্ডা থামালাম। এখন শান্তি!


কমিশনারের বাড়ির সামনেই দাঁড়িয়েছি। দেখছি। সাদা মার্বেলের মোটা মোটা পিলার বাড়িটাকে সুরম্য রূপ দিয়েছে। হোজ্জা বললেন, বাড়িটা মনে হচ্ছে জুতসই। কিন্তু তোমাদের কমিশনার রাজা মশাইয়ের বাড়ির সামনের রাস্তা এত খারাপ কেন? অন্যদিকের রাস্তা তো মোটামুটি ভালোই। এমন ঝাঁকুনি খেলাম– আমার বুড়ো হাড় তো আরেকটু হলে ভেঙ্গে যেত।

আমি চুপ করে আছি। হোজ্জার কথা সত্য, এড়ানোর উপায় নেই।

 বললাম, হোজ্জা, এই রাস্তাটা বরং ফিরে যাওয়ার সময় হেঁটে হেঁটে যাবো। তিনি বললেন, ভালো বুদ্ধি। তবে কমিশনারটা আস্ত বোকা মনে হয়। নিজের বাড়ির সামনের রাস্তা এমন ভাঙ্গা।

বললাম, উনি বোকা না, হোজ্জা। নিজ এলাকার মানুষজন তাকে ভোট দেয় না। তাদের শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে উনি এই রাস্তা মেরামত ঠেকাতে ক্ষমতার ব্যবহার করেছেন। নিজের চলাচলে একটু সমস্যা না হয় হলো, পাবলিককে তো শায়েস্তা করা গেল। আপনি যেমন লবন বহনকারী গাধাকে শায়েস্তা করার জন্য অনেকগুলো তুলা কিনে বস্তায় ভড়লেন। সেই বস্তা পিঠে নিয়ে গাধা নদীতে ডুব দেয়ামাত্রই ওজন কয়েকগুন বেড়ে গেল। দুষ্টু গাধা শায়েস্তা হলো। যদিও আপনার অনেকগুলো দামি তুলা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। মনে হয় একই ঘটনা।

কীসের সাথে কী যে মিলাচ্ছি! হোজ্জা থমকে আছেন। আমিও চুপ করে গেলাম।
হোজ্জা হঠাৎ বললেন, ক্ষামোশ! সেদিন গাধাকে শায়েস্তা না করলে সে তো প্রতিদিন আমার লবনের বস্তা নদীতে চুবাত। তাকে  শায়েস্তা না করে উপায় কী?
বললাম, তাও বিবেচনার বিষয়। আমার অযাতিত মন্তব্যের জন্য দুঃখিত, হোজ্জা। ক্ষমা করবেন।
হোজ্জা তাকিয়ে আছেন আমার চোখ বরাবর।  হঠাৎ আমার পিঠে হাত রেখে দুবার চাপড়ে দিলেন। আমি সেটাকে তার ক্ষমার নিদর্শন ভেবে নিলাম।


 

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাড়ি দেখার কিছু নেই আসলে। কমিশনারের বাড়ি দেখার প্রতি হোজ্জারও কোনো আগ্রহ লক্ষ্য করছি না আর। আমারও আগ্রহ নেই। কি আছে এই বাড়িতে? কমিশনার নিজেই এখন পলাতক। তার বাড়ি খান খান ফাঁকা। শুনশান নিরবতা। হোজ্জাকে বললাম, চলুন ফিরে চলি। 

আমরা (আধুনিক) গাধা হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে নিজেরাও হেঁটে চলছি। সামনের মূল রাস্তা পৌঁছেই আবার গাধার পিঠে সওয়ার হবো। গাধা আর বিশ্রাম পাবে না। ভ্যাট ভ্যাট শব্দে তাকে চলতে হবে। 

                                                               (৩) (নতুন পাতা)


আজ প্রচুর রোদ পড়েছে। তপ্ত দুপুর। যুহর পরে বাসা চলে এসেছি। সাথে আমার বন্ধু মাসুম। বসে আছি ঘরে । মাসুম একজন অতি ধনী ছেলে (পৈতৃক সূত্রে) । সে নিজে কিছু করে না বললে ভুল হবে, দুই দুইটি আইফোন চালায়। আপডেট ভার্সন। দেখছি, মাসুমের চোখ লালচে। দৃষ্টি করুন। এলোমেলো চাহনী। মনে হচ্ছে কিছুক্ষণ আগেই ফুঁপিয়ে কেঁদেছে। এত হাসিখুশি উতফুল্ল ছেলেটা কাঁদবে কেন?
  ‘মাসুম! কান্নাকাটা করেছিস নাকি রে?’
  --যা ইচ্ছা করেছি।


মাসুমের কন্ঠে ক্ষোভ। ফ্লোরে সে হাত পা ছড়িয়ে বসে পড়েছে দেয়ালে হেলান দিয়ে। সিলিং এর দিকে তাকিয়ে আছে ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে । হঠাৎ বলল, জীবন বড় করুনার রে, মুরাদ। বড়ই নিরানন্দ।
মাসুমের দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন হোজ্জা আর কবির (বলতে ভুলে গেছি, কবির ঠিকই ছাগদুগ্ধ নিয়ে এসেছিল গতকাল। সে হোজ্জার পিছু ছাড়ছে না।) 
আমরা সবাই মাসুমের দূর্দশার কারণ জানতে আগ্রহী হলাম। 

কারণ জানা গেল। মাসুমের গার্লফ্রেন্ড (?) মহিমা তাকে ছেড়ে এমন একটা ছেলের সঙ্গ নিয়েছে– যার চাল চুলো নেই। নাম আজগর আলী। নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে। দেখতেও তেমন না। (মাসুম বেশ হ্যান্ডসাম)। তবে আজগর আলী ছাত্র বেশ ভালো।

মাসুমের কন্ঠস্বর আর্দ্র। বিষাদময়।

‘মহিমা  কাকে ছেড়ে কাকে ধরল, মুরাদ?  দীর্ঘ্য (!) ৫  মাস ১৭ দিনের  সম্পর্ক ত্যাগ করে এক  আজগরের আলীর হাত ধরল। জীবনে অপমানের আর কী বাকি আছে?’
বললাম, অপমান না মন ভেঙ্গে খান খান?

সে বলল, দুইটাই। 

মাসুম বলে যাচ্ছে– ভেবে দেখ, মহিমাও অবস্থাসম্পন্ন ঘরের মেয়ে। সে এমন একটা লো ক্লাস ছেলের সাথে সম্পর্ক করবে আমাকে ছেড়ে– এটা ভাবলেই সুইসাইড করতে ইচ্ছা করছে। করবও হয়ত।

মাসুম দু হাতে চেহারা ডলছে। চোখের পানি ঢাকছে হয়ত। বললাম, শুয়ে পড়, বিশ্রাম নে। সে বলল, জীবনে কোনো বিশ্রাম নাই। এই মেয়েটাকে সিরিয়াসলি ভালোবেসেছিলাম। তার জন্য টাকা খরচ করেছি বন্যার পানির মত। কোন চাওয়া বাদ রাখি নাই।

আমি বললাম, দোস্ত, ফ্রী প্রেম প্রীতির এই যুগে কিভাবে আটকাবি এইসব? তোর নিজেরও তো অতীত আছে। আর মহিমা ধনী পরিবারের মেয়ে তো কী হয়েছে? ধন-সম্পদ প্রাচুর্য্যের মধ্যে থেকে থেকে অরুচি এসে গেছে হয়ত তার। একঘেয়েমী! হয়ত সে লাইফে নতুনত্ব চায়। এজন্য একটা নিম্নবিত্ত ছেলের সাথে সম্পর্ক করে নতুন ধরণের সুখ খুঁজছে। এডভেঞ্চার বলতে পারিস।


আমার দার্শনিক টাইপের কথা বার্তা হোজ্জা ও কবির উভয়েই আনন্দ নিয়ে শুনছে মনে হচ্ছে। হোজ্জার চোখে সন্তুষ্টির ছাপ। কিন্তু মাসুম ধমকে উঠল। 
    ‘তুই বন্ধু নামের কলঙ্ক। এদিকে আমার জীবনে সুইসাইড করা কষ্ট, আর লেকচার শুরু করছে লেকচারার সাহেব। যখন সুইসাইড করব তখন লেকচার লেকচার বন্ধ হবে।’
বললাম, মাসুম, এক কাজ কর। হোজ্জাকে সব খুলে বল। দেখ তিনি কোনো উপায় করে তোর কষ্ট দূর করতে পারেন কি না।

মাসুম হোজ্জার দিকে তাকালো। চোখে দুঃখ দুঃখ ভাব। কিছুটা লাজুকতা। হোজ্জা বললেন, চিন্তা করো না ,বৎস। সব ঠিক হয়ে যাবে। কোনো কিছুই বেঠিক থাকেনা।

হোজ্জা আমার উদ্দেশ্যে বললেন, আজ দুপুরের খাবার কী করেছ?
    ‘খাসির মাংস, ডাল ভুনা, সাদা ভাত।’
    ‘নিয়ে এসো দ্রুত। সবাই মিলে খাবো।’


মাংস রান্না এতই চমৎকার হয়েছে যে, হোজ্জা মুখে নিয়ে আনন্দে চোখ বন্ধ করে ফেলছেন। তিনি আরাম করে খাচ্ছেন।
‘আলহামদুলিল্লাহ! কী সুস্বাদু! মাসুম বৎস, মজা করে খাও। দেখ, জীবন কত আনন্দের। এত উপাদেয় খাসির মাংস সব সময় পাওয়া যায় না। খাসিটার বয়স মনে হয় কম। তুলার মত নরম মাংস।’
মাসুম বলল, হোজ্জা, খাসির মাংস, উটের মাংস আর সাদা পানি আমার কাছে সব সমান হয়ে গেছে। জীবনটাই পানসে।
হোজ্জা বললেন, পিপাসা পেলে পানি কিন্তু খুবই উপাদেয় পানীয়!
মাসুম বলল, আমার জীবনে কোনো পিপাসা নেই। সব পিপাসার মৃত্যু হয়েছে।

মাসুম সত্যিই কয়েক লোকমা খেয়ে উঠে পড়ল। বললাম, দোস্ত, না খেলে শরীর নষ্ট হবে। সকালে কী খেয়েছিস?
  –খাসির কাচ্চি খেয়েছি। কাচ্চিওয়ালা জোড় করে খাওয়ালো। পকেটে মোটা মানিব্যাগ নিয়ে ঘুড়ি। জোড় তো করবিই! খেলাম। অখাদ্য। জীবনটাই অখাদ্য। শুধু বেদনা আর কষ্ট।

হোজ্জা মাসুমের দিকে তাকিয়ে বললেন, জীবনটা বড়ই নিরানন্দ করে ফেলেছ হে!




 

সারাদিন মোটামুটি বিশ্রামে কাটল। হোজ্জার শরীর একটু খারাপ। বললেন তার বিশ্রাম দরকার।
ইশার নামাজ শেষে বাইরে হাঁটতে বের হয়েছি সবাই। আমাদের ছোটখাট দল । হোজ্জা, আমি, কবির ও মাসুম। আমি আর হোজ্জা সামনে। এটা সেটা গল্প করছি। তিনি আমাদের দেশের বিষয়ে অনেক কিছুই জিজ্ঞেস করছেন। আমি সাধ্যমত তথ্য দিচ্ছি। মাসুম ও কবির আমাদের পিছু পিছু পাশাপাশি হাঁটছে। তাদের মুখে কথা নেই। দুজনেই আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। শূন্য দৃষ্টি।

হোজ্জা জিজ্ঞেস করলেন আমাদের দেশের রাজা সম্পর্কে। জানালেন, তার সময়কার কোনো অঞ্চলের রাজা সেই হত, যে জনগনকে নিরাপত্তা দেয়ার মত বীর বাহাদুর। সেই সময়ে মোঙ্গল হামলায় মুসলিম অঞ্চলগুলোর অবস্থা ছিল সঙ্গীন। হোজ্জা সে সময়ের কিছু করুন ঘটনা শোনালেন। এক তুর্কি গোত্রপতির সাহসীকতার কথাও শোনালেন। আমি তাকে জানালাম, আমাদের রাজাকে বলা হয় প্রেসিডেন্ট। তাকে হতে হয় নিরীহ। চুপ থাকার গুন থাকতে হয়। আমাদের বর্তমান রাজা চুপ থাকতে বিশেষ পারদর্শী। তার উপাধীতেই ‘চুপ” শব্দটা যুক্ত হয়ে গেছে। তবুও মাঝে মাঝে দুই একটা কথা বললেই জনগন বলে– চুপ, চুপ। তাকে আবার নিয়োগ করেছিল এক বয়স্কা মহিলা। 

হোজ্জা আমার কথার মানে ঠিকমত বুঝতে পারছেন না মনে হয়। তিনি তার দাড়িতে হাত বুলাচ্ছেন। থমকে আছেন। ভাবলাম, আমার কথাগুলো ব্যাখ্যা করি। তাকে অনেক তথ্য দিয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে বোঝালাম। কিন্তু বুঝে তিনি তৃপ্ত হলেন– এমন মনে হলো না । বরং তার বিভ্রান্তিই মনে হয় বেড়ে গেল। দুষ্ট খোকার কল্পিত রাজা নিয়ে বলা কবিতা টাইপ। কয়েক লাইন মনে পড়ছে,
…একদিন সেই রাজা,

ফড়িং শিকার করতে গেলেন,
খেয়ে পাপড় ভাজা!

আমি রাজনৈতিক বিষয় এড়িয়ে অন্য কোনো আলাপ শুরুর চেষ্টা করছি। রাত প্রায় সাড়ে নয়টা বাজে। রাস্তায় হাঁটতে হচ্ছে সাবধানে। মোড়ে মোড়ে সারি করে কুকুর বাহিনী শুয়ে আছে। রাস্তা তারাই দখল করে রেখেছে একরকম।

(চলবে ইন শা আল্লাহ)

ভূমিকা পর্ব  https://fictionfactory.org/posts/13904

১ম পর্ব  https://fictionfactory.org/posts/13905

২য় পর্ব   https://fictionfactory.org/posts/13906

৩য় পর্ব  https://fictionfactory.org/posts/13907 

Comments

    Please login to post comment. Login