রেলপথের ধারে এক বিকেল
সকালের রোদ তখনও কাঁচা, সোনালী আভা মেখে মাঠের ঘাসের ডগায় ঝিকিমিকি করছে শিশির। গ্রামের ভোরের হাওয়া সবসময়ই যেন অন্যরকম। শহরের মতো কোলাহল নেই, নেই গাড়ির শব্দ কিংবা তাড়াহুড়োর ভিড়। কেবল ধানের খেতে দুলে ওঠা বাতাসের শো শো আওয়াজ, আর দূরের বাঁশবাগানের ভেতর থেকে ভেসে আসা পাখির ডাক। এই শান্ত পরিবেশেই বেড়ে উঠেছে অরুণ আর তার শৈশবের বন্ধু নীলা।
অরুণের বাড়ি রেলপথের একেবারে ধারে। জানালার বাইরে তাকালেই দেখা যায় লম্বা রেললাইন, যা যেন এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে অজানা কোনো পৃথিবীতে পৌঁছে দিচ্ছে। ট্রেন চলে গেলে কেঁপে ওঠে পুরো মাটি, কিন্তু তার মাঝেও এক অদ্ভুত টান আছে। ছোটবেলা থেকে অরুণ ও নীলা বিকেলবেলা রেললাইনের ধারে বসে সূর্যাস্ত দেখত। তাদের কাছে রেললাইন মানেই স্বপ্নের পথ।
নীলা অরুণের থেকে একটু ছোট। মায়াবী মুখে সবসময় একটা হাসি খেলে বেড়াত। গ্রামের মেয়েদের মতো চটপটে, পরিশ্রমী। তবে তার চোখের গভীরে ছিল অন্যরকম কৌতূহল—বাইরের পৃথিবীকে দেখার, জানার। পড়াশোনাতেও সে বেশ ভালো। অরুণ মাঝে মাঝে ভাবত, একদিন হয়তো নীলা সত্যিই ট্রেনে চেপে দূরের শহরে চলে যাবে, আর সে দাঁড়িয়ে থাকবে এই গ্রামে, হাত নাড়বে বিদায় জানিয়ে।
একদিন বিকেলে, তারা দুজন আবার রেললাইনের ধারে বসেছিল। কাশফুলের মতো সাদা মেঘ আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে, হাওয়ায় গরম কমে এসেছে। নীলা চুপচাপ রেললাইনের দিকে তাকিয়ে ছিল।
অরুণ জিজ্ঞেস করল,
—কী ভাবছিস?
নীলা একটু হেসে বলল,
—ভাবছি, এই লাইনটা কোথায় যায়। আমাদের গ্রাম থেকে বেরিয়ে তো কত দূর চলে গেছে। যদি আমি একদিন এই লাইনে চড়ে যাই, তবে কি আবার ফিরে আসতে পারব?
অরুণের বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল।
—ফিরবি না মানে? তুই গেলে আমি একা থাকব?
নীলা মাটিতে ছোট একটা কঙ্কর ছুঁড়ে দিয়ে বলল,
—না রে, তুই একা হবি না। কিন্তু আমি তো শুধু গ্রামে পড়ে থাকতে চাই না। আমি শহরে পড়তে চাই, বড় কিছু হতে চাই।
অরুণ চুপ করে গেল। গ্রামের ছেলেরা সাধারণত চাষবাসেই থেকে যায়। তারও তেমন কোনো বড় স্বপ্ন নেই। তবে নীলার চোখে জ্বলজ্বল করা আগুন দেখে সে মুগ্ধ হয়।
দিনগুলো একে একে এগোতে থাকে। ধানের খেত পেকে সোনালি হয়ে যায়, নদীর জল শুকিয়ে যায়, আবার বর্ষায় ভরে ওঠে। সময়ের স্রোতে অনেক কিছু বদলায়, কিন্তু তাদের বিকেলবেলার রেললাইন-আড্ডা একই থাকে।
একদিন রেলস্টেশনে খবর এল—নীলা শহরের কলেজে ভর্তি হয়েছে। পুরো গ্রাম যেন গর্বে ভরে উঠল। কিন্তু অরুণের মনে মিশ্র অনুভূতি। আনন্দ আছে, আবার হাহাকারও। নীলাকে ছাড়া তার বিকেলগুলো কেমন হবে?
বিদায়ের দিন সকাল। স্টেশন ভরে গেছে লোকজনের কোলাহলে। ট্রেন আসার আগে সবাই ব্যস্ত। অরুণ আর নীলা একটু দূরে দাঁড়িয়ে। নীলা নতুন সালোয়ার কামিজ পরে এসেছে, কাঁধে ব্যাগ। চোখেমুখে উচ্ছ্বাস, তবে বুকের গভীরে লুকানো দুঃখও আছে।
—অরুণ, আমি যাচ্ছি, কিন্তু ফিরব। মাঝে মাঝে তোকে চিঠি লিখব। তুই রাগ করিস না, প্লিজ।
অরুণ হাসি মুখে বলল,
—রাগ করব কেন? তুই তো আমার বন্ধু। যা ইচ্ছে কর, আমি আছি তোকে নিয়ে গর্ব করার জন্য।
ট্রেনের হুইসেল বাজল। লাইন কেঁপে উঠল। নীলা ট্রেনে উঠে হাত নাড়ল। অরুণও হাত নাড়ল, কিন্তু তার চোখ ভিজে গেল। ট্রেনটা ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেল বাঁক ঘুরে। রেললাইন পড়ে রইল আগের মতো, নিরিবিলি, কেবল বাতাসে কেঁপে ওঠা এক অজানা শূন্যতায়।
সময় আবার গড়াল। নীলা শহরে নতুন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠল। বই, ক্লাস, নতুন বন্ধুবান্ধব। তবু মাঝে মাঝে চিঠি লিখে পাঠাত অরুণকে। লিখত শহরের গল্প, উঁচু দালান, ব্যস্ত রাস্তাঘাট, আবার লিখত গ্রামের জন্য তার টান। অরুণও জবাব দিত, জানাত রেললাইনের ধারে তার একলা বিকেল, ধানের খেতের রং, গ্রাম মেলার কোলাহল।
একদিন সন্ধ্যায়, অরুণ চিঠি পেল—নীলা জানাল সে পরীক্ষায় ভালো ফল করেছে, আর আগামী বছর দেশের বাইরে পড়তে যেতে পারে। চিঠির শেষ লাইনে লেখা ছিল—
“অরুণ, তুই আমার স্বপ্নের সাক্ষী। আমি যদি অনেক দূরে যাইও, রেললাইনের ধারে তোর সাথে কাটানো বিকেলগুলো কোনোদিন ভুলব না।”
চিঠি পড়ে অরুণের বুক কেঁপে উঠল। হঠাৎ তার মনে হলো, এই রেললাইন শুধু গ্রামের সীমানা নয়, মানুষের স্বপ্নকেও দূরে নিয়ে যায়। নীলার স্বপ্নের মতোই।
অরুণ চুপচাপ রেললাইনের ধারে বসে রইল। বাতাসে শিস দিচ্ছে কাশফুল, সূর্য ডুবে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। দূরে ট্রেনের হুইসেল শোনা গেল। অরুণ মনে মনে বলল—
“যা নীলা, তুই উড়ে যা। আমি এখানেই থাকব, তোকে মনে রেখে। এই রেললাইনই আমাদের বন্ধনের সাক্ষী হয়ে থাকবে।”
রাত নেমে এলো। চারপাশে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। রেললাইনটা চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে, যেন দুজন বন্ধুর অটুট সম্পর্ককে আঁকড়ে ধরে আছে। গ্রামের নিরিবিলি পরিবেশ আবার শান্ত হলো, কিন্তু অরুণের ভেতরে বাজতে থাকল নীলার স্বপ্নের সুর।