Posts

উপন্যাস

পল্টনে জ্যামবন্দি নাসিরুদ্দীন হোজ্জা (রম্য উপন্যাস) ৫ম পর্ব

September 14, 2025

ইহতেমাম ইলাহী

49
View

(৪র্থ পর্বের পর) 

এলাকায় চক্কর দেয়ার মত ঘুরে ফিরে বাড়ির অভিমুখে পথ ধরেছি। কিছু পথ আসতেই মধ্যম উচ্চতার, মাঝারি গড়নের এক লোক আমাদের পথ আটকালো। তার মুখে মাস্ক। উদ্দেশ্য বোঝা যাচ্ছে না। আমি তাকালাম তার চোখের দিকে। তাকে বোঝার চেষ্টা।
লোকটি বলল, ভাই, আমাকে কিছু সাহায্য করেন। বলতে লজ্জা লাগে কিন্তু আমার ঘরে আজ কোনো খাবার নাই।
লোকটির পাঞ্জাবী বেশ সুন্দর, দামী মনে হচ্ছে। পরখ করে দেখলাম– তাকে ভিক্ষুকের মত লাগে না। হোজ্জা বললেন, কী চায়? হোজ্জাকে জানালাম।
আমি ১০০ টাকা একটা নোট দিলাম লোকটির হাতে। বললাম, আল্লাহ রহম করুন।
লোকটি মনে হয় খুশি হলো। কারণ সে মাস্ক খুলে ফেলল। উজ্জ্বল গৌড় বর্ণের চেহারা। আভিজাত্যের ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু একটা অপমানিত, ভরসাহীনতার ছাপ পড়েছে। তিনি মুখ খুললেন। বললেন, আমি ধনী মানুষ ছিলাম ভাই। আমার ৫ কোটি টাকার জমি এক লোক কমিশনারের সাথে হাত করে দখল দিয়েছিল। আমি সর্বশান্ত হয়ে গেছি। মামলা করলাম। সেই লোক রেগে এমন মামলার প্যাঁচে ফেলল। বাড়ি পর্যন্ত বিক্রি করতে হইছে। ধার দেনায় শেষ হয়ে গেছি। আত্মীয়স্বজনকে মুখ দেখাতে পারি না।
লোকটির কন্ঠ কাঁপছে। চোখ দিয়ে পানি ঝড়ছে। আমি তার কথা বিশ্বাস করব নাকি অবিশ্বাস করব বুঝছি না। ফ্রডে ভরে গেছে সব জায়গা। লোকটি তখন  আমাদের অবাক করে দিয়ে, ইংরেজিতে কথা বলা শুরু করল।
I am not a man what you think. I am an educated person. Dhaka university graduate. I am a victim of deception. Now a beggar.

ভদ্রোলোক ইংরেজিতে কথা বলে তার শিক্ষা ও যোগ্যতার প্রমাণ দিতে চাইছেন। আমরা তার কথা বিশ্বাস করলে তিনি মনে স্বান্তনা পাবেন, এই হয়ত চাওয়া।
কীভাবে তাকে সান্তনা দেয়া যায়? ভাবছি। বললাম, মুহতারাম আপনার নামটা বলা যাবে?
  --জি, আমি নাসিম। নাসিম মল্লিক।

  --আচ্ছা।
নাসিরুদ্দীন হোজ্জার দিকে ইঙ্গিত করে বললাম, আর ইনি বিখ্যাত নাসিরুদ্দীন হোজ্জা!
দেখি লোকটির প্রতিক্রিয়া কী হয়!

লোকটি আনন্দিত চোখে তাকাল । হোজ্জার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। হোজ্জা মোসাফাহা করলেন। তার জন্য দুআ করলেন। দুআ শুনে লোকটি হোজ্জাকে বললেন, যেই লোক আমার এই দূর্দশা করেছে তার জন্য কিছু বদ দুআ করেন। অথবা আমাকে এমন বদ দুআ শিখিয়ে দেন যেন তার জীবন অতিষ্ঠ হয়ে যায়। আপনি মোল্লা মানুষ এজন্য জিজ্ঞেস করছি।

লোকটির এমন কথা হোজ্জা প্রত্যাশা করেন নি হয়ত। তিনি চুপ করে গেলেন। আমি দাঁড়িয়ে দেখছি তাদের। মাসুম ও কবির পিছিয়ে পড়েছিল। তাদের আসতে দেখা যাচ্ছে। কবির কী যেন বলছে। মাসুম চুপ করে আছে।

হোজ্জা বললেন, একটা বদ দুআ শিখিয়ে দিতে পারি তোমাকে নাসিম সাহেব। কবুল হলে কাজ হতে পারে।
    –কী দুআ, হোজ্জা?
    –তুমি দুআ করো ঐ লোক, যে তোমাকে ঠকিয়েছে, সম্পত্তি আত্মসাৎ করেছে, সে যেন শতভাগ সৎ মানুষ হয়ে যায়।
    –মানে কী হোজ্জা? আমি তো বদ দুআ শিখিয়ে দিতে বলেছিলাম।
    –হ্যাঁ, তোমার দুআ অনুযায়ী সেই লোক শতভাগ সৎ হয়ে গেলে, তার সততার কারণে সে পদে পদে যন্ত্রনার স্বীকার হবে। কাছের দূরের সবাই তাকে ঠকাবে। তাকে বোকা ভাববে। ঠাট্টা করবে। সে চূড়ান্ত গরীব হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও আছে। ভেবে দেখ। তার জীবন হয়ে যাবে অতীষ্ঠ। সমাজে বাস করা হয়ে যাবে কঠিন।

আমি থমকে গেছি। হোজ্জার কী আজীব কথা বার্তা! লোকটি পর্যন্ত চুপ করে আছে। দুআ’টা তার মনে ধরেছে কি না কে জানে! তার শরীর কেমন কেঁপে কেঁপে উঠছে। হঠাৎ হাউমাউ করে কাঁদছে শুরু করল সে। এরপর হোজ্জাকে জড়িয়ে ধরল।
হোজ্জা নাসিম সাহেবের পিঠ চাপড়ে সান্তনা দিতে লাগলেন। 

বাড়ি ফিরেই ধুন্দুমার কান্ড ঘটে গেল। মাসুম আর্তচিৎকার করছে। তার দুইটা ফোন, মানিব্যাগ নেই। পকেট থেকে নেই। চুরি হয়েছে। বললাম, এই, কত টাকা ছিল মানিব্যাগে?
    –ছিল ২৭ হাজার টাকা। মোবাইল দুইটার দামই তো ২ লাখ।
    –এত ভারি মানিব্যাগ, দুইটা মোবাইল পকেট থেকে নাই হয়ে গেল, বুঝলি না তুই!
    –পকেটে অন্য মানিব্যাগ দেয়া, আর টাইলসের ভাঙ্গা!
     –বলিস কী!

মাসুম টাইলসের দুইটা টুকরা ছুড়ে মারল বিছানায়। তাকে দেখে মনে হচ্ছে– রাগে দুঃখে মাথার চুল ছিড়তে চাচ্ছে ।
ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই থমকে গেছি ।  কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। মাসুমকে কী বলা যায় বুঝছি না। সে গজগজ করছে। ধপ করে বিছানায় বসে পড়ল।
    ‘এক লোকের সাথে রাস্তায় দুই দুবার ধাক্কা খাইছি। ঐ ব্যাটাই মনে হয় পকেটমারি করছে।’
  –তুই শিওর?
  –আরে শিওর শিওর? আমার মানিব্যাগ, মোবাইল নাই এটাই শিওর। আমার গার্লফ্রেন্ড আমাকে ছ্যাকা দিছে এটা শিওর। আ আ আ।

উত্তেজিত মাসুমকে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করছেন হোজ্জা আর কবির। হোজ্জা বললেন, রাতের খাবার নিয়ে আসো। আমি বললাম, হ্যাঁ, দ্রুত আসছি ইন শা আল্লাহ। দুপুরের খাবারের বাটি, টিফিন ক্যারিয়ার, প্লেট ইত্যাদি ব্যাগে ভরা আছে। এগুলো পাল্টে আবার খাবার নিয়ে আসতে হবে। আমার শরীর হালকা কাঁপছে। কি হতে কি হয়ে গেল!

চারতলায় আমাদের ফ্লাটে যেতে হবে । সিঁড়ি বেয়ে উঠছি। হঠাৎ আমার মনে অজানা ভীতি জেঁকে বসল। মোবাইল, মানিব্যাগ কবির চুরি করে নি তো? সে বলছিল, সে দুই মাস থেকে পকেটমারি ট্রেনিং নিচ্ছে।
সর্বনাশ!

বাসা এসে টিফিন বাটির ব্যাগ খুলছি। ভুত দেখলেও এতটা চমকাতাম না বোধয়। কারণ, ব্যাগে একটা মানিব্যাগ, দুইটা আইফোন। মাসুমের!
গা শিউরে উঠেছে আমার। আমি হতভম্ভ। ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। মা এসে বললেন, কী রে খাম্বার মত দাঁড়ায় আছিস কেন? কী হইছে?
  –মা তুমি যাও। আমি আসছি।

ভাবিছি– ফোন, মানিব্যাগ কী করব? মাসুমকে কি দিয়ে দিব? বেচারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে তাহলে।
নাকি অপেক্ষা করব ঘটনা বোঝার জন্য? কিছু না বুঝে পদক্ষেপ নিলে আবার কোন প্যাঁচে পড়ে যাই। সন্দেহের তীর না জানি আমার দিকে আসে! অপেক্ষা করাই নিরাপদ । ঘটনার পেছনে কবিরের ভুমিকা আছে সুনিশ্চিত। সে কী ফোন লুকাতে না পেরে এখানে রেখে দিয়েছে? কী যে ঝামেলায় পড়লাম।

রাগ, বিরক্তি, ভয়ে  আমার অবস্থা কেরোসিন কিংবা ডিজেল। (আমার নিকট চুরি অতি ভয়ানক একটা জিনিস)। ছটফট লাগছে। সিঁড়ি দিয়ে নামছিও অতি দ্রুত। কখন যে পা পিছলে! আল্লাহ রক্ষা করুন। 

খাবার নিয়ে হোজ্জার ঘরে ঢুকলাম। দেখি এক মধ্যবয়সী লোক আর তার ছোট শিশুকন্যা এসেছে। হোজ্জার সাথে ছবি তুলছে। আমার রক্তশূন্য চেহারা হোজ্জা খেয়াল করলেন। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ । এর অর্থ হয়ত– শান্ত হও, সব ঠিক আছে। সব ঠিক আছে মানে? 

ছোট্ট মেয়েটার বয়স হবে ৬/৭ বছর। সে বলছে– হোজ্জা আরেকটা ছবি, আরেকটা ছবি! মেয়েটির বাবা বলছে– হোজ্জা, কিছু মনে করবেন না। আজকালকের ছেলে মেয়ে যা হয়েছে। আর আমার মেয়ে তো এক ধাপ এগিয়ে। কোনো কিছুতে না করতে পারি না। কোনো কিছু চেয়েছে, দিই নি। তো কঠিন হুমকি দিবে।
হোজ্জা বললেন, কী হুমকি দেয়?
    ‘পরীক্ষার খাতা ফাঁকা রেখে আসবে, লিখলেও ভুল লিখবে সব– এই হুমকি। আমি ভাবছি বাচ্চা মানুষ রেগে মেগে বলছে। কিন্তু পরে দেখি প্রত্যেক পরীক্ষায় ফেইল করেছে। অথচ তার সব পড়া। এরপর থেকে সাবধান হয়ে গেছি।’
      ‘ওহ হো।’

মাসুম হাত পা ছেড়ে দিয়ে শুয়ে আছে। তার দৃষ্টি সিলিং এর দিকে নিবদ্ধ । চেহারা থমথমে। একই সাথে সে রাগত, দুঃখিত, হতবাক, হতাশ। কবির তাকে বলল, বড় ভাই। আপনি অনেক ক্লান্ত। পা গুলা টিপে দেই? আরাম পাবেন। ছোটবেলায় বাবার পা টিপছি অনেক।
মাসুম কোনো কথা বলছে না। মনে হচ্ছে সে কবিরের কথাই শুনতে পায় নি। কবির নিজ উদ্যোগে তার পা টিপতে শুরু করল। নাসিরুদ্দীন হোজ্জা ছোট্ট মেয়েটির সাথে কথা বলছেন।
    ‘মামনি, তুমি আমার সাক্ষাতে এসেছ, কিন্তু আমার সাথে তো কোনো কথাই বলছ না। শুধু ছবি তুলছ! এটা কি ঠিক?’
    ‘ছবিগুলো কাল আমার বান্ধবীদের দেখাবো। নিজেও দেখব। অনেক মজা হবে।’
      ‘অনেক ছবিই তো তুললে! কিন্তু কোন আলাপই হলো না তোমার সাথে!’
       ‘আপনার ছবি তুলে রাখছি না? ছবিগুলো পরে দেখব বাসায় বসে।’
       ‘ওহ, জলজ্যান্ত আমার সাথে কথা বলার কোনো আগ্রহ পাচ্ছ না তাহলে।’
        ‘আপনার গোলমেলে কথা কিছুই বুঝছি না আমি। আপনি বৃদ্ধ হয়েছেন বলেই কি এমন গোলমেলে কথা বলেন?’
         ‘তোমার কথার কী উত্তর দিব আমি বুঝতে পারছি না, মামনি।’

মেয়েটির বাবা এতক্ষণে কথা বললেন, হোজ্জা, কিছু মনে করবেন না। ছোট বাচ্চা মেয়ে।
হোজ্জা বললেন, না কিছু মনে করি নি। 

ভদ্রলোক মেয়েকে নিয়ে বিদায় নিলেন। কবির পা টিপছে মাসুমের। মাসুম ঘুমিয়ে পড়েছে। খাবার খাওয়ার আগে এটাই সুযোগ। মোবাইল, মানিব্যাগ জটিলতার সমাধান করতে হবে। হোজ্জাকে জিজ্ঞেস করব, তিনি ঘটনা কিছু জানেন কি না।

আমি খুবই আশ্চর্য্য হয়ে শুনছি । হোজ্জাই নাকি কবিরকে বলেছেন মাসুমের মোবাইল, মানিব্যাগ চুরি করতে! কবির তাই করেছে। অতি চমৎকার ভাবে করেছে। মাসুম কিছুই বুঝতে পারে নি।
আমার অস্থিরতা কিছুটা কমল । সব যেহেতু হোজ্জার পরিকল্পনা, ইনশাআল্লাহ ভালো কোনো সমাধান হবে। কিন্তু কী সেই সমাধান? অপেক্ষায় থাকি। এদিকে বেচারা মাসুমের যা অবস্থা। আরেকটা ব্যাপার আমাকে ভাবাচ্ছে । কবিরের চুরি বিদ্যার পারদর্শিতা! এই ছেলে সাংঘাতি চোর। তার দিকে তাকালাম। সে অদ্ভুত হাসি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এই হাসির অর্থ কী? পাত্তা না দিয়ে বললাম, এই জনাব, মাসুমকে ডাক। খাব সবাই।



 

চুপচাপ খাচ্ছি। কারো মুখে কথা নেই। মাসুমের অবস্থা– অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর, নিরবতা হিরন্ময়।

বসে আছি আমরা । খাওয়া শেষ। হোজ্জা ঘরের মধ্যে হাঁটাহাঁটি করছেন। আরেকটা সিঙ্গেল তোষক নিয়ে আসব ভাবছি। মাসুম রাতে থাকার কথা। কিন্তু হঠাৎ সে মত বদলাল। থাকবে না। বললাম, রাতে ভালো মত ঘুমা। আল্লাহ চাইলে একটা ব্যাবস্থা হবে ইন শা আল্লাহ।
সে আমাকে উপেক্ষা করে কবিরের দিকে তাকাল।  বলল, পা টেপাটা এত মজা লাগছিল। ১০/১৫ মিনিট গভীর ঘুমিয়েছি। শরীর ঝরঝরা লাগছে। আজ রাতে আর ঘুমানোর দরকার নাই। যেভাবে হোক পাত্তা লাগাবো– কে ফোন মানিব্যাগ চুরি করেছে। কিছু গ্রুপ আছে ওদের টাকা খাওয়াতে হবে খবর বের করার জন্য। থানায় জানাতে হবে। 

মাসুমের চোখেমুখে একটা সিন্সিয়ার সিন্সিয়ার ভাব। কথা বলছে ডিটেকটিভ ভঙ্গিতে। মনে হচ্ছে সে ভালো একটা কাজ খুঁজে পেয়েছে। উত্তেজনা বোধ করছে। সে দাঁড়িয়ে পড়েছে। কবিরকে বলল, কবির, যাবা আমার সাথে? যদি চোররে পাইছি। আচ্ছামত বানাবো। আমার পা যেমন বানাইছো। চোররে তেমন বানাইতে হবে। পারবা না ?
কবির বলল, পারব বস।
এমন ভঙ্গিতে সে “পারব বস” বলল– মনে হয় আসলেই সেই চোরকে পেটাতে উদগ্রীব।
মাসুম বলল, চলো তাহলে। সময় নাই।


কবির মত বদলাল। সে মাসুমের সাথে যেতে রাজি হচ্ছে না। সে ভালো করেই জানে চোরকে রাস্তায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। মাসুমকে বলল, ভাই এত ঘুম পাইছে! ঘুমালে ভালো হত এখন।  কাল সকালে কিছু করতে পারি কি না দেখা যাবে!
মাসুম ঘোষণা দিল— যত দ্রুত সম্ভব জিনিসের পাত্তা লাগাতে হবে। দেরি করলে মিস হয়ে যাবে। একাই যাবে সে।

হোজ্জার কাছে বিদায় নিয়ে মাসুম চলে গেল। গেটে তালা দিয়ে ফিরে এসে দেখি হোজ্জা ঘুমিয়ে পড়েছেন। কবিরও শুয়ে পড়েছে। আমাকে দেখে বলল, মুরাদ ভাই! নিজেকে নিজে পেটাবো কীভাবে, বলেন তো? বললাম, হাতে লাঠি নিয়ে নিজের পায়ে বাড়ি দিবা।
  –ভয় লাগতেছে মুরাদ ভাই! কোনোভাবে যদি মাসুম ভাই জেনে ফেলে?
  –মাসুমের সাথে খাতির লাগাও। মাফ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে।
  –কোন প্যাচে যে পড়লাম! অবশ্য হোজ্জা সব সামাল দিবেন আশা করি। মাসুম ভাই কি আগামীকাল আবার আসবেন?
  –হুম, আসার কথা। মজার ব্যাপার কী জানো কবির?
  –কী ভাই?
  –মাসুমের হতাশা, মনঃকষ্ট হঠাৎ নাই হয়ে গেছে। তার আচার আচরণ কিছুটা হলেও স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে! খেয়াল করেছ?
  –তাই তো! হোজ্জার কি এরকমই প্ল্যান ছিল?
  –আল্লাহু আ’লামু!



 

হোজ্জাকে কিছু জিজ্ঞেস করা গেল না। তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। গভীর ঘুম। মৃদু নাক ডাকার আওয়াজ পাচ্ছি। আমিও শুয়ে পড়ব। হাই আসছে। ঘুমানো দরকার। আগামীকাল নতুন কি এডভেঞ্চার অপেক্ষা করছে কে জানে! বন্ধু মাসুমের প্রতি সমবেদনা। আহারে। একা একা কী করবে সে রাতে?




 

                                                                    (৪)


মাসুম

আমি মাসুম। রাস্তায় রাস্তায় হাঁটছি। এলোমেলো হাঁটা। কিছু ভালো লাগছে না। চোর ধরার ব্যাপারে যে উত্তেজনা বোধ করেছিলাম, এখন তা আর নেই। মনে পড়ছে মহিমার কথা। প্রবল কষ্ট আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। মহিমা হারালো, দুটা আইফোন হারালো, টাকা সহ মানিব্যাগ হারাল। এরপরেও আমি কীভাবে প্রায় স্বাভাবিক আছি? অদ্ভুত। 

বন্ধু মুরাদের সাথে হোজ্জা সাহেবের পাল্লায় পড়লাম। একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম। কবির ছেলেটার পরিচয় কী? ভুলেই গেছি জিজ্ঞেস করতে। এ কীভাবে এসে জুটল মুরাদের বাসায়? পরিচয় যাই হোক, ছেলেটা ভালো আছে। পা টিপে দিল। এত আরাম লাগছিল। ১৫ মিনিটের ঘুমে সব ক্লান্তি মনে হয় কেটে গেছে। মহিমার কথা কীভাবে যেন ভুলে গেছিলাম। শোকে জমে গেছি মনে হয়। আজ শোকেরই রাত! 

আমার কান্না পাচ্ছে। ফোন থাকলে এখন কী করতাম? মহিমার সাথে কথা বলতাম। নাহ! তা হত না। মহিমা এখন অন্য একজনের সাথে কথা বলছে নিশ্চয়ই। কষ্ট, কষ্ট!  জীবনটা এত কষ্টের?

বাবার সাথে হালকা ঝগড়া হয়েছিল, বাসা থেকে বের হয়ে এসেছি সকালে। বাড়িতে ফিরতে পারছি না। এই তথ্য মুরাদকে জানানো হয় নি। সে জানলে জোড় করে আমাকে তার বাসায় রেখে দিত। বা অন্তত কিছুক্ষণ আমার সাথে ঘোরাঘুরি করত। অথবা থানা পর্যন্ত যেত ডায়েরি করে দিতে। এখন একা একা কিছুই ভালো লাগছে না। মোবাইলের আশা বাদ দিলে কেমন হয়? মোবাইল মানেই মহিমার ছবি, ম্যাসেজিং এর স্মৃতি। এখন এগুলো ভুলে থাকা যাচ্ছে।

নিজেকে শূন্য লাগছে। পকেটে একটা টাকাও নেই। কোথায় যাবো? হাঁটতে হাঁটতে অনেকদূর চলে এলাম। রাস্তা ফাঁকা। আধো অন্ধকার। রাত প্রায় বারোটা তো বাজবেই। এলাকার দিকে ফিরতে হবে, কোনো একটা টি স্টলে রাতটা পার করা যায় কি না দেখা যাক। জীবনটা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল আমার।

আমার পেছনে ৪ টা ছায়া দেখতে পাচ্ছি। একসাথে হাঁটছে তারা। ছায়াগুলো কার? তারা দ্রুত হাঁটছে। যেন আমাকে ধরতে চায়। পেছনে ফিরলাম। দেখি– মুখে মাস্ক পেঁচানো চারটা ছেলে।
‘এই ভাই, আপনারা কারা?’
উত্তর পেলাম না। আমি আতঙ্কিত। 

হঠাৎ দুইজন এসে আমার কোমড় আর পা ধরে ফেলল। বাকি দুইজন আমার হাত আর মুখ চেপে ধরেছে। প্রাণপনে চিৎকার করার চেষ্টা করছি। পারছি না। একজন বলল, এই চুপ, চুপ! জানে মাইরা ফালামু একদম।

এখন আমার গলায় ছুড়ি ধরা। তবে মুখ খুলে দিয়েছে। আমার সব পকেট সার্চ করা হচ্ছে। কিছুই পাচ্ছে না তারা। পাওয়ার কথাও না। একজন বলল, ওস্তাদ কিছু নাই। ওস্তাদ লোকটা বলল, কিছু নাই মানে? এই হারামীরে দেখি দুইটা আইফোন পকেটে রাখে সবসময়, মোটা মানিব্যাগ থাকে। অনেক দিন থেকে ফলো করতেছি এরে। বাটে পাই না। আজ পাইছি। এই বল, মোবাইল মানিব্যাগ কই? বল।
‘ভাই, মোবাইল মানিব্যাগ আগেই চুরি হইছে। পকেটমারি হইছে ঘন্টা দুয়েক আগে। বিশ্বাস করেন।’
লোকগুলো বিশ্বাস করল বলে মনে হয় না। চার জোড়া রাগত চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হাত পা শক্ত করে বেঁধে ফেলেছে আমার। নড়তে পারছি না। ওস্তাদ লোকটা হিঁসহিঁস করছে। হঠাৎ একটা থাবড়া খেলাম ভিষণ জোড়ে। আমি মাটিতে এলিয়ে পড়লাম।

এখন কয়টা বাজে? রাত কি পেরিয়েছে? অন্ধকার একটা রুমে আমাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। মুখও বাঁধা। তবে সময় যে অনেক্ষণ গড়িয়েছে তা বুঝতে পারছি। কারণ পেটে ক্ষুধা জানান দিচ্ছে। পিপাসাও পেয়েছে। খুবই ক্লান্তি বোধ করছি। কেউ কি জানে আমাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে?


(চলবে ইন শা আল্লাহ)

Comments

    Please login to post comment. Login