Posts

উপন্যাস

চোখের তারায় জোনাকির আলো (৪র্থ পর্ব)

September 14, 2025

ইহতেমাম ইলাহী

45
View

    

(তৃতীয় পর্বের পর)

                                                         (৪)
      

কয়েকদিনের মধ্যে হাসান সিয়ামের ব্যাপারে খোঁজ খবর বের করে ফেলল। সে যা জানতে পেরেছে, তার অর্ধেক জানলেও আক্কেল গুড়ুম হয়ে যেত । শুধু হাসান কেন? সিয়াম ইতিমধ্যে অনেকেরই  আক্কেল গুড়ুম করে বসেছে । সিয়ামকে গত ১ বছরে অনেক পরিচিত মানুষ টাকা ধার দিয়েছে এবং কয়েক মাসের মধ্যেই তারা নিজেকেই বেআক্কেল বলে গালি দিয়েছে।  সিয়াম হঠাৎ হঠাৎ ম্যসেজ দিয়ে, অতি ভদ্রতার সাথে কুশল জানতে চায়। এরপর বলে অনেক বড় একটা বিপদে পড়েছি, আজকেই ৩ হাজার টাকা লাগবে, ইমার্জেন্সি। হাতে টাকা নাই। এজন্য নক দেয়া। পরশুদিন বা ৩/৪ দিনের ভেতর টাকা আবার ব্যাক দিয়ে দিব। কেউ তার কথা বিশ্বাস করেছে কেউ করে নি। সিয়াম কী বিপদে পড়েছে– জানতে চাইলে সে সবসময় অভিনব কিছু বলেছে। সেই অভিনব কিছুটা যদি ভালো হত, তাহলে তার সৃজনশীল বুদ্ধির প্রশংসা করা যেত। কিন্তু এখন তার বুদ্ধি দেখে ভয় পেতে হবে । সিয়ামের সম্পর্কে মামা হয় এমন একজনকে সে একদিন রাত ১১ টা সময়  বলল, সে ঢাকা এসেছে, কিন্তু মানিব্যাগ চুরি গেছে। ঢাকা এসে তার হাত ফাঁকা। ইমার্জেন্সি দুই হাজার টাকা লাগবে। বিকাশে নাম্বার দিল সে মামাকে এবং বলল  কালকেই দেখা করে টাকা ব্যাক দেয়ার ট্রাই করবে। এই আগামীকাল কয়েকমাসে গিয়ে ঠেকল। সিয়ামের পাত্তা নেই ।  সিয়ামকে এভাবে যেই টাকা দিয়েছে, সেই ঠকেছে। টাকা দেয়ার পরে তার ফোন নাম্বার, মেসেঞ্জার, হোয়াটসএপ সবই আনএভেইলেবল দেখায়। সিয়ামকে টাকা ধার দিয়েছে এরকম পরিচিত মানুষের সংখ্যা প্রায় ১৫-২০ জনের মত হবে। তার বন্ধুবান্ধব সবাই তার উপর ক্ষিপ্ত। হাসান আর তাদেরকে জানায় নি যে, সিয়াম তার বিল্ডিং এই আছে । বললে যে ঝামেলা তৈরি হবে, হঠাৎ সেটা সামলানো সহজ হবে না । সিয়ামের ব্যাপারে আরো খোঁজ করতে হবে। সবকিছু পরিস্কার হোক। এরপরে যা করার করতে হবে। 

হাসানের বন্ধু সালামের বাড়ি সিয়ামের বাড়ির কাছেই। হাসান কল দিল তাকে। 
    ‘আসসালামু আলাইকুম, সালাম।’
    ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম। দোস্ত কেমন আছো?’
    ‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তোমার অসুখ এখন কেমন সালাম? কী যেন সিন্ড্রোম অসুখের   নাম। অদ্ভুত অসুখ!’
    ‘এলিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড সিন্ড্রোম। AIWS.’ 
    ‘আশ্চর্য রোগ, আশ্চর্য নাম! এখনো সবকিছুকে বড় দেখ?’
  ‘বড় দেখাটা কমেছে। খুব বেশি বড় দেখি না। আগে আম গাছকে লাগত বটগাছ। এখন অত বড় দেখি না । তবে, নতুন সমস্যা শুরু হইছে।’
    ‘কী!’
    ‘হা হা। পানিকে মনে হয় খয়েরি রং এর তরল পদার্থ। খেতে ইচ্ছা করে না দেখে।’
    ‘ওহ হো। এখন রং-এ ভুলভাল দেখতেছ?’
  ‘হাসান, কি যে করি। সব খাবারের আলাদা রং দেখি। ভাত কে দেখি হালকা বেগুনী। পানির খয়েরি রং দেখলে রং এর গন্ধ পাই। এই রোগে গন্ধে সমস্যা হয় না। কিন্তু রং দেখে মস্তিষ্ক গন্ধেরও অনুভুতি তৈরি করে মাঝে মাঝে । সবসময় করে না।’
    ‘চোখ বন্ধ করে খাচ্ছ ইদানিং?’
    ‘ঠিক ধরছ। খাওয়া দাওয়া ঠিকমত হয় না, শরীর দূর্বল হয়ে গেছে।’
    ‘আল্লাহ সুস্থ্য করুন। রহম করুন। ডাক্তার কী বলে?’
  ‘ডাক্তার বলছে, ইন শা আল্লাহ ২/৩ বছরের মধ্যে পুরো ঠিক হয়ে যাবে। এই রোগ বয়সের সাথে সাথে সেরে যায়।’
    ‘আলহামদুলিল্লাহ, সেরে গেলেই ভালো। আল্লাহ ভরসা।’
    ‘আল্লাহ ভরসা।’
  ‘তোমার এলাকার খবর কী, সালাম?’
    ‘এইত খবর। কোন খবর জানতে চাচ্ছ?’
    ‘সিয়ামের ব্যাপারে কিছু জানো?’
    ‘আরে সিয়াম! অন্য কারো কথা পেলে না?’
    ‘কেন, কি হইছে?’
  ‘সিয়াম হলো বাড়ি ছাড়া, এলাকা ছাড়া। গতবছর আইপিলের জুয়ায় ৫০/৬০ হাজার টাকার মত হারছিল। সেই টাকা ঋন করে সে পরিশোধ করছে । কিন্তু এই ঋণ আর শোধ করতে পারে নাই। এলাকা থেকে উধাও । ওর বাবা জমি বন্ধক দিয়ে শেষে ঋন শোধ করছে। পাক্কা জুয়াড়ি হয়ে গেছে ছেলেটা। হায়রে সিয়ামের বাবার অবস্থা। আমাদের দেখলে লজ্জায় চেহারা অন্যদিকে ঘুরায় নেয়।’
  ‘ আহারে। শুনছিলাম, পরে ও নাকি তেজগাওয়ে কি চাকরি করছিল ।’
    ‘আরে চাকরি না কী। পুরাই ভাওতাবাজি।’
    ‘হুম। হতে পারে। যা শুনলাম, চাকরি করার ছেলে ও না।’
    ‘হ্যাঁ। মাথা ব্যাথা করে হাসান।’
    ‘মাইগ্রেনের ব্যাথা?’
    ‘ হ্যাঁ।  মাঝে মাঝে গরম পানির বলকের মত বলক দিয়ে উঠে ব্যাথা।’
    ‘আহা।  আল্লাহ সুস্থ্য করুন। আচ্ছা ফোন রাখো।’
    ‘আচ্ছা। কল দিও বন্ধু মাঝে মাঝে। ভালো লাগে।’


 

ফোন রেখে হাসান বসে থাকল কিছুক্ষন। সে ভাবছে, কত মানুষ কত সমস্যা নিয়ে বেঁচে আছে। হাসিমুখে কথা বলছে, কিন্তু তাদের মনের ভেতরে কী কষ্ট জমে আছে তা অন্যকে বুঝতে দিচ্ছে না। বুঝতে দিয়ে কী হবে? আল্লাহ বুঝলেই চলে। সালামের পরিবারের কথাই ধরা যাক। তার বাবা বার্ধক্যজনিত অসুখে ভুগছেন। মায়েরও টিউমার অপারেশন হলো কয়েকমাস আগে। সে নিজে এক অদ্ভুত রোগে ভুগছে। সংসার খরচ টানতে অনেক কষ্ট । ফসলের দাম এই থাকে, এই থাকে না। তার বড় বোনেরা নিজেদের সংসার নিয়েই ব্যাস্ত। বাবার বাড়ি থেকে তারা কিছু নিতে পারে না। জামাই-শ্বশুর সহসা দাওয়াত পায়না বাবার বাড়ি থেকে। দাওয়াত খাওয়ানোর অবস্থা কি তাদের আছে? এতসব লজ্জা ঢাকতে শ্বশুর বাড়িতে তার বোনেরা জানপ্রাণ দিয়ে  খাটছে, সালাম বলেছিল। সালাম যথেষ্ঠ ধৈর্যের সাথে সংসারের হাল টেনে নিচ্ছে, বাপ-মায়ের দেখাশোনা করছে। অন্যদিকে পাশের বাড়ির সিয়াম মেতে আছে অন্য এক খেলায়। মনে হচ্ছে সে খেলা এখনও থামায় নি। এখন কি খেলা সে খেলছে– হাসান তা জানতে আগ্রহ বোধ করছে । তার বন্ধু সালামের প্রতি একটা করুনা বোধ করে সে। কিন্তু সিয়ামের প্রতিও এক ধরনের করুণা বোধ করছে এখন।  এটা কি ঠিক? হাসান কিছুটা দোটানা নিয়ে ভাবছে। এই করুনার উৎপত্তি কোথা থেকে? যেখান থেকেই হোক, হাসান ভাবছে সিয়াম যদি সালামের মত হয়ে যেত! যার কাজকর্ম হবে স্বচ্ছ কাচের মত। চেহারাও হবে আয়না, সেই আয়নায় স্বচ্ছ অন্তর স্পষ্ট ফুটে উঠবে। 

ভাবনার স্রোত এখন বন্ধ করা দরকার। আজ শুক্রবার। বেলা ১০ টা বেজে গেছে। হাসান তাড়াহুড়ো করে উঠে গেল। জুমার নামাজ পড়তে হবে চানখারপুলের দিকে। হাসানের সবচেয়ে কাছের বন্ধু জহির থাকে সেখানে। বিয়ে করেছে ৪ মাস হবে। সে দুপুরের দাওয়াত দিয়েছে হাসানকে। বন্ধুকে দাওয়াত দিতে পেরে সে খুশি। এজন্য বিয়ে করেও খুশি। কারণ, বউ না থাকলে ভালো কিছু রান্না করা সম্ভব না তার পক্ষে। তাই বিয়ের আগে দাওয়াতও দিতে পারত না । বাসার বাইরে রেস্টুরেন্টে খাওয়ানোকে অন্যরা যত পছন্দ করুক, জহির করে না। সে বলে, দাওয়াতের আমেজ বলে অন্য একটা জিনিস আছে । যা শুধু বাসাবাড়িতে দাওয়াত দিলেই অনুভব করা যায়। দাওয়াত তো শুধু খাওয়া-দাওয়া না। 

দুপুরের খাওয়া শেষে জহির হাসানকে ধরে পড়ল, নিজের লেখা গান শোনাবে। হাসান বলল, গান লিখছিস নাকি?
  ‘কী করব? গাইতে ইচ্ছা করে। হাবিজাবি গান শুনিও না, এজন্য গাইতেও পারি না। ভাবছি নিজে গান লিখে, নিজে গাব। ওয়াইফকে শুনাই। শুনে হাসে। কেমন হয়েছে জিজ্ঞেস করলে বলে, ভালো এবং হাস্যকর। এখন তুই শোন।’
  ‘শোনা।’

জহির যা শোনালো। তার লিখিত রূপ এমন হতে পারে—


অরণ্য স্নাআআআন
বিশ্বাসী প্রাআআআন, 
আহবাআআআআআন
খেতে ডাকছে বহুদূউউউউউর,
এই পথএএএএ
কতদুউউউউর ?


 

আবার

অরণ্য স্নাআআআন

বিশ্বাসী প্রাআআআন, আহবাআআআন

খেতে ডাকছে বহুদুউউউউউউউর

এই পথএএএএএ

কতদূউউউউর ?


 

বহুদূউউউউউউউর

বহুদূউউউউউউউর

শুদ্ধতম হাওয়া, খেতে ডাআআকছে
জোছনা আলো, খেতে ডাআআকছে
এই প্রাহাআআআআন তরপাচ্ছে,
হাহা এই প্রাহাআআআন তরপাচ্ছে

অরণ্য স্নাআআআন

বিশ্বাসী প্রাআআআন…।

হাসান বুঝতে পারছে না, গান শুনে কী মন্তব্য করা উচিত। গান গাওয়ার মধ্যে জহির তার অন্তরের সব অনুভূতি ঢেলে দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। এজন্যই শুনতে ভালো লাগছিল। হাসান বলল, তোকে জোছনা আলো খেতে ডাকছে?
  ‘হ্যাঁ। শুদ্ধতম হাওয়া খেতে ডাকছে।’
  ‘খেতে গিয়েছিলি?’
  ‘একা একা খাওয়া যায় না দোস্ত, এজন্য তোকে ডাকলাম।’ 
  ‘এখন আসল কথা বল, কী হয়েছে।’
  ‘কী হবে?’
  ‘এমনি এমনি তো অরন্য স্নান করতে চাচ্ছিস না, তাই না?’
  ‘স্নান আমি করবই। তবে আগে কাহিনী বলে মন খালি করি।’
  ‘বল।’ 
  ‘দুই লাখ টাকা আনিস ভাইকে দিয়েছিলাম মনে আছে?’
  ‘হ্যাঁ, ইনভেস্ট দিয়েছিলি। কিডস জোন নামে কী একটা শপের শেয়ার কিনেছিলি না কি যেন। ঠিক মনে পড়ছে না।’ 
  ‘আসলে কিছুই না দোস্ত। পুরো টাকাই গাপ করে দিছে। শুধু আমি না, ২৫ জনের টাকা।’
  ‘তুই না বললি, মাসে মাসে প্রফিট দিত?’
  ‘কিছু করে প্রফিট দিয়ে ঠান্ডা রাখছিল শেয়ারহোল্ডারদের। আর কিছু না। ব্যাবসায় বিশাল লস হইছে। ব্যাবসায়ী ভাইকে বললে আনিস ভাইয়ের দোষ দেয়। আনিস ভাইয়ের ফোন অফ ১ সপ্তাহ ধরে। টাকার কোনো খোঁজ নাই। ঠিক মত কোনো ডকুমেন্টও নাই।’
  ‘আনিস ভাইকে দেখলাম হজ এজেন্সি খুলছেন। ওমরা করে আসছেন কিছুদিন আগে।’
    ‘দাড়ি টুপি দেখে মানুষ বিশ্বাস করিস না দোস্ত।’
    ‘তুই কিভাবে করলি?’
    ‘বুয়েটের বড় ভাই। এত পরিচিতি। সেলিব্রেটি মানুষ। একা তো টাকা দিই নাই। আমাদের ব্যাচের আরো ৭ জন দিছে।’
    ‘টাকা ব্যাক পাওয়ার সম্ভাবনা নাই?’
    ‘যারা টাকা দিছে, তারা মিটিং করবে আগামীকাল। আমার ভালো লাগতেছে না মিটিং ফিটিং। যেয়ে বসে থাকব। টাকার আশা ছেড়ে দিছি।’
    ‘আশা ছাড়িস না।’
    ‘আশা রাখতেছিও না। আল্লাহর উপর আশা ভরসা। শুধু বিশ্বাসের উপর টাকা দিছি। এই অবস্থার জন্য আমার কি দোষ নাই?’
    ‘আছে।’
    ‘হাসান, জানিস তো – আমার সঞ্চয় বলতে ঐ টাকাই। এখন বিয়ে করছি কত টাকা খরচ হয় মাসে। আল্লাহ চাইলে সামনের বছরের যদি বাবু হয়, অনেক টাকা লাগবে। টাকা পাবো কোথায়? বাপের কাছে চাইতে লজ্জা লাগে।’
      ‘আল্লাহ ভরসা দোস্ত। আল্লাহ ব্যাবস্থা করে দিবেন ইন শা আল্লাহ। ঐ যে দুই লাখ টাকার কথা বললি, সেই টাকার বরাদ্দ কে করছিল?’
      ‘আল্লাহ।’
    ‘ আল্লাহ কি শুধু ঐ দুই লাখ টাকা দিয়েই তোর প্রয়োজন পূরণ করতে সক্ষম?’
        ‘না।’ 
      ‘তাহলে আল্লাহকে স্মরণ কর। তার কাছে চা, যা চাওয়ার। দুই লাখ টাকার কথা ভুলে থাক আপাতত। আল্লাহ চাইলে ফেরত পাবি ইন শা আল্লাহ।’
      ‘ইন শা আল্লাহ।’
      ‘বাইরে হাঁটতে যাই চল। অরণ্য স্নান করবি যে বললি।’ 
      ‘হুম, চল।’  
      ‘খালি পায়ে হাঁটব। সমস্যা আছে তোর?’
        ‘না চল।’

      ‘Life deserves to be joyful always. আমরা কারো চোখকে কেয়ার করি না। কে কি ভাবল তাতে কিছু আসে যায়?’
      ‘না, যায় না।’
    ‘৪/৫ বছর আগে একবার নতুন স্যান্ডেল পরে ২ ঘন্টা হাঁটছিলাম। পা গেল ছিলে। ঠোসা পড়ে গেল। চেষ্টা করেও আর পায়ে রাখা যায় না স্যান্ডেল। বাসে করে বাসা ফিরব সেই টাকাও নাই। সারা মাসের খাওয়ার জন্য বাজেট ১৪০০ টাকা! ঐ সময়ের কথা।’
    ‘ এরপর! কী করলি?’ 
  ‘খালি পায়ে হেঁটে মেসে ফিরলাম। জুতা হাতে নিয়ে। ওইদিন ছিল শুক্রবার। আমি আসছিলাম চন্দ্রিমা উদ্যানের সামনে দিয়ে। শত মানুষ রাস্তায়। ঘুরতেছে, ফিরতেছে। কেউ কেউ তাকাচ্ছে আমার পায়ের দিকে, এরপর তাকাচ্ছে চেহারার দিকে। ওইদিন এত ভালো লাগার অনুভূতি হইছিল। আগে কখনো হয় নাই। মনে হচ্ছিল, এতদিন মানুষের দৃষ্টির জেলখানায় আটকে ছিলাম। মানুষ কি ভাববে না ভাববে, নিজেকে দেখতে কেমন লাগতেছে, এগুলা বন্দি করে রাখছিল আমাকে।’ 
      ‘ওইদিন পরে কী মনে হলো?’
    ‘মনে হলো পূর্ণ মুক্ত স্বাধীন একজন মানুষ আমি। কে কী ভাবছে এই আড়ষ্টতা মনের ভেতর নাই। শরীরের প্রতিটা নার্ভে আনন্দ ফিল হচ্ছিল।’
      ‘সুবহানাল্লাহ। চল দেখি, আজ সেই ফিল পাই কি না । পুরাতন একটা দেখে পাঞ্জাবি গায়ে দিই? কী বলিস? আজ শুধু শুদ্ধতম হাওয়া খাওয়ার দিন।’
      ‘ হুম, পরে নে।’ 
      
ঘুরতে ফিরতে হাসান আর জহিরের সন্ধ্যা পেরিয়ে গেল। পুরো সময় তারা হাঁটল খালি পায়ে। পা ধুলায় ভরে গেছে। মাগরিবের পর হঠাৎ একজন সুটেড বুটেড ভদ্রলোক তাদের ডাক দিল। তার চোখে কৌতুক আর উৎসুক হাসি।
    ‘এই হুজুর এদিকে আসেন।’
হাসান আর জহির এগিয়ে গেল।
    ‘ কিছু বলবেন?’
    ‘জুতা আপনাদের হাতে কেন?’
    ‘জুতায় গরম লাগছে পায়ে,’ জহির বলল।
    ‘দুজনেরই পায়ে গরম?’
লোকটি দুই বন্ধুকে চারদিকে ঘুরে ফিরে দেখছে। যেন তারা মানুষ না, চিড়িয়াখানার কোনো প্রাণী। 
হাসান বলল, বড় ভাই যাই।
    ‘যান! খালি পায়ে হাঁটার কোনো ফজিলত আছে নাকি হুজুর? হা হা।’
জহির রেগে যাচ্ছে। হাসান তাকে হাতের ইশারায় থামালো। হাসান জানে, মাঝে মাঝে খালি পায়ে হাঁটা সুন্নাত। এতে অহংকার দূর হয়, নিজের মধ্যে সহজতা আসে। কিন্তু এই কথা এখন বলা যাবে না। জহিরের হাত ধরে ফিরে যাচ্ছে সে । 
    ‘এই হুজুর কথা বলেন না? হা হা। ভালোই মজা দেখাচ্ছেন।’

হাসান বুঝছে না এই আধুনিক আঁটসাঁট পোশাক পরিহিত ভদ্রলোকের কেন এত উৎসাহ তাদের নিয়ে। তারা কিছু না বলে হাঁটতে লাগল। জহির বলল, হাসান কিছু বলবি না ওনাকে? হাসান বলল, জহির রাগিস না, রাগলে মুক্তির মজা পাবি না!
    ‘আচ্ছা, নো রাগারাগি । চারদিকে কেমন বাতাস দেখছিস? আকাশে মেঘ নাই।’
    ‘ভালো লাগছে তোর?’
    ‘নিজেকে মুক্ত বিহঙ্গ লাগতেছে দোস্ত।’
    ‘মুক্ত বিহঙ্গ নিয়ে একটা গান লিখে ফেলিস। শুনব পরে।’
    ‘ওকে!’ 

জহির গান নিয়ে ভাবতে চেষ্টা করছে। কিন্তু গানের লাইন আসছে না মাথায়। মাথায় ঘুরছে অন্য কিছু। কে যেন মাথায় ফিসফিস করে শোনাচ্ছে, “Don’t walk in front of me… I may not follow. Don’t walk behind me… I may not lead. Walk beside me… just be my friend.” জহিরের চোখের কোণে পানি জমছে। বাসায় রেখে আসা স্ত্রীর কথা মনে পড়ছে তার । সে হাসানের হাত ধরে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল। দ্রুত হাঁটতে হবে এখন । খুব দ্রুত। 


  
    
    
    


(চলবে ইন শা আল্লাহ)

Comments

    Please login to post comment. Login