নদীর ধারে ছোট্ট এক গ্রাম। গ্রামের নাম বন্দরপুর। চারদিকে সবুজ শস্যক্ষেত, মাঝখানে আঁকাবাঁকা এক নদী বয়ে গেছে। সেই গ্রামেরই এক কিশোর—রাফিন। বয়সে খুব বেশি না, তবে স্বপ্নে আকাশ ছুঁতে চায়। অন্য বাচ্চারা যখন মাঠে দৌড়ঝাঁপ করে, লুকোচুরি খেলে, তখন রাফিন নদীর ধারে বসে কাগজের নৌকা বানায়।
প্রতিটি নৌকায় সে অদ্ভুত কিছু লিখে রাখে। কখনো লিখে—
“আমি একদিন অনেক বড় হবো।”
কখনো লিখে—
“আমার স্বপ্ন সমুদ্র পাড়ি দিক।”
তার নৌকাগুলো ভেসে যায় নদীর স্রোতে। অনেকেই হাসাহাসি করে—
“কাগজের নৌকা দিয়ে আবার কী হবে?”
কিন্তু রাফিন বিশ্বাস করে, প্রতিটি নৌকা তার স্বপ্ন বহন করছে।
একদিন হঠাৎ গ্রামের আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেল। প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলো। নদীর পানি ফুলে-ফেঁপে উঠল, বন্যার মতো পরিস্থিতি তৈরি হলো। গ্রামের মানুষ ছুটোছুটি করতে লাগল। কারও ঘর ভেসে গেল, কারও ধান-পাট নষ্ট হয়ে গেল। সেই ভয়াবহ মুহূর্তে রাফিন খেয়াল করল, গ্রামের বাচ্চাদের স্কুলঘর ভিজে যাচ্ছে। ভেতরে তাদের বই, খাতা সব পানিতে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
সে দৌড়ে গেল স্কুলঘরে। পানির ভেতর দাঁড়িয়ে বইগুলো একে একে টেনে বের করতে লাগল। বইগুলো ভিজে যাচ্ছিল, তখন সে নিজের শিখে নেওয়া কৌশল কাজে লাগাল। কাগজের নৌকা বানানোর যে অভ্যাস, সেই হাতেই সে দ্রুত কাগজ ও পলিথিন মিশিয়ে বড়সড় ভাঁজ বানাতে লাগল। বইগুলো সেগুলোর ভেতরে ভরে নদীর স্রোতের বিপরীতে ভাসিয়ে দিল। আশ্চর্যভাবে বইগুলো নিরাপদে অন্য পাশে ভেসে গেল, যেখানে উঁচু জায়গায় লোকজন দাঁড়িয়ে ছিল।
গ্রামের মানুষ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল—
যে ছেলেকে তারা শুধু খেয়ালি বলে ভাবত, সেই ছেলেই আজ স্কুলের অমূল্য সম্পদ—বইগুলো রক্ষা করল।
ঝড় শেষে গ্রামের প্রবীণরা রাফিনকে ডাকলেন। একজন বললেন—
“বাবা, তোমার সেই কাগজের নৌকাগুলোই আজ আমাদের শেখালো, ছোট জিনিসও বড় কাজে লাগে।”
আরেকজন বললেন—
“তুমি শুধু নিজের স্বপ্ন নয়, আমাদের গ্রামেরও স্বপ্ন বাঁচিয়েছ।”
রাফিন মাথা নিচু করে হাসল। তার চোখে তখনো নতুন নতুন স্বপ্ন ভাসছে। সে বুঝল—
কাগজের নৌকা শুধু খেলার জিনিস নয়, এটা হতে পারে আশা, সাহস আর জ্ঞানের বাহন।
সেদিন থেকে গ্রামের মানুষ আর তাকে হাসাহাসি করেনি। বরং তারা বিশ্বাস করতে শুরু করল—ছোট ছোট স্বপ্নও একদিন গ্রাম, দেশ এমনকি বিশ্বকে বদলে দিতে পারে।