এক সুদর্শন
ঘুম আসছে না?
নাহ! সকাল সকাল বাসের দুলুনিতে অনেক্ষণ ঘুমিয়েছি।
যুহরের পর থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত কিন্তু আর বিশ্রাম নিতে পারবি না। না ঘুমালেও চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাক।
সমস্যা নেই। একটা গল্প শুনবি? যুহরের আরও ঘন্টাখানেক সময় বাকি।
আমরা একটা মাদ্রাসার মেহমানখানায় দুই বন্ধু। দুই বিছানায় দুজন মুখোমুখি শুয়ে আছি। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়। গ্রাম্য এলাকায় ভালোই শীত পড়েছে। শীতের বস্ত্র বিতরণ শুরু হবে যুহরের পর থেকেই। অনেক জায়গায় যেতে হবে। আমার শরীরে ক্লান্তি। কিন্তু বন্ধু জহির মনে হয় একটু ঘুমোতে দেবে না আমাকে। গল্প শোনাবে। অনেক দিন পর দেখা হলো আমাদের। না করতে পারছি না। কিন্তু আমার শরীরে ক্লান্তি। আমি অনাগ্রহের সাথে বললাম, বল তোর গল্প।
জহির গল্প বলা শুরু করল। “জানিস তো? ক্লাস টেনে আমি রংপুরের একটা মেসে থাকতাম?”
হ্যাঁ, জানি।
আমার রুমে আমরা থাকতাম দুজন। আরেকজন ছেলে ছিল পঞ্চগড়ের। সে ছেলেই হলো গল্পের নায়ক ! তার নামটা বলছি না। গীবত হয়ে যাবে। একটা ছদ্মনাম দেয়া যাক। আচ্ছা নাম তুই-ই দে!
হা হা। আচ্ছা, ধরা যাক নাম হলো, আশিক।
আশিক ! হা হা হা…
আমার দেয়া নাম শুনে জহির হাসতে শুরু করল। পুরো শরীর ঝাঁকুনি দিচ্ছে ওর। কি হলো? আমি আশ্চর্য্য হয়ে তাকিয়ে আছি। দেখলাম জহির হাসি সামলাতে না পেরে মুখ চেপে ওপাশ ঘুরল। বললাম, কী হলো ভাই? সে জবাব না দিয়ে কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলিয়ে এপাশ ঘুরল। বলল, নামটা যুতসই হয়েছে। গল্পের সাথে মানানসই। আমি হেসে ফেললাম। বললাম, কীভাবে? জহির বলল, গল্প টা আশিক জিনের!
বুঝলি হাসান, আশিক ছেলেটাকে সুদর্শন বললে কম বলা হবে। এই বয়সেই তার দাড়ি গজিয়েছিল। আমি ক্লাস টেনে পড়ার সময়ের কথা বলছি কিন্তু । সে খোঁচা খোঁচা দাড়ি রাখত। ফর্সা অর্ধগোলাকৃতির চেহারা। পোশাক আশাকের ব্যাপারে তার সূচিবায়ুর মত ছিল। দীর্ঘ সময় ধরে কাপড় ইস্ত্রী করত। অল্প বয়সেই তাকে সুপুরুষ লাগত। কিন্তু সমস্যা কী জানিস ? কমবয়সী ছেলেদের রূপই তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। চরিত্র খারাপ হয়ে যায়। আমি এক বছরে আশিককে ৮ টা মেয়ের সাথে প্রেম শুরু ও ব্রেক আপ করতে দেখেছি…
জহিরের গল্প কোন দিকে যাচ্ছে বুঝতে পারছি না। বিস্তারিত খুঁটিনাটিসহ ঘটনার বর্ণনা জহিরের অদ্ভুত একটা বৈশিষ্ট্য। কিন্তু আজ তাকে সাঁয় দেয়া যাবে না। সময় কম। কিছুক্ষণ হলেও ঘুমাতে হবে। আমি বললাম, জহির মূল গল্পে যা। একটানা বলতে থাক। আমার প্রতিক্রিয়া শোনার অপেক্ষায় থাকার দরকার নাই । জহির বলল, আচ্ছা, আচ্ছা।
গল্প আবার শুরু করল জহির ।
তো, আমার রুমমেট আশিক প্লেবয় টাইপের হয়ে গেছিল। প্রতিটা নতুন প্রেম শুরু করার সময় বলত, জহির, আর না। এটাই আমার শেষ প্রেম। এই মেয়েকেই বিয়ে করব।
কিন্তু আমি জানি আশিক থেমে থাকার ছেলে না। শেষে দেখলাম একসাথে দুইটা প্রেম চালাচ্ছে। তার সাথে থাকা ছিল বিরক্তিকর। সে জানত তার এই স্বভাব আমার ভালো লাগে না। কিন্তু সে আমাকে তার প্রেমের গল্প শোনাবেই। নতুন প্রেমিকার গুন-বৈশিষ্ট্য, কথা বলার স্টাইল, হাঁটার স্টাইল ইত্যাদি। প্রেম করতে করতে আশিক নানান চক্রে জড়িয়ে গেছিল। নানান হাঙ্গামা, অন্য ছেলের সাথে মারামারি পর্যন্ত। যেই মেয়েকে অন্য কোনো ছেলে আগে থেকে পছন্দ করে, সে মেয়ের প্রতি তার আবার বেশি আগ্রহ।
একদিন ফযরের নামাজের প্রস্তুতি নিচ্ছি। রুম অন্ধকার। আলো জ্বালাই নি। আশিক সাধারণত এত সকালে উঠে না। সেদিন মনে হয় জেগেই ছিল। আমাকে হঠাৎ ডাক দিল। বলল, জহির, নামাজে যাবি?
আমি বললাম, হ্যাঁ, চল তুইও চল। জেগেই আছিস।
সে বলল, চাইলেও যেতে পারছি না বন্ধু। আমি বললাম, আচ্ছা।
তো আমি উঠে যাচ্ছিলাম। আশিক হাত ধরে আমাকে বসিয়ে দিল। বলল, শোন। আজ রাতে স্বপ্নে এক পরী আসছিল। আমার সাথে প্রেম করতে চায়।
ফযর ওয়াক্তে আশিকের এই ফাইযলামি আমার ভালো লাগল না। আমি কিছু না বলে উঠে গেলাম। কিন্তু দিনের বেলা সে আমাকে ধরে পড়ল। সে আমাকে বিশ্বাস করাবেই তার পরী প্রেমের কাহিনী। তার ভাষায় সে আজ পর্যন্ত যত মেয়ে দেখেছে তারা এই পরীর নকের সমান সুন্দর না। পরী যখন আসে তখন চারপাশ অদ্ভুত রকম আলোকিত হয়ে যায়।
আমি আশিকের ভুংচুং কথায় কান দিলাম না।
একদিন রাতে। রাত বারোটা হবে। আমি ঘুমাই নি। আশিক বলল, এই যে ও চলে আসছে। আমি বললাম, কে? আশিক বলল, পরী। ওর নাম মেহের। আমি বললাম, ফালতু কথা বন্ধ কর।
আমি খুব বিরক্ত হচ্ছিলাম। ভাবছিলাম সামনের মাসেই এই রুম ছেড়ে অন্য রুমে উঠব। আশিকের সাথে এক রুমে আর থাকব না। মাসের আর ১০ দিন বাকি।
দিন পাঁচেক পর হবে হয়ত, আশিক বলল, তুই বিশ্বাস করছিস না আমার কথা ? আজ বিশ্বাস করতেই হবে। রাত প্রায় ১২ টা। রুম অন্ধকার। আশিক অন্য চৌকিতে। আমি আমার বিছানায়। আশিক এটা সেটা বলছে আমাকে । এর মধ্যেই আমার মাথায় কে যেন একটা থাবরা দিল। আশিক হেসে উঠল। বললাম, এই মধ্যরাতে দুষ্টুমি না করলে হয় না আশিক? আশিক বলল, এক কাজ কর। আমার দুই হাত চেপে ধরে থাক।
আশিক এগিয়ে এল। আমি ওর দুই হাত ধরে থাকলাম। এবং কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে মাথায় আবার থাবরা খেলাম। থাবরার জোড় বেশি ছিল না। কিন্তু আমার শরীর ঝিম ঝিম করতে লাগল। ভয়ের স্রোত শরীরে বয়ে গেল। আমি আশিকের হাত ছেড়ে দিলাম। আশিক হা হা করে হাসছিল। আমি উঠে সুইচবোর্ডের দিকে আগালাম। আলো জ্বালাবো। আশিক বলল, না না। আলো জ্বালাবি না। সে হিঁস হিঁস করে উঠল। কিন্তু আমার এত ভয় আর অস্থির লাগছিল যে, বাতি জ্বালাতেই হত। বাতি জ্বালালাম। ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম। না, রুমে অন্য কেউ নেই। আশিক বলল, তুই একটা ফালতু। ও আজ রাতে আর আসবে না। চলে গেছে।
সারারাত বাতি জ্বালিয়ে ঘুমালাম সেদিন।
এরপরে আমি গ্রামের বাড়ি চলে গেলাম।
কয়েকদিন পরে ফিরে এলে সে রাতেই ঘটনাটা ঘটল। রাত তিনটা পার হয়ে গেছে। হঠাৎ চাপা আওয়াজ পেয়ে জেগে উঠলাম। আশিককে ডাকলাম। তার বিছানা থেকে গোঙ্গানির মত আওয়াজ আসছে। লাফ দিয়ে বিছানা থেকে উঠে বাতি জ্বালালাম। যা দেখলাম সেটা কখনোই কাঙ্ক্ষিত ছিল না। আশিক বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে। তার নাক দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। চেহারা লাল হয়ে আছে। স্পষ্ট মারের দাগ। পা ফুলে আছে। ঠোঁট কেটে গেছে। আশিকের চোখ দিয়ে পানি ঝড়ছে। এত রাতে কী করব বুঝতে পারছিলাম না। ওকে ধরে আধশোয়া করে দিলাম। শরীরে হাত লেগে মনে হয় সে ব্যাথা পেল। ব্যাথায় ককিয়ে উঠল। পানি খাওয়ালাম তাকে।
সকালে ওকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছিল রাতে? আশিক বলল, হাঁটু পর্যন্ত লুঙ্গি পরা এক বিশাল লোক আমার বুকের উপরে এসে বসল। আমি ছিলাম আধো ঘুমে। ঘুমের মধ্যে দেখছি। পরে দেখলাম লোকটা আমার উপরে না, একটা বড় পাথরের উপরে বসে আছে। এরপর কথা নাই বার্তা নাই আমাকে শুরু করল মার। তার পরে তো জানিস কী অবস্থা হল আমার।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন মারল তোকে? আশিক বলল, রাতে যখন মেহের চলে যাচ্ছিল, ঘরের পাশে আরও কয়েকটা জিন দেখলাম। বিশাল লম্বা। মোটাসোটা। চেহারা অবশ্য মানুষদেরই মত। তবে আবছা। স্পষ্ট কিছু না। একজন আমাকে বলছিল, মেহেরের সাথে সম্পর্ক না রাখতে। সে নাকি মেহেরের ভাই। মেহের হাসছিল। আমাকে বলল, ওর কথা পাত্তা দিও না। বলেই সে চলে গেল। আমি ঘুমিয়ে গেলাম। এরপরে তো এক বুড়ো এসে মেরে টেরে গেল। বুড়ো মনে হয় মেহেরের বাবা । আমার ধারণা।
আমি আশিককে বললাম, আশিক যা হওয়ার হইছে। তুই এখন পরী প্রেম ছাড়! আশিক অসুস্থ্য শরীর নিয়েও হাসল। সেই হাসির অর্থ আমি বুঝতে পারলাম না।
কিছুদিন পর আশিকের অসুস্থ্যতা বেড়ে গেল । তাকে দেখলেই মনে হয় সে একটা ঘোরের মধ্যে আছে। প্রতি রাতে দুঃস্বপ্ন দেখতে লাগল। হাঁটু পর্যন্ত লুঙ্গি পরা বৃদ্ধ তাকে কোথায় যেন নিয়ে যায় । হঠাৎ একদিন দেখল রংপুরের একটা রাস্তা। ঐ রাস্তার আশেপাশে সে ঘোরাফেরা করত বেশি। একটা বকুল গাছ সেখানে। বৃদ্ধ বলল, এখানে আমরা থাকি। হঠাৎ দেখল যন্তুর মত চেহারার একটা মেয়ে। বৃদ্ধ বলল, এটা মেহের! আশিকের স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল। এরপর প্রতি রাতে নানান দুঃস্বপ্ন দেখতে লাগল সে। মানসিক ভাবে প্রায় অসুস্থ্য হয়ে গেল।
আমি ওকে মসজিদের ইমাম সাহেবের কাছে নিয়ে গেলাম। ইমাম সাহেব তাকে পবিত্র থাকতে বললেন সবসময় । গান না শুনতে, আর মেয়েদের ব্যাপারে কিছু না ভাবতে। তাদের সাথে সম্পর্ক না রাখতে। ইমাম সাহেবের ভাষায়– তিনি কিছু কেইস দেখেছেন যেগুলোতে, ঐ ছেলেরাই মহিলা জিন দ্বারা আক্রান্ত হয়, যারা মেয়েদের ব্যাপারে খুব বেশি লালায়িত থাকে।
আসলে ইমাম সাহেবের কথাই ঠিক। আশিক সারাক্ষণ হেডফোনে গান শুনত। ইমাম সাহেব বলেছিলেন, গান শুনলে মানুষের অন্তর খুব এলোমেলো, দুর্বল হয়ে যায়। এই অবস্থায় জিনরা সহজে শিকার করতে পারে। তিনি আরও বললেন, পরী বলতে আসলে কিছু নেই। মহিলা জিনকে সাহিত্যে পরী বলা হয়। এবং তাদেরকে অতি রূপবতি ধরা হয়। কিন্তু বাস্তবে তা না। জিনরা মানুষের মত না। অতি সুন্দরও না। তারা অন্য প্রানীদের মত এক ধরণের প্রানী। হতে পারে তাদের শিং থাকে। পায়ে খুড় থাকে। তবে জিনরা যেহেতু অন্যদের রূপ ধারণ করতে পারে, এজন্য সুন্দরী কোনো মহিলার রুপ ধরতে পারে। কোনো জিনকে তাদের আসল রুপে কখনোই দেখা সম্ভব না। ইত্যাদি ইত্যাদি।
ইমাম সাহেবের কথায় আশিকের মধ্যে পরিবর্তন কিছু হয়েছিল। সে আমার সাথে নামাজে যেত। গান শোনা ছাড়তে পারে নি। কিন্তু অনেক কমিয়ে দিয়েছিল। আলহামদুলিল্লাহ।
জহির একটা বড় নিঃশ্বাস ছাড়ল । বলল, গল্প শেষ।
মনে হয় গল্পটা বলতে পেরে ওর ভালো লাগছে।
আমি বললাম, ভালোই গল্প!
সে বলল, এখন ঘুমা । সময় আছে।
আমি বললাম, যা গল্প শোনালি, এখন তো ঘুমাতে ইচ্ছা করছে না!
তো, কী করবি?
আমি সত্যিকারের একটা কাহিনী বলি তাহলে তোকে! জিনের গল্পই বলা চলে।
জহির আমার গল্প শুনতে রাজি হয়ে গেল। আমি শুরু করলাম।
গল্পের প্রধান চরিত্র একজন তরুনী। বুঝেছিস? জহির বলল, বুঝলাম।
আচ্ছা।
তরুনী মেয়েটি বিয়ের উপযুক্ত বয়সে পৌঁছালে তার পরিবার তার জন্য উপযুক্ত পাত্র খুঁজতে লাগল। একটি পরিবারে মেয়ের বিয়ে নিয়ে দুই ধরণের অনুভূতি বিরাজ করে। মেয়েকে ভালো পাত্রস্থ করার আনন্দ। অপরদিকে মেয়ে বাড়ি থেকে চলে যাবে– এই বিরহ বেদনা। কিন্তু এই দুই অনুভূতির সাথে তরুনীটির পরিবারে আরেক ধরণের অনুভূতি যুক্ত হয়েছিল । কারণ মেয়েটির মধ্যে হঠাৎ অসংলগ্নতা দেখা যায় । দিন দিন রোগা হয়ে পড়ছিল সে । রাতে ঘুম থেকে কখনো কখনো আতঙ্কিত হয়ে জেগে উঠে। চিৎকার করে। বিড়বিড় করে। কয়েকদিন পরে দেখা গেল মেয়েটি এখন হাসছে পরেই আবার কাঁদছে । সবার ধারণা হলো জিনের আছর। আর ঐ বাড়ি আর বাড়ির আশপাশের বাঁশঝাড়ে জিনের উৎপাত নিয়ে সবাই জানত কম বেশি । তরুনীটির বাবা ছিলেন একজন আলেম। তিনি নিজেই দুআ কালাম পড়ে মেয়ের চিকিৎসা শুরু করলেন। এভাবেই দিন যাচ্ছিল। কিন্তু মেয়ের অবস্থার উন্নতি হচ্ছিল না। একদিন মেয়ে তার বড় বোনকে বলল, সে নিয়মিত দুঃস্বপ্ন দেখছে। স্বপ্নে এক জিন বৃদ্ধ এসে বলেছে, সে এই এলাকার জিনের প্রধান। সে চায় তার জিন পুত্রের সাথে তাকে বিয়ে দিতে। অন্য কারও সাথে সে বিয়ে হতে দেবে না।
মেয়ের স্বপ্নের কথা শুনে বাড়ির মহিলা মহলে কান্নার রোল পড়ে গেল।
ইতিমধ্যেই একটা ভালো সম্মন্ধ এলো। মেয়েকে অসুস্থ্য অবস্থাতেও পছন্দ করল তারা। এরপর থেকেই মেয়ের অসুখ আরও বেড়ে গেল। সম্মন্ধ আগালো না। মেয়ে এখনই স্বাভাবিক তো এখনই অচেতন। থেকে থেকে চিৎকার করে উঠছে।
একদিন ইশার ওয়াক্তের পরের ঘটনা। মেয়েটা গুরুতর অসুস্থ্য । অচেতন। তার মাথায় পানি ঢালা হচ্ছে। হঠাৎ জ্ঞান ফিরে মেয়ে চিৎকার করে উঠল। বলল, আমাকে নিয়ে যেতে চায়, আমাকে নিয়ে যেতে চায়। পরিবারের সবাই তাকে ঘিরে ধরে দাঁড়িয়ে ছিল । হঠাৎ ঘরের পাশের বাঁশঝাড় প্রচন্ড ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। প্রচন্ড দুলুনি শুরু করল বাঁশঝাড়ের মাথা। মেয়েটি সেদিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল। সাথে সাথে অচেতন হয়ে গেল। সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। আতঙ্কে মেয়ের এক খালাত বোনও অচেতন হয়ে পড়ে গেল।
সত্যিই পরিবারটি দূর্দশাগ্রস্থ হয়ে পড়েছিল।
পরিবারটির দূরবস্থা প্রায় বছর খানেক স্থায়ী হল। অনেক চিকিৎসা করেও মেয়ে সুস্থ্য হচ্ছিল না। জিন বারবার মেয়েকে সপ্নে বলছে, তাদের সাথেই সম্পর্ক করতে হবে। এবং তারা ভালো জিন। ইমানদার। নামাজ কালাম পড়ে।
মেয়েটির পরিবারের আত্মীয়স্বজন নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে শুরু করল যে, জিনের সাথেই মেয়ের বিয়ে দেয়া উচিৎ কি না।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত মেয়ের বাবা এই সিদ্ধান্ত নাকচ করে দিলেন। বললেন তার মেয়েকে যেভাবে হোক ভালো ছেলে খুঁজে বিয়ে দেবেন। বিয়ে দিলেই জিনের এসব সমস্যা চলে যাবে। ইন শা আল্লাহ।
নতুন গতিতে পাত্র খোঁজা শুরু হল। আল্লাহর রহমতে কয়েকমাসের মধ্যে মেয়ের বিয়েও হয়ে গেল। সবাই খুবই আনন্দিত ছিল। নতুন এই দম্পতীর জন্য দুআ করছিল । চেহারা, সুরতে তেমন না হলেও তরুনীটির স্বামী ছিল চমৎকার একজন মানুষ। সবার সাথে তার আচরণ ছিল অত্যন্ত দিলখোলা।
দিন গড়ায় । থেকে থেকে মেয়েটির জিন জনিত সমস্যাও দেখা দেয় মাঝে মাঝে । কিন্তু তার স্বামীর পরিবার খুব একটা প্রতিক্রিয়া দেখায় নি। মেয়েটির পরিবারও ছিল কৃতজ্ঞ। কিন্তু সমস্যা হলো– মেয়েটি তার স্বামী, শ্বাশুরীর সাথে ভালো আচরণ করত না। জিনের সমস্যাটা কমে যাচ্ছিল দিন দিন । কিন্তু স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক দিন দিন খারাপ হতে থাকে। বছর ঘুরতেই তাদের একটা কন্যা সন্তান হয় এবং এর মাস ছ’য়েকের মধ্যেই তালাক হয়ে যায়। বলা যায় মেয়ের উদ্যোগেই তালাক। মেয়েটি তালাকের দিন কোর্টে স্বামীর প্রতি অত্যন্ত উগ্র আচরণ করল। মেয়ে পক্ষের অনেকেও আফসোস করল ব্যাপারটা নিয়ে। যদিও মেয়ের আচরণ অন্য সবার সাথে অত্যন্ত ভালো। কিন্তু সে শুধু স্বামীকে দেখতে পারে না। সবাই জিনের আছরের ব্যাপারটি নিয়ে খুবি উদ্বিগ্ন হলো। কীভাবে দুষ্ট জিন একটা সংসার ভেঙ্গে দিল। কত খারাপ হতে পারে তারা!
জহির বলল, গল্প শেষ? আমি বললাম, না। কিছুটা বাকি আছে। আমি শোয়া থেকে আধশোয়া হলাম। জহির আরও গুটিয়ে গেল বিছানায়। গল্প আবার শুরু করলাম।
বুঝলি জহির? মেয়েটার ডিভোর্সের ২ বছর পর তার জন্য একটা বিয়ের প্রস্তাব আসে নতুন করে। মেয়ের পরিবার রাজি হল না, যদিও রাজি হওয়া উচিত ছিল, কারণ তাদের মেয়ে ডিভোর্সি। প্রস্তাবের ছেলেটির বাবা ছিল প্রান্তিক পর্যায়ের একজন দরিদ্র মানুষ। ছেলেও তখন অনার্স পাশ করে অল্প বেতনের একটা চাকরী করছে কেবল । অন্যদিকে মেয়ের ফ্যামিলি অনেক ধনী ও সমাজে সুপরিচিত ছিল। সামাজিক মর্যাদায় আকাশ পাতাল পার্থক্য। কিন্তু সবাইকে আশ্চর্য্য করে দিয়ে, মেয়েটি বিয়েতে রাজি হয়ে গেল। মেয়েকে ধরে পড়ল বাড়ির সবাই। কাহিনী কী? সে জানাল, ছেলেটির সাথে সে একসাথে পড়ত। দুজন দুজনকে পছন্দ করত। এখন যেহেতু প্রস্তাব এসেছে তাই বিয়ে করতে চায়। মেয়েটি সম্মন্ধটা এগিয়ে নেয়ার জন্য জিদ করতে শুরু করল। অবশেষে পরিবার মেনে নিল। পরিবারের কেউই তেমন উৎফুল্ল না হলেও মেয়েটি ছিল বেশ আনন্দিত। কিছুদিন পরে ছোট আয়োজনে তাদের বিয়ে হয়ে গেল। মেয়েটির নতুন স্বামী ছিল বেশ ফর্সা, সুদর্শন। এরপরে তাদের দাম্পত্য জীবন ভালোই চলছে বলে জানি। সুখের সংসার। আগের ঘরের সন্তানটিকে মেয়েটির নতুন স্বামী নিজের মেয়ের মতই দেখেন বলে শুনেছি। আল্লাহ তাদের ভালো করুন।
জহির বিছানায় উঠে বসল। বলল, হাসান।
হুম, বল।
তুই কি বলতে চাচ্ছিস যে, মেয়েটি আগে থেকেই তার দ্বিতীয় স্বামীকে অনেক পছন্দ করত। কিন্তু পরিবারে বলতে পারছিল না। যেহেতু ছেলেটির পরিবার দরিদ্র । ছেলের বয়স কম। কিছু করে না। তো মেয়েটি যা করল তা হলো, জিনে ধরা রোগীর অভিনয়? যেন তার বিয়ে কয়েক বছরের জন্য বন্ধ থাকে? তাই না? বল।
জহিরের কন্ঠে বেশ উত্তেজনা। সে স্থীর চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি পাত্তা দিলাম না। বললাম, আমি তো সেরকম কিছু বলি নি, জহির!
হা হা হা।
জহির হাসছে। বলল, শুধু শুধু জিনের গল্প বলার ছেলে তুই না, হাসান ।
আমি বললাম, আসলে মেয়েটির অভিনয়ের সম্ভবনা অস্বীকার করা যায় না। তবে, ঘটনাটা পূনরায় পর্যবেক্ষণ আর বিশ্লেষনের সুযোগও নেই। তাই হলফ করে কিছু বলা যায় না। তবে বাস্তবে এরকম অভিনয়ের ঘটনা কিন্তু মাঝে মধ্যেই শোনা যায় ।