Posts

গল্প

তরুন অভিনেতা

September 16, 2025

ইহতেমাম ইলাহী

45
View

      


 

রাকিব বহুদিন ধরে টিভি নাটকে অভিনয় করার জন্য সুযোগ খুঁজছে। এর ওর কাছে ধরণা দিচ্ছে। সুযোগ পাচ্ছে না। এই ছোটাছুটিতে নিজের অভিনয় প্রাকটিসে সময় দিতে পারছে না ঠিক মত। এখন যে নাটকগুলোতে অভিনয় করছে সেগুলো ইউটিউব চ্যানেলে দেখানো হবে। তার হাতে কাজ দুটি। কিন্তু এই কাজগুলোতেও তার পারফর্ম মনমত হচ্ছে না। আর স্বভাবতই তার অভিনয় কারও নজর কাড়ছে না। আধাখেচড়া কাজ কার ভালো লাগে? রাকিব ভাবছে সে আজ একটা সিদ্ধান্ত নেবে। সরল অঙ্কের মত একটা যা তা ক্যারিয়ারে সে তৃপ্ত নয়। 

একসময় রাকিবের ক্যারিয়ার এদিকে ছিল না। সে ছিল আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্র। তার মায়ের ইচ্ছা ছিল সে মাদ্রাসার শিক্ষক হবে। সেও সেরকমই ভেবেছিল। কিন্তু তার বন্ধু মঞ্জু একদিন বলল, একটা মঞ্চনাটক করবে। ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে। তাকে একটা পার্ট নিতে হবে। রাকিব বলল, ধুর, এসব আমার দ্বারা হবে না। কিন্তু মঞ্জু নাছোড়বান্দা। শেষ পর্যন্ত মঞ্জুর জোড়াজুড়িতে সে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর এক রাগী কমান্ডারের পার্টে অভিনয় করল। তার অভিনয় এত চমৎকার  ও প্রাণবন্ত হলো যে দর্শকসারিতে হাততালির বন্যা বয়ে গেল। নাটক শেষে মঞ্জু বলল, আরে ব্যাটা! তুই তো জাত অভিনেতা রে! এই লাইনে আগায় যা। 

সেই থেকে শুরু। রাকিবকে কী নেশাতে যেন পেয়ে বসেছে। সে মায়ের ম্লান মুখ, ধর্মীয় বাঁধা নিষেধ সব উপেক্ষা করে নাটক, সিনেমা, অভিনয় নিয়ে পড়ে থাকল বেশ কয়েক বছর। কিন্তু আশানুরূপ সাড়া পেল না। টিভি নাটকে সুযোগ পাচ্ছেই না কোনোভাবে। তার চেহারা খারাপ না, হাইটও ভালো। সে মঞ্জুর সাথে দেখা করল একদিন। পুরোনো বন্ধু বলে কথা। হতাশা ডিপ্রেশনের সময়টা তার সাথে কাটালে ভালো লাগবে। রাকিব মঞ্জুকে বলল, বল তো কী করি দোস্ত?

মঞ্জু বলল, শোন রাকিব। এর কাছে ওর কাছে দৌড়ানো বাদ দে। প্রাকটিসে সময় বাড়িয়ে দে। অভিনয় দিয়ে মাতিয়ে দে সবাইকে। নাটক, সিনেমাতে এমনিই ডাক পাবি একদিন। 

রাকিব মঞ্জুর কথা খুব ইতিবাচক ভাবে গ্রহণ করল সেদিন।ঙ্কথার যুক্তি আছে!

রাকিবের হাতের একটা নাটকের কাজ প্রায় শেষ। আরেকটা শুরু হবে। ১০ পর্বের নাটক। থ্রিলার, আন্ডারগ্রাউন্ড গ্যাং কালচার, প্রেম ইত্যাদি থিম মিলিয়ে নাটক টা। রাকিবের পার্ট হলো একটা গ্যাং এর আদর্শিক গুরুর। এই গুরু মধ্যবয়স্ক। মাঠে কোনো কাজ করে না। কিন্তু আড়াল থেকে সুতা টানে। তার জীবনযাপণ অদ্ভুত। আধা-শয়তান প্রকৃতির মানুষ। তার আচরণ এমন যে তাকে বিশ্বাসও করা যায় না, আবার অবিশ্বাসও করা যায় না। আন্ডারগ্রাউন্ডের মেম্বাররা তাকে দেখতেও পারে না, আবার ফেলতেও পারে না । চরিত্র টা আধিভৌতিক। স্ক্রিপ্ট পড়ে রাকিব হাসছে–  এই চরিত্র কোথায় পেল এই স্ক্রিপ্ট রাইটার! 

রাত বারোটা। ঘুমোলে চলবে না। রাকিবের হাতে পুরো নাটকের সিকুয়েন্স, ডায়ালগ সব রেডি করা। পরিচালক বলেছে, প্রয়োজনে ডায়ালগে কিছু হেরফের করে নিতে পারে নিজের মত। পরে তাকে দেখিয়ে নিলেই হবে। 

চরিত্রটার আসল নাম নাটকে আড়াল থাকবে। কারণ চরিত্র নিজের আসল পরিচয় আড়াল রাখতে চায়। ছদ্মনামেই তাকে চিনবে সবাই। ছদ্মনাম হলো গুরুজি। গুরুজি একটা বিল্ডিং এর আন্ডারগ্রাউন্ডের চেম্বারে বাস করে। এখানেই সবাই তার সাথে সাক্ষাত করে। সে বসে থাকে একটা নিচু আসনে। দুই পায়ের একটা বেশ উঁচু করে রাখে। সামনের দিকে ঝুঁকে থাকে। তার চেম্বারে অধিকাংশ সময়েই আলো-আঁধারি থাকে। পূর্ন আলো জ্বালানো হয় না। 
এত ডিটেইলস লিখা স্ক্রিপ্টে! বাপরে বাপ– রাকিব ভাবে। সে পরিচালককে কল দিল।

    হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম। বস। 
    হ্যাঁ, হ্যাঁ। রাকিব। বলো। কী বলবে বলো।
    স্ক্রিপ্ট পড়ছি বস। এত ডিটেইলস এই ক্যারেক্টার টা! আমারেই দিলেন এটা!
  আরে মিয়া, তোমার মধ্যে জিনিস আছে। অন্য কেউ পারবে না এই ক্যারেক্টার। প্রাকটিস করো! সবাইরে চমকায় দেও। 

রাকিব হাসে। পরিচালকের প্রশংসা তার ভালো লাগে। রাকিব শোয়া থেকে উত্তেজনায় উঠে বসে বিছানায়। প্রাকটিস করতে হবে, প্রাকটিস!      


 

গুরুজির ক্যারেক্টারের খুব গুরুত্বপূর্ন একটা অংশ হলো তার আধিভৌতিক হাসি। এই হাসি সে মাঝে মাঝে হাসে না। কথার ফাঁকে ফাঁকে হাসে। হাসির অর্থ কী– তা বোঝা যায় না। 

রাকিব রাত ৩ টা পর্যন্ত হাসি প্রাকটিস করল। আয়না দেখে দেখে। হাসিটা হতে হবে ভয়ঙ্কর আবার কিছুটা মিষ্টি । রাকিব ঠিকমত হাসিটা আনতে পারছে না। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো– নাটকে এই হাসি অনেক হাসতে হবে। গুরুজি ক্যারেক্টার যতক্ষন প্লে হবে, ততক্ষণই আলাপচারিতার মাঝে মাঝে হাসি আসবে। অর্থাৎ হাসিটা রাকিবেরও আয়ত্ব করে অভ্যাসের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। খুব কঠিন কাজ। শরীর ক্লান্তিতে ভেঙ্গে যাচ্ছে, কিন্তু রাকিবের চোখে ঘুম নেই। সে হাসি প্রাকটিস করেই যাচ্ছে। রাকিব ল্যাপটপ খুলল। নেটে অনেক ভিলেনের হাসির ছবি দেখতে হবে। দেখে দেখে এক্সপ্রেশন নিয়ে আসতে হবে নিজের মধ্যে। 

রাকিব ঘুমাতে গেল ফযর আযান হওয়ার পর পর। আযানের পরে তার ঘুম আসতে লাগল। ঘুম তাকে কাবু করে ফেলল। নাহলে তার ঘুমাতেই ইচ্ছে করছিল না আজ। 

পরদিন বিকেল। রাকিব ঘরের মধ্যেই। পরিচালক কল দিয়েছে। রাকিব ব্যাস্ত হয়ে কল ধরল। 
  রাকিব! প্রাকটিস কেমন চলছে?
  দিনরাত চলছে বস!
  সুখবর আছে!
  কী সুখবর বস?
  টিভিতে যাবে আমাদের নাটক! এক পার্টির সাথে কথা হলো!
  What! 
  Yes! মন দিয়ে কাজ করো। 

উত্তেজনায় রাকিব প্রাকটিসে মনোযোগ দিতে পারছে না ঠিকমত। তার অভিনয় টিভিতে যাবে! এই প্রথম সে তার স্বপ্নের পথে একটা মাইলফলক স্পর্শ করবে! রাকিব মাথার পেছনে হাতের দুই হাত রেখে বিছানায় আছড়ে পড়ল। তার চোখে মুখে ভীষন আনন্দ। কয়েকদিন হলো সে ঘরেই অবস্থান করছে। দিন রাত প্রাকটিস। তার কষ্টের ফল তাহলে এবার পেতে যাচ্ছে সে!                                                                               

গুরুজি হাঁটে কিছুটা এলোমেলো ভাবে। এবরোথেবড়ো ভাবে। একটা সিকুয়েন্সে এরকম– এক পার্টি তার সাথে পার্সেন্টেজ ডিল করতে আসে। খুবই সাহস দেখিয়ে কথা বলে। গুরুজি অত্যন্ত ভদ্রভাবে মাথা দোলায়। পার্টি ভাবে যে, তারা গুরুজিকে প্যাঁচে কাবু করে ফেলেছে । এরপর হঠাত গুরুজি প্রায় লাফ দিয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। এলোমেলো ভাবে হাঁটতে থাকে। মদের গ্লাসে মদ ঢেলে এক চুমুক দিয়ে শব্দ করে গ্লাস টেবিলে রেখে দেয়। এরপর ঘার বাঁকিয়ে অন্যদের দিকে তাকিয়ে তার হাসিটা দেয়। গুরুজির হাসি থামে না। হাসতেই থাকে। হাসতেই থাকে। এরপর এলোমেলোভাবে আবার তার আসনের দিকে হেঁটে যায়। বসে পড়ে। আবার আগের ভদ্র চেহারায় ফিরে আসে। পার্টির ডিল মেনে নেয়। এই অদ্ভুত দৃশ্য দেখে পার্টির লোকেরা অস্বস্তিতে ভোগে। গুরুজির আধভৌতিক আচরণে তারা কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। তারা গুরুজিকে ঠিক বুঝতে পারে না। একজন বলে, ব্যাটা শয়তান নাকি। বলে সে চেম্বার থেকে বেড়িয়ে যায়। 

রাকিব এই সিকুয়েন্সটা আজ প্রাকটিস করছে। ভালো হচ্ছে না। এলোমেলো হাঁটাটা বেশ ভালোই হচ্ছে। কিন্তু হাসিটা তেমন হচ্ছে না। পার্টির সেই লোকের শয়তান শব্দটা মনে করে রাকিব ভাবল এক কাজ করলে কেমন হয়? একটা শয়তান কীভাবে হাসে এটা কল্পনা করতে হবে। ধ্যানের মত। এরপর মগজের মধ্যে একটা ছবি এঁকে নিয়ে সেই হাসি নিজের চেহারায় নিয়ে আসতে হবে। বুদ্ধিটা ভালোই মনে হলো রাকিবের। 

রাকিব বিছানায় বসে ধ্যান করছে। শয়তান কীভাবে হাসতে পারে, এই কল্পনা। সে চোখ বন্ধ করে আছে। ভাবছে, ভাবছে। প্রায় ১৫ মিনিট হলো সে বসে আছে। হঠাত সে হেসে উঠল। হাসিটা অদ্ভুত শোনালো। সে আয়নার সামনে দাঁড়াল। হাসল। এবার তার মনে হচ্ছে, হাসিটার মান  (accuracy) ৭০% হয়েছে। সে খুশি হলো। আর কিছুদিন চেষ্টা করলে নিশ্চয়ই ১০০% হবে। 

রাকিব আজও ফযরের আজানের পরে ঘুমাতে গেল। ঘুম থেকে উঠল ৩ ঘন্টা পর। হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। অথচ আরও ঘুমানো দরকার। ঘুমের মধ্যে মনে হয়েছে তার শরীর অবশ হয়ে পড়ে ছিল শুধু। তার ব্রেইন ঘুমায় নি। ব্রেইনে হাসির রিহার্সেল চলেছে। সে ঘুমের মধ্যে কল্পনার গুরুজিকে দেখতেও পেয়েছে। এটা নিশ্চয়ই তার মনের খেয়াল। 

রাকিব উঠে দাড়িয়েই আয়নার সামনে গেল। হাসিটা দেয়ার চেষ্টা করল। হাসি দিয়েই সে আঁতকে উঠল।  এবার তার হাসিকে ১০০% মার্ক না দেয়া গেলেও ৯৫% তো দেয়া যায়! এক রাতের ব্যাবধানে এত উন্নতি, সে ভাবতেই পারে নি! 

রাকিব গেল পরিচালকের সাথে দেখা করতে। উদ্দেশ্য হলো গুরুজি ক্যারেক্টারের কিছু অংশ অভিনয় করে দেখানো। পরিচালকের মতামত নেয়া। বিশেষ করে হাসিটা দেখাতে চায় রাকিব। 


রাত সারে বারোটার দিকে পরিচালক জিতু বসের সময় হলো। রাকিব তার চেম্বারে যেতেই সে বলল, সময় নেই। প্লে কর।
রাকিব একটা সিকুয়েন্স প্লে করল। 

জিতু বসকে দেখে মনে হলো তিনি রাকিবের অভিনয়ে সন্তুষ্ট হন নি। রাকিব বলল, বস, মার্কিং করেন। 


পরিচালক জিতু রাকিবকে এভারেজ ৫০% মার্ক দিলেন। বললেন, হাসিতে ডার্ক (dark) ব্যাপারটা আনতে পারো নি। আরো কাজ করো। 
রাকিব জিজ্ঞেস করল, ডার্ক বলতে কী বোঝাচ্ছেন, বস? 
  ক্রূরতা বোঝাচ্ছি। সিরিয়াল কিলারের মধ্যে যেমন ক্রূরতা থাকে সে লেভেলের। ক্রূরতার সাথে আরেকটা বিষয় আনতে হবে। 
    কী?
    negligence . negligence মানে দুনিয়ার হাল চাল সব কিছু সম্পর্কে চূড়ান্ত অবহেলা প্রদর্শন। অর্থাৎ মানুষের জীবন কাঠামো, সমাজকাঠামো, নীতি নৈতিকতা, দুঃখ-কষ্ট, অনুভূতি ইত্যাদির কোনো মূল্য ক্যারেক্টারের কাছে নাই। এক ধরণের ঔদ্ধত্য।  এটা তার চেহারায় ফুটে উঠবে। হাসিতে মিশে থাকবে। 

রাকিব আরো বেশি বেশি প্রাকটিস ও গভীরভাবে ক্যারেকটার ধ্যান করার সংকল্প নিয়ে বাসায় ফিরল। তাকে টপ লেভেলের অভিনেতা হতেই হবে। No mercy. 


প্রায় এক মাস পর। রাকিব বসে আছে অন্যান্য অভিনেতাদের সাথে। আজ তাদের   ১০ পর্বের নাটকের বিশাল কর্মযজ্ঞ শেষ। রাকিবের হাতে পেমেন্টের বিশাল অংকের টাকা। সে এতটা প্রত্যাশা করে নি। সেট প্যাক আপ করে সবাই আড্ডায় বসেছে। একজন রাকিবকে বলল, এই যে মিস্টার ডেভিল। অভিনয় তো যা করলা, ১০০ এর মধ্যে ১১০ পাবা। সবাই হেসে উঠল। একজন রাকিবের পিঠ চাপড়ে দিল। রাকিবও  হাসল। কিন্তু…

রাকিব চেয়েছিল নিজের সাধারণ হাসিটা হাসতে। অথচ সেটা হয়ে গেল গুরুজি দ্যা ডেভিলের হাসি! সে কিছুটা আশ্চর্য্য হল। তার হাসি দেখে অন্য সবাই হেসে উঠল। কেউ কেউ হাত তালি দিল।  
একজন মহিলা অভিনেতা বলল, রাকিব তুমি আমার বাসায় যেয়ো। আমার বাচ্চাটা অনেক দুষ্ট! তাকে তোমার হাসি দেখিয়ে ভয় পাওয়াতে হবে! কী যাবা? ভালো পেমেন্ট দিব, হা হা। 
রাকিব হেসে ফেলল। এবারও সবাই গুরুজির হাসিই দেখল রাকিবের চেহারায়। কেউ কেউ ফিরতি হাসি দিল। কেউ কেউ থমকে গেল। বাদল ভাই বলল, রাকিব তুমি মনে হয় ক্যারেকটারের মধ্যে অনেক বেশি ঢুকে গেছ। কিছুদিন স্বাভাবিক লাইফ লিড করার চেষ্টা করো। এরপরের নাটকে নিশ্চয়ই ডেভিলের ক্যারেক্টার প্লে করতে হবে না! হা হা। 

সবাই হাসল। হাসারই কথা। সবাই পার্টি মোডে আছে। রাকিব তাকালো পরিচালকের দিলে। তার ঠোঁটেও লুকোনো হাসি। 



কয়েকদিন কেটে গেল। রাকিবের মনে হচ্ছে, কোথাও সমস্যা হয়েছে। কারণ সে  স্বাভাবিক হতে পারছে না। সে সময়ে অসময়ে হাসছে। কথার  মাঝে মাঝে হাসিটা আসছে। রাকিবের মনে হচ্ছে নিজের উপর তার নিয়ন্ত্রণ নেই। হাসিটা অনিচ্ছাকৃত আসছে। এবং সে তার স্বাভাবিক হাসি হাসতে পারছে না। গুরুজির হাসি হাসছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে রাতে। চোখে ঘুম আসে না তার । ফযরের আযানের পর পর কিছুটা ঘুম আসে। রাতে ইচ্ছা করলেও সে ঘুমাতে পারছে না। অনেক ক্লান্তি নিয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করলে একটু পরেই ঘুম চলে যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করলেই তার চিন্তায় গুরুজির ক্যারক্টার চলে আসছে। সেই গুরুজি নাটকের কাহিনীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না, নতুন নতুন সিকুয়েন্সে কল্পনায় আসছে। ঘুমের মধ্যে রাকিবের মাথায় গুরুজি তার অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছে। 

অনেকদিনের ঘুমহীনতা রাকিবের অস্বাভাবিকতা আরো বাড়িয়ে দিল। সে বেশ অসুস্থ্য বোধ করতে লাগল। 

সপ্তাহ দুয়েক চেষ্টা করার পরেও রাকিব স্বাভাবিক হতে পারল না। ডাবল ঘুমের ওষুধ খেলেও তার ঘুম হয় না। যে দুই আড়াই ঘন্টা সে ঘুমায় সেটাকে ঘুম বলা চলে না। শরীর অবশ হয়ে পড়ে থাকে শুধু। আর মস্তিষ্ক গুরুজিকে নিয়ে নানান সিচুয়েশন তৈরি করতে থাকে। রাকিব খেয়াল করল তার বাস্তব জীবনেও সে গুরুজির মত আচরণ করছে। এবং সেটা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত ভাবে। তার মনে হচ্ছে, গুরুজি নামক চরিত্র তার উপর ভর করে আছে। তার থেকে সে নিজেকে ছড়িয়ে নিতে পারছে না। 

দিন গড়ায় আর রাকিবের মানসিক অশান্তি তীব্র হতে থাকে । গুরুজি তাকে পেয়ে বসেছে। তার মনে হচ্ছে দিনরাত সে গুরুজির ক্যারেক্টার প্লে করছে। রাতে কল্পনায় গুরুজি, স্বপ্নেও গুরুজির বিভিন্ন বৈচিত্রময় রূপ দেখছে সে। সে যেন সত্যি সত্যি নাটকেরই গুরুজি হয়ে উঠছে বাস্তব জীবনে। রাকিব গুরুজি থেকে মুক্তি খুঁজছে। সে কোনোকিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছে না। তার মনে হচ্ছে এভাবে চলতে থাকলে সে পাগল হয়ে যাবে। ইতোমধ্যেই তো আধাপাগল হয়েই গেছে বলতে গেলে। 

রাকিব একজন সাইক্রিয়াটিস্ট এর সাথে এপয়েন্টমেন্ট নিল ।  ভদ্রলোক তার কথা আদোপান্ত শুনলেন । এরপর বললেন, আপনার সম্ভবত Pseudobulbar Affect (PBA) হতে পারে। অর্থাৎ নিজের উপর নিয়ন্ত্রণহীনতা। 
ডাক্তার কিছু ওষুধ দিয়ে দিলেন। বিশ্রাম নিতে বললেন। এক সপ্তাহ পরে আসতে বললেন। 

রাকিব আজ গেল গুলশানের একটা রেস্টুরেন্টে। বাকা ভাই তাকে ডেকেছে । বাকা ভাই রাকিবের একজন গুরু। অভিনয় জগতের গুরু।

রাকিব আর বাক ভাই বসে আছে একটা টেবিলের দু’পাশে। বাকা ভাই বলল, রাকিব, এইসব ছোটখাট ঝামেলা অভিনয় জগতে হয়। এসবকে পাত্তা দেয়া ঠিক না। একসময় এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। 

বাক্কা ভাই পরামর্শ দিল drink করতে। বলল, লাল পানি খেয়ে ঘুম দে, রাকিব। জোরসে ঠিক হয়ে যাবি। হা হা। 

রাকিব লাল পানি খেল। তার নিজেকে লাগছে আধাপাগল। একটা ঘোর এসে গেছে। পা গুলো মনে হচ্ছে আড়ষ্ট। হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এই হাঁটার মধ্যে এক ধরণের আনন্দ আছে। রাকিব ক্রমাগত এগিয়ে যাচ্ছে পরিচালক জিতু বসের অফিসের দিকে । সেখান থেকেই সে বাসায় ফিরবে। সে হাঁটছে এলোমেলো ভাবে। তার মাথায় খেলা করছে গুরুজি। গুরুজি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে এলোমেলো ভাবে। মাঝে মাঝে হেসে উঠছে। রাকিব খেয়াল করল, সে হাসছে। বারবার হাসছে। মনে হচ্ছে সেই গুরুজি। গুরুজি দ্যা ডেভিল। 

। রাত প্রায় ১ টা। অভিনয় লাইনে রাত ১ টা কিছুই না। বলা যায় রাতের প্রথমভাগ। জিতু বসের চেম্বারে আরো কয়েকজন ছিল। রাকিবকে কয়েকজন জিজ্ঞেস করল, এই অবস্থা কেন? রাকিবের হয়ে উত্তর দিল জিতু বস।  রাকিবের অবস্থা শুনে চেম্বারের কেউ কেউ সহানুভূতি দেখাল। কিন্তু জিতু বসের চেহারা কেমন হাসি হাসি। বলল, আরে ঠিক হয়ে যাবা, সমস্যা নাই।  রাকিব মাথা ঝাকালো। জিতু বস রাকিবের দিকে হাতের আঙ্গুল দিয়ে একটা সাইন দেখালো । সাইন দেখেই রাকিবের চোখ কেমন জ্বলে উঠল। ভেতর থেকে কে যেন হেসে উঠল। সেই হাসি রাকিবের চেহারায় প্রকাশিত হল। রাকিব হেসেই যাচ্ছে, সে যেন অনেক উত্তেজিত। কিন্তু এটা রাকিব না। রাকিবের ভেতরে থাকা গুরুজি। গুরুজি দ্যা ডেভিল। রাকিব ওরফে গুরুজি দ্যা ডেভিল! হাসছে সে !  রাকিবের দিকে তাকিয়ে পরিচালক জিতুও হেসে যাচ্ছে।  দুদিকে দুজনের হাসির মধ্যে কোথায় যেন একটা মিল। অদ্ভুত এক মিল। চেম্বারের অন্যরা আগ্রহ নিয়ে সেই হাসি দেখছে। 





 

Comments

    Please login to post comment. Login

  • Jishan Mahmud 2 months ago

    ভাই আমাকে লাইক দাও আমার ছবিগুলো দেখো