নেপালে গেল সপ্তাহের জেন-জি রেভ্যুলেশনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সুশীলা কার্কি। মিজ কার্কি মাত্র তিনজনের মন্ত্রীসভা নিয়ে কাজ শুরু করে আগামী মার্চের ৫ তারিখে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছেন। আন্দোলনকারীরা দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী-আমলাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা, সহিংসতায় রাষ্ট্রীয় বলপ্রয়োগে অনুপুঙ্খ তদন্ত করা ও নিহতদের শহিদের মর্যাদা দেয়াসহ বেশকিছু দাবি দাওয়া জানিয়ে ঘরে ফিরে গেছেন। নেপালও ধীরে ধীরে শান্ত হচ্ছে। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে গণ-অভ্যুত্থান শেষে বহু আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজন করেও এখনো দেশটাকে স্থিতিশীল করা যায়নি। বেপরোয়া মবোক্রিসিও নিয়ন্ত্রণে আসেনি।
বাংলাদেশে আন্দোলন হয়েছে শেখ হাসিনা সরকারের দুর্নীতি, গণতন্ত্র হরণ, বিরুদ্ধমত দমন এবং ভুল রাজনৈতিক বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে। আ.লীগ একদিকে মুক্তিযুদ্ধের নিজস্ব বয়ান দিতে দিতে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে দমন-পীড়ন করে মজলুমের তকমা দিয়েছে। অপরদিকে ভিতরে ভিতরে নিজেরাই স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে। সেই মানুষেরা সময় বুঝে আ.লীগের সিধ কেটেছে। সাথে বিএনপিকে দুর্মর শক্তি দিয়ে রাজনীতি থেকে সরিয়ে দিতে গিয়ে নিজেরাই দলবলসহ ভারতে গিয়ে আঁছড়ে পড়েছে। কোমর ভাঙা আ.লীগ খুব সহসাই সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে -এটা ওরা নিজেরাও বিশ্বাস করে না। শুধু শরীরে হারলে টোটকা-দাওয়াই সেটা মেরামত করতে পারে, মগজ ও শরীরে যুগপৎভাবে হারলে ওই হার থেকে সহসাই নিস্তার মেলে না।
গণমাধ্যমগুলো বলছে, নেপালি ‘নেপো কিডদের’ বিলাসী জীবনও ছিল জেন-জি বিক্ষোভের মূলে। ওই যে বাংলাদেশে এনবিআর সদস্য দুর্নীতিবাজ মতিউর রহমানের ছেলের লাখ টাকার ছাগলের কীর্তি যেমন আমরা দেখেছি।
এনডিটিভির খবর থেকে জানা যাচ্ছে, নেপালের ওই অস্থিরতার কেন্দ্রে ছিল দীর্ঘদিনের ক্ষোভ। যেখানে সাধারণ নেপালি জনগণ বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি আর চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়ছে, সেখানে রাজনৈতিক নেতাদের সন্তানরা বা তথাকথিত ‘নেপো কিডরা’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিলাসবহুল গাড়ি, দামি হ্যান্ডব্যাগ আর আন্তর্জাতিক ভ্রমণ প্রদর্শন করছে।
টিকটক, ইনস্টাগ্রাম, রেডিট ও এক্সে ভাইরাল হয়েছে এমন ভিডিও ও পোস্ট যেখানে এই সন্তানদের বিলাসবহুল জীবনধারা সাধারণ নেপালিদের দুঃসহ জীবনযাত্রার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। ‘পলিটিশিয়ান্স নেপো বেবি নেপাল’ ও ‘নেপো বেবিস’ হ্যাশট্যাগ মিলিয়ন ভিউ পেয়েছে।
জানা যাচ্ছে, নেপালের সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিরোধ খাঁতিওয়াড়ার মেয়ে ও প্রাক্তন মিস নেপাল শৃঙ্খলা খাঁতিওয়াড়া এ প্রজন্মের ক্ষোভের প্রতীক হয়ে উঠেছেন। তার ভ্রমণ ও বিলাসী জীবনধারার ছবি ভাইরাল হলে আন্দোলনকারীরা তার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবার পুত্রবধূ জনপ্রিয় গায়িকা শিভানা শ্রেষ্ঠা প্রায়ই সামাজিক মাধ্যমে বিলাসবহুল বাড়িঘর ও ফ্যাশন প্রদর্শন করেন।
তিনি ও তার স্বামী জয়বীর সিং দেউবা আন্দোলনকারীদের নিশানায় পড়েছেন।
এ ছাড়া প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী পুষ্পকমল দাহাল প্রচণ্ডর নাতনি স্মিতা দাহাল এবং আইনমন্ত্রী বিন্দু কুমার ঠাকুরের ছেলে সৌগত ঠাকুরও সামাজিক মাধ্যমে আলোচনায় এসেছেন তাদের আড়ম্বরপূর্ণ জীবনধারার কারণে।
আন্দোলনকারীরা স্লোগান তুলেছে, ‘সাধারণ মানুষ দারিদ্র্যে মারা যাচ্ছে, আর এই নেপো কিডরা লাখ টাকার পোশাক পরে ঘুরে বেড়ায়।’
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের র্যাঙ্কিং অনুযায়ী, নেপালও বাংলাদেশের মতো এশিয়ার অন্যতম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ। নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংসদীয় তদন্তে পোখারা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ প্রকল্পে অন্তত ৭ কোটি ১০ লাখ ডলার আত্মসাতের প্রমাণ মিলেছে।
বুঝাই যাচ্ছে, একদিকে লাখো মানুষের বেকারত্ব, অপরদিকে বিলিয়ন ডলারের দুর্নীতি এবং দুর্নীতির বরপুত্র এবং তাদের স্বজন ও কিডদের বেপরোয়া বিলাসী জীবনযাপন সাধারণ মানুষের সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল।
মানুষ যদি সর্বোচ্চ সততা, শ্রম ও নৈতিকতা মেইনটেইন করে বিত্ত ও প্রভাবশালী হয় -সেটি নিয়ে কারো মাথাব্যাথা থাকে না। কিন্তু ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের তহবিল তছরুপ করে বড়লোকগিরি দেখানোর প্রবণতা রাষ্ট্রের মালিকেরা আর হজম করবে না। এই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও নেপালের গণমানুষের উপলব্ধি একেবারেই রেললাইনের মতো সমান্তরাল।
নেপোকিডদের বাবারা যেভাবে অপদস্থ হয়েছেন -সেটি সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে সবাই দেখেছে। সেসব বেদনায়ক দৃশ্য দেখে আমাদের বিডিকিডরা শিক্ষা নিতে পারে। দেশের সুবিধাবঞ্চিত আম পাবলিক কখন কোন ছুতোয় ক্ষেপে যায় -কেউ বলতে পারবে না। আর গণমানুষ ক্ষেপলে মহাশক্তিধরকে বাঁচাতে সামরিক হেলিকপ্টারও হয়ত সবসময় কাজে দেবে না।
নেপালে যা ঘটল, তা আমাদের সামনে একটি সাবধানবাণী হিসেবে উপস্থিত। বিডিকিড ও তাদের মন্ত্রী-এমপি পিতা -যারা নিজেদের সুবিধা দেখিয়ে সামাজিক মিডিয়ায় অহংকার করবেন -তাদের মনে রাখা দরকার, জনগণের অনুভূতিতে আঘাত করা কোনো বেসামাল প্রদর্শনী কিংবা ক্ষমতার অপব্যবহার আর অসহনীয় বিলাসিতা জনগণের ক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারে। আর যখন গণরোষ সঙ্কটপূর্ণ মাত্রায় পৌঁছায়, তখন শাসকশ্রেণীকে বাঁচাতে সামরিক সরঞ্জামের ওপর নির্ভর করাও একমাত্র পথ হয়ত থাকবে না।
আজকের প্রেক্ষাপটে যা প্রয়োজন -তা হলো আত্মসমালোচনা, দায়বদ্ধতা ও নৈতিক পুনর্গঠনের অঙ্গীকার। ক্ষমতায় থাকা কেউ যদি নিজে থেকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার পথ গ্রহণ করে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয় এবং জনগণের কষ্ট লাঘবে নীতি নির্ধারণ করে -তাহলেই কেবল সুফল মিলতে পারে। নেপাল ও বাংলাদেশ -দুই দেশের জনতার ক্ষোভের মুল উৎস একই: সুযোগের অসম বণ্টন, আত্মস্বার্থনিমগ্নদের অবাধ সুবিধা এবং দায়িত্বশীলতার অভাব। এই ঘুর্ণিপাক থেকে বেরোনোর একমাত্র রাস্তা হলো শাসনব্যবস্থায় জবাবদিহিতা স্থাপন করা; না হলে ইতিহাসের তিক্ত পাঠে ক্ষিপ্ত জনতাই শেষ কথা বলবে।
নেপাল আমাদেরকে বুঝিয়ে দেয় -ক্ষমতা ও অর্থের লোভে জর্জরিত শাসকগোষ্ঠীকে এখনই হুঁশিয়ার হওয়া দরকার। নিজের অভিশপ্ত জীবন আর দেশের সম্মান, দুটির মধ্যে যে কোনো একটিকে বেছে নিতে না পারলে, জনরোষের সামনে বেঁচে থাকা সবার জন্যই কঠিন হয়ে উঠবে। এই হুঁশিয়ারিটি যদি দেশের শাসনব্যবস্থা গ্রাহ্য করে, তবেই কেবল এই সমাজটা শান্তি, সাম্য ও ন্যায়ের পথে পুনরায় দাঁড়াতে পারবে।
কী সেকাল আর একাল -ক্ষমতা ও অর্থের লোভে জর্জরিত আধিপত্যবাদি দূরাচার শাসক ও তাদের সভাসদদের সাবধান হওয়ার সময় এসেছে। গণরোষে নিজের জন্মভূমি থেকে চরম অবমাননা ও অসম্মানের বোঝা মাথায় নিয়ে যেনতেনভাবে পালিয়ে বাঁচার চেয়ে নিজের অভিশপ্ত জীবন বিসর্জন দিয়ে ফেলা সভ্যতা ও শুভবোধের জন্য ঢের মঙ্গলজনক।
লেখক: সাংবাদিক
১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫