Posts

উপন্যাস

প্রিয় ফুল

September 16, 2025

Hamza

49
View

পর্ব ১ –

ধ্বনি পরিবারের বাড়িটা যেনো ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি। পুরোনো লাল দালান, সামনে কদমগাছ, চারপাশে আমের বাগান। ভোরবেলা উঠোনে শিউলি আর বেলির ফুল পড়ে থাকে ছড়ানো। এই পরিবারেই বড় হয়েছে হামজা খান—একটি মাত্র ছেলে, যাকে ঘিরেই মা-বাবার সব স্বপ্ন।

হামজা উনিশ বছরের এক তরুণ। বইপাগল, চুপচাপ, কিন্তু মন ভরপুর স্বপ্নে ভরা। তার বন্ধুমহল আছে, হাসি-আড্ডাও আছে, তবু ভেতরে যেন সবসময় এক অদৃশ্য অভাব। হয়তো কারণ, সে একমাত্র সন্তান। তার চারপাশে মা-বাবা, চাচা-চাচি, আর দুজন চাচাতো বোন থাকলেও এক সঙ্গীর শূন্যতা তাকে সবসময় তাড়া করে।

এই শূন্যতার মাঝেই একদিন অচেতনভাবে জন্ম নেয় ভালোবাসা।

চাচির আপন বোনের মেয়ে—মাহদিবা মেঘ। মেঘ বয়সে সমান, পড়াশোনাতেও একই কলেজে। কিন্তু মনের দিক থেকে যেন একেবারে ভিন্ন গ্রহের মানুষ। তার হাসিতে একরকম নির্লিপ্ততা, চোখে অদ্ভুত এক গভীরতা। মেঘ কখনো জোরে কথা বলে না, আবার পুরোপুরি নীরবও থাকে না। সবসময় মনে হয়, সে যেনো কোনো অদৃশ্য আবরণের আড়ালে লুকিয়ে আছে।

হামজা প্রথম থেকেই তাকে আলাদা চোখে দেখতো। বইয়ের পাতায় যত গল্প পড়েছে, যত নায়িকা কল্পনা করেছে—সব মিলিয়ে তার চোখে একটাই অবয়ব দাঁড়িয়েছে—মাহদিবা মেঘ। কিন্তু প্রকাশ্যে সে কখনো বলেনি, শুধু মনে মনে তাকে নাম দিয়েছে—“প্রিয় ফুল।”

একদিন বিকেলে উঠোনে বসে হামজা পড়ছিল রবীন্দ্রনাথের কবিতা। হঠাৎ পাশের জানালা দিয়ে মেঘ এসে দাঁড়ালো। চুলে হালকা বাতাস লেগে এলোমেলো হয়ে গেছে, চোখে যেনো অজস্র প্রশ্ন। হামজা বই বন্ধ করে তাকিয়ে রইলো। মেঘ এক মুহূর্ত তাকাল, তারপর হেসে বলল—
—কী পড়ছো?
হামজা গলা শুকিয়ে গিয়ে বলল—
—কবিতা।
—কবিতা? তোমার তো পড়াশোনা ছাড়া আর কিছু নেই। একটু খেলাধুলা করতে পারো না?
হাসতে হাসতেই সে চলে গেল।

সেদিন সন্ধ্যায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে হামজা ফিসফিস করে বলেছিল,
“তুমিই তো আমার কবিতা, মেঘ। তুমি-ই আমার প্রিয় ফুল।”

কিন্তু এই ভালোবাসা ছিল একতরফা। মেঘ সব বোঝে, তার চোখে আভাস স্পষ্ট, তবু সে ভান করে অজানা থাকার। কেন? হয়তো পরিবারের ভয়ে, হয়তো ভিন্ন কোনো কারণে। হামজার বুকের ভেতর প্রশ্ন জমে ওঠে, কিন্তু সে কখনো জিজ্ঞেস করে না।

দিনের পর দিন কেটে যায়। উঠোনে খেলা করে চাচাতো বোনেরা, রান্নাঘরে হাসি-আড্ডা জমে, কিন্তু হামজার ভেতরে কেবলই জন্ম নিতে থাকে এক গোপন আকাঙ্ক্ষা। প্রতিদিন সে ভাবে—
“মেঘ কি একদিন সত্যিই বুঝবে, কতটা ভালোবাসি আমি তাকে?”

কলেজে প্রতিদিন সকালে হামজা আর মেঘ একসঙ্গে যেত। একই গেটে প্রবেশ, একই করিডোর দিয়ে হাঁটা—সবকিছুতেই চারপাশের বন্ধুরা ভাবতো তারা বুঝি অনেক কাছের। কিন্তু আসল সত্যটা ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। হামজা যতটা চুপচাপ থেকে মেঘকে দেখতো, ততটাই মেঘ চেষ্টা করতো না বোঝার ভান করতে।

ক্লাসের সময় মেঘ সামনে বসে পড়তো, আর হামজা এক কোণে। মাঝে মাঝে চোখাচোখি হয়ে যেতো, কিন্তু মেঘ তখন হেসে পাশের বান্ধবীর দিকে তাকাতো। যেন ইচ্ছে করেই এড়িয়ে যেত। হামজার বুকের ভেতর কষ্ট জমতো, তবুও সে কিছু বলতো না।

বাড়িতেও অবস্থা একরকম। চাচা-চাচি আর মেঘের মা-বাবার আড্ডা চলতো প্রায়ই। এমনকি মেঘের বড় ভাই আর বোনও আসতো হামজাদের বাড়িতে। কিন্তু পরিবারিক আনন্দের ভিড়ের মাঝে হামজার একাকিত্ব আরও বেড়ে যেত। সে ভেবেই পেত না—মেঘ এমন আচরণ করছে কেন?

একদিন সন্ধ্যায় সবাই উঠোনে বসে গল্প করছে। আলো-আঁধারিতে লণ্ঠনের ঝাপসা আলোয় হাসাহাসি চলছে। হঠাৎ মেঘের বড় ভাই হাসতে হাসতে বলল—
—মেঘকে এখন থেকেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া উচিত।
সবাই হেসে উঠলো। মেঘ লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করলো। হামজার বুকের ভেতর হঠাৎ কেমন করে উঠলো। মনে হলো কেউ তার ভেতরটা ছিঁড়ে ফেললো।

চুপচাপ উঠে সে বাড়ির পেছনের কুয়ার ধারে গিয়ে দাঁড়ালো। রাতের বাতাসে চারপাশ নির্জন হয়ে আছে। বুক ভরা কষ্ট নিয়ে সে ফিসফিস করে বললো—
“প্রিয় ফুল, তুমি কি কখনও বুঝবে আমি কতটা তোমাকে চাই? অথচ তুমি কেন আমাকে প্রতিবার দূরে সরিয়ে দাও?”

কিন্তু উত্তর মেলে না।

পরের দিন কলেজে আবার একই দৃশ্য। হামজা ক্লাস শেষে মেঘকে বলল—
—তুমি কি এক মিনিট সময় দিতে পারবে?
মেঘ ভুরু কুঁচকে তাকাল, তারপর স্বাভাবিক গলায় বলল—
—আমার তো ব্যস্ততা আছে। অন্য কোনোদিন বলো।
বলে সে হেসে বান্ধবীদের সঙ্গে চলে গেল।

হামজা হতাশ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার ভেতরে বারবার প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল—
“সে কি সত্যিই আমাকে বোঝে না? নাকি বোঝেও না বোঝার ভান করছে?”

এই দোলাচলে দিন কেটে যাচ্ছিল। আর সংঘাত ধীরে ধীরে তীব্র হতে শুরু করলো—হামজার ভেতরে ভালোবাসার আগুন যতটা বাড়ছিল, মেঘ ততটাই দূরে সরে যাচ্ছিল।

চলবে……

Comments

    Please login to post comment. Login