👻 কালো বটগাছের অভিশাপ
১. শুরু
গ্রামের নাম শালবাগান। চারদিক ঘন গাছপালা, মাঝখানে একটা ছোট নদী বয়ে গেছে। গ্রামের এক কোণায় দাঁড়িয়ে আছে শত বছরের পুরনো একটি জমিদার বাড়ি। লোকমুখে শোনা যায়, ওই বাড়ির পাশের কালো বটগাছটা অভিশপ্ত। সূর্যাস্তের পর কেউ ওখান দিয়ে গেলে আর ফিরে আসে না।
রাহাত, শহর থেকে আসা এক তরুণ সাংবাদিক। লোককথা, রহস্য আর অতিপ্রাকৃত ঘটনা নিয়ে রিপোর্ট লিখতে তার খুব শখ। তাই শালবাগানে আসার পর থেকেই সে ঠিক করল, এই জমিদার বাড়ির রহস্য উদঘাটন করবেই।
২. গ্রামের ভয়
একদিন বিকেলে সে চায়ের দোকানে বসে কয়েকজন গ্রামের মানুষের সঙ্গে গল্প করছিল।
- রাহাত: "কাকু, এই বটগাছটাকে নিয়ে এত ভয় কেন? গাছ তো গাছই!"
- বৃদ্ধ লোক: "না বাবা, ওটা গাছ না, ওর ভেতরে অশরীরী থাকে। আমি নিজ চোখে দেখেছি, রাত দুইটায় এক কালো ছায়া নেমে আসে গাছ থেকে।"
- আরেকজন: "দশ বছর আগে হরিদাসের ছেলে সাহস করে গিয়েছিল ওখানে। সকালে তার লাশ নদীর ঘাটে পাওয়া যায়। চোখ দুটো রক্ত লাল, মুখে ভয়ের ছাপ!"
সবাই কাঁপতে কাঁপতে বলছিল, কিন্তু রাহাত মনে মনে হেসে ফেলল। সে ভাবল, “এগুলো শুধু গাঁয়ের মানুষের ভয় আর গল্প। সত্য কিছু নেই।”
৩. জমিদার বাড়ি
রাহাত ঠিক করল রাতে গিয়ে তদন্ত করবে। ক্যামেরা, টর্চ আর নোটবুক নিয়ে সে বের হলো। পূর্ণিমার আলোয় জমিদার বাড়িটা যেন দাঁড়িয়ে আছে এক ভয়ঙ্কর প্রহরীর মতো। জানালার ফাঁক দিয়ে মনে হলো কেউ তাকিয়ে আছে।
সে বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই দরজাটা কড়মড় করে বন্ধ হয়ে গেল। বাতাসে ধুলো আর স্যাঁতসেঁতে গন্ধ। চারপাশে ভাঙা আসবাব, মাকড়সার জাল আর দেওয়ালে অদ্ভুত আঁকিবুঁকি।
হঠাৎই সে দেয়ালে খোদাই করা কিছু শব্দ দেখতে পেল—
"রক্ত ছাড়া মুক্তি নেই…"
তার বুক ধকধক করতে লাগল।
৪. ফিসফিসানি
বাড়ির ভেতরে পা বাড়াতেই হঠাৎ পিছন থেকে মৃদু ফিসফিসানি শোনা গেল।
"কেন এসেছিস…? ফিরে যা…"
- রাহাত: "কে? কে কথা বলছে?"
কোনো উত্তর নেই। শুধু অন্ধকারে কারো হাঁটার শব্দ।
সে সাহস করে সামনে এগোল। হঠাৎ ছাদের দিক থেকে ভেঙে পড়ল একটা জানালা। টর্চ ফেলতেই দেখা গেল, কোণায় দাঁড়িয়ে আছে সাদা পোশাক পরা এক মেয়ে। মুখ ঢাকা চুলে, হাতের আঙুলগুলো অস্বাভাবিক লম্বা।
মেয়েটি মৃদুস্বরে বলল—
"আমাকে বাঁচাও…"
রাহাত হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
৫. গ্রামের ইতিহাস
পরের দিন সকালে রাহাত গ্রামের এক বৃদ্ধ স্কুলশিক্ষক, করিম স্যারের কাছে গেল। সব শুনে করিম স্যার গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।
করিম স্যার: "বাবা, এই জমিদার বাড়ির ইতিহাস তুমি জানো না। জমিদার রঘুনাথ ছিল অত্যাচারী। সে গ্রামের মেয়েদের ধরে এনে অত্যাচার করত। অনেককে হত্যা করেছে। শেষ পর্যন্ত গ্রামের লোকেরা বিদ্রোহ করে, কিন্তু জমিদার অভিশাপ দিয়ে মরে যায়।"
রাহাত: "তাহলে ওই মেয়েটি?"
করিম স্যার: "বলা হয়, জমিদারের এক নির্দোষ কন্যার আত্মা এখনো মুক্তি পায়নি। সে-ই রাতের বেলা ভেসে বেড়ায়।"
রাহাত এবার সত্য জানার আরও দৃঢ় সংকল্প করল।
৬. দ্বিতীয় রাত
সে আবার রাতে গেল। এবার ক্যামেরা অন করে রাখল। হঠাৎ টর্চ নিভে গেল। অন্ধকারে কারো কান্নার শব্দ ভেসে আসতে লাগল।
"আমাকে বাঁচাও…"
আবার সেই মেয়েটি। এবার সে কাছে এসে রাহাতের হাত ধরে ফেলল। হাত বরফের মতো ঠান্ডা।
- মেয়ে: "আমার কবর কালো বটগাছের নিচে। রক্ত ছাড়া আমাকে মুক্তি দেবে না ওরা…"
- রাহাত: "ওরা মানে কারা?"
- মেয়ে: "যারা আমার আত্মাকে বেঁধে রেখেছে… জমিদারের অভিশপ্ত দাসেরা।"
হঠাৎই মাটি কেঁপে উঠল। বটগাছের দিক থেকে ভেসে এলো ভয়ঙ্কর হাসি। কয়েকটা কালো ছায়া এগিয়ে এলো, চোখ লাল, দাঁত বের করা।
৭. লড়াই
ছায়াগুলো রাহাতকে ঘিরে ফেলল। ক্যামেরা কাঁপতে কাঁপতে সব রেকর্ড করছিল। মেয়েটি হঠাৎ তার কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল—
"আমাকে মুক্তি দাও! আমার কবর খুঁড়ো!"
রাহাত মরিয়া হয়ে মাটিতে খুঁড়তে লাগল। মাটির ভেতর থেকে বের হলো একটা পুরনো কাঠের বাক্স। খুলতেই বের হলো জমিদারের রক্তমাখা তরবারি।
ছায়াগুলো আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। রাহাত তরবারি হাতে নিতেই এক অদ্ভুত শক্তি তার শরীরে প্রবাহিত হলো। সে ছায়াগুলোর দিকে তরবারি ঘুরিয়ে দিল। একে একে তারা অদৃশ্য হতে লাগল।
৮. সমাপ্তি
অবশেষে শেষ ছায়াটিও মিলিয়ে গেল। মেয়েটির মুখ থেকে চুল সরে গিয়ে দেখা দিল এক শান্ত সুন্দর মুখ। সে মৃদু হেসে বলল—
"ধন্যবাদ… আমাকে মুক্তি দিলে।"
তারপর সে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল বাতাসে।
রাহাত হাঁপাতে হাঁপাতে বসে পড়ল। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, তার ক্যামেরায় কোনো ভিডিও নেই। সব ফাইল ফাঁকা। যেন কিছুই ঘটেনি।
কিন্তু তার হাতের কাছে তখনো পড়ে আছে সেই রক্তমাখা তরবারি…
শেষ কথা
গ্রামবাসী আজও বলে, রাতে কালো বটগাছের পাশ দিয়ে গেলে হাওয়া কাঁপে। মাঝে মাঝে শোনা যায় মৃদু ফিসফিসানি—
"আমাকে বাঁচাও…"
👉