ভালোবাসা কী শরীফ কখনো তা টের পায়নি। ছোটবেলায় তার মা-বাবার কাছ থেকে সে উপহার পেয়েছে কেবল অবহেলা। পোষা প্রাণীও কখনো তার অনুগত হয়নি। আর প্রেম তো তার কাছে এক অবাস্তব ব্যাপার। পৃথিবীতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে মৃত্যুদূতের স্পর্শে শরীফের চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে। তবে, কষ্টে নয়। এই স্পর্শ যেন তার কাছে ভালোবাসা। আগে কখনো কেউ তাকে চেয়ে স্পর্শ করেনি।
ঘুম ভেঙে যায় শরীফের। তখনো রাতের আঁধার কাটেনি। তার চোখ দুটো শিশির ভেজা ঘাসের মত ভিজে আছে। শরীফ তার বিছানা ছেড়ে উঠে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে একটি সিগারেট জ্বালায়। পকেটে টাকা নেই, তবুও তার দামি সিগারেট খাওয়ার অভ্যাসটি গেলো না।
মাস শেষে হাতে তার কোনো টাকাই বাচে না, বরং তার ধার করেই চলতে হয়। বাসা ভাড়াও জমেছে মাস তিনেকের। মার্লবোরো না খেয়ে যদি গোল্ডলিফও খেতো, হয়তবা দিনে দশ-বিশ টাকা বেঁচে যেত। নাক দিয়ে বের হয়ে আসা সিগারেটের ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে দূরের আকাশে ভোরের আলো দেখতে পায় শরীফ।
“কী অসম্ভব সুন্দর নীলচে আভা”, ভাবতে ভাবতে নীলার কথা মনে পড়ে যায় শরীফের।
নীলার রূপও এমন অবর্ণনীয় সুন্দর। অপার মায়া রয়েছে তার কন্ঠে, তার কথায়। বৃষ্টির আগে বয়ে যাওয়া হালকা শীতল বাতাসে নীলার চুলের দুষ্ট-মিষ্টি খেলা দেখলে শরীফের হৃদয় উত্তেজনায় ভরে ওঠে, একবার ছুঁয়ে দেখতে মন চায় বৈকি। কিন্তু শরীফ জানে এসব ভেবে কোনো লাভ নেই। প্রেম-ভালোবাসার চেয়ে অবাস্তব কিছুর অস্তিত্ব কি রয়েছে এই কঠোর বাস্তব পৃথিবীতে? শরীফ অবাস্তব কিছু ভাবাকেও অন্যায় মনে করে। আর সেই অন্যায় সে নিজে করবে? তাই কি হয়?
এই যেমন তার বন্ধু নোমান- শুধু কাল্পনিক স্বপ্নে ডুবে থাকে। প্রতিদিন ওর সঙ্গে দেখা হলেই সে বিপ্লবের কথা বলে। অবশ্য এই বিপ্লবী আলাপের আগে ঘড়ি ধরে সাত মিনিট নিরবতা পালন করে সে। তার পরেই যত অবাস্তব কথাবার্তার শুরু।

“শোন শরীফ, বিপ্লব ছাড়া এখন আর কোনো গতি নাই।”
“বিপ্লব করবে কে? বাংলাদেশের বামপন্থীরা এখন খালি একদিনের কর্মসূচি পালন করতে পারে।”
“সেইটা তাদের শ্রেণি অবস্থানের জন্য। বামপন্থী কর্মীদের অধিকাংশই পেটি-বুর্জোয়া।”
তারপরই শুরু হয় নোমানের রেফারেন্সিং- কোন বামপন্থী বুদ্ধিজীবী বা নেতা কবে কোথায় কি বলেছিলেন। ছেলেটার মনে রাখার ক্ষমতা বেশ প্রসংশনীয়, প্রতিভাও আছে অনেক। শরীফ আবার এত কিছু মনে রাখতে পারে না। পুরুষ মানুষের টাকার হিসাব মনে না থাকলেও, প্যাকেটে সিগারেটের হিসাব ঠিকই মনে থাকে। শরীফের তাও থাকে না।
মনের অজান্তেই এসব বাস্তব-অবাস্তব চিন্তা করতে করতেই বেলা হয়ে যায়। ঘড়ির কাঁটায় দশটা বাজতেই রুটিন অনুযায়ী কল আসে নোমানের।
“নাস্তার জন্য বের হবি কখন?”
এতক্ষণে শরীফ তার ক্ষুধা টের পায়, “এক্ষুনি।”
“তোর বাসার নিচে দাঁড়িয়ে আমি।”
“কয়েক মিনিটেই নামছি।”
হাত-মুখ ধুয়ে নিচে নামতেই নোমানের দেখা মেলে। তারা দুজন হাঁটতে শুরু করে গলির মুখের সোহাগ হোটেলের উদ্দেশ্যে। বিপ্লব-কথনের আগের সাত মিনিট নিরবতার শুরু হয় নোমানের। তবে, নিরবতা শেষের সময়টা আজ ব্যতিক্রমী। নোমান তার সঙ্গে সবসময়ই একটি চটের ব্যাগ বহন করে। আজ সে তার ব্যাগের দিকে ইশারা করে শরীফকে বলে, “নাস্তা করে তোর বাসায় যাবো।”
নোমান যে আজ আবার পাহাড়ি মদ নিয়ে এসেছে তা বুঝতে শরীফের দেরি হলো না। কী অদ্ভুত এই যুবক! ডারবি সিগারেট, আদিবাসীদের তৈরি মদ আর বিপ্লবের স্বপ্ন দিয়েই পরিপূর্ণ তার জীবন। নাস্তা শেষে চা খেতে খেতেই আবার শুরু হয় বিপ্লবকথন।
“বুঝলি শরীফ, কেবল রাজনৈতিক বিপ্লব নয়, সাংস্কৃতিক বিপ্লবেরও প্রয়োজন। যা মানুষের চিন্তার পরিবর্তন ঘটাবে, চিন্তার বিপ্লব ঘটাবে। মনে আছে, তুই একদিন জিজ্ঞেস করেছিলি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মনে বিপ্লবের চিন্তা সৃষ্টি হবে কীভাবে? রাজনৈতিক বিপ্লবের চিন্তার বীজ বুনতে তাই তাদের চিন্তায় সাংস্কৃতিক বিপ্লব প্রয়োজন। চীনের বিপ্লবী নেতা মাও সেতুং তো তাই করেছিলেন।”
শরীফ আজ আর বিপ্লবকথনে অংশগ্রহণ করে না। ভোরের অগোছালো অবাস্তব চিন্তাগুলো সে এখনো গুছিয়ে উঠতে পারেনি। শরীফের আদর্শগত অবস্থানের জন্য তার প্রয়োজন দ্রুত এসব এলোমেলো চিন্তা গুছিয়ে বাস্তবতায় ফিরে আসা। তাছাড়া, নোমানের অবাস্তব কথাগুলো তার চিন্তাগুলোকে আরো এলোমেলো করে দেয়ার ভীতিও রয়েছে তার মধ্যে।
বাসায় হেঁটে আসতে আসতে নোমান তার বিপ্লবের আলাপ চালিয়ে যায়। শরীফের একবার নোমানকে চিলেকোঠার সেপাইয়ের কথা মনে করিয়ে দিতে ইচ্ছা করে, যেখানে ওসমান আনোয়ারকে বলতে চেয়েও বলেনি- “আবু তালেব গরীব মানুষ, তার দ্বারা বিপ্লব পোষায় না।”
শরীফ তবুও নীরবতাকেই বেছে নেয়। সে জানে কেবল নীরবতাই তার এলোমেলো চিন্তাগুলো গুছিয়ে তুলতে পারবে। এছাড়াও, মানুষের মুক্তির পথ কী? নোমানের মত ছেলেদেরকেই কেবল শহুরে-গ্রামীন সব শ্রেণীর মানুষদের মুক্তির জন্যই কথা বলতে দেখা যায়। বাকি সবাই কেবল নিজেদের চিন্তাতেই নিমগ্ন। শরীফেরও মাঝেমধ্যে মনে হয় বিপ্লবই বোধহয় একমাত্র মুক্তির পথ।
রুমে ঢুকতেই নোমান শরীফের টেবিল থেকে একটি গ্লাস আর সঙ্গে গ্লাস ঢাকার পিরিচটি নিয়ে মাটিতে বসে পড়ে। পাহাড়ি মদের বোতলটি বের করতে করতে সে বলে, “তুই যেহেতু আমার থেকে বেশি বুর্জোয়া, তুই গ্লাসে খাবি, আমি পিরিচে।”
শরীফও এসে মাটিতে বসে। নীরব থেকেই সে নোমানের কথা সঙ্গে সম্মতি জানিয়ে দেয়। মনে মনে শরীফ ও নোমান দুজনই মদ পানের প্রস্তুতি নিতে থাকে। তারা একসঙ্গে পান করলে তা হয়ে ওঠে এক প্রতিযোগিতা। বোতলের মদ শেষ করার এই খেলায় তারা কেউ কারো থেকে কম নয়।
সূর্য যখন পশ্চিমের আকাশে, শরীফ তখন হার মেনে নেয়, “বাকিটুকু খেয়ে ফেল, নোমান। আমার আজ এখানেই শেষ।”
শরীফ স্বেচ্ছায়ই পরাজয় মেনে নেয়। কারণ, শরীফের চিন্তাগুলো তার নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছিল। আর যাই হোক, নিজ আদর্শ-দর্শন থেকে ছিটকে পড়ার মত বড় পরাজয় আর কিছু হয় না। এর চেয়ে মদ পানের প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়া শ্রেয়।
কিন্তু, শরীফের যখন শরীর অসাড় হয়ে আসছে, তখন কেন যেন তার বাবার স্মৃতিগুলো বারবার ফিরে ফিরে আসতে শুরু করলো। ছোটবেলায় তো তাকে তার বাবা স্নেহ করতেন। বাজারে যাওয়ার পথে বাবার আঙুল ধরে পুরো রাস্তা হেঁটে যাওয়ার স্মৃতি এখনো কত তরতাজা। বাবার শরীফকে এক টাকা দামের টফি কিনে দেওয়া এবং মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার চিত্র ভেসে যায় তার কল্পনায়। স্পর্শগুলোও ভোলেনি তার মস্তিস্ক। মার সঙ্গে শরীফের বাবার বুনছিলো না অনেকদিন ধরেই। তবুও, শরীফের জন্য হলেও কি থেকে যেতে পারতেন না তিনি? বাস্তবতা বলে, তিনি পারেননি। তার মানে ছোটবেলার স্নেহ কেবল এক চোখের বালি ছিল?
শরীফের মাও শরীফকে কম স্নেহ করেননি। দিনে স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জনবর্ণ মুখস্থ করানোর জন্য মারলেও, দুপুরে ঘুমানোর সময়ে কপালে মা’র চুমুগুলোর কথা বেশ মনে আছে শরীফের। বাবার ভিন্ন সংসার হলে, মা’র হতে পারবে না কেনো? কিন্তু দ্বিতীয় ঘরে সন্তান হলেই শরীফকে তার ছাড়তে হবে কেন? তার মানে কি সেই চুম্বনগুলোও ছিল অর্থহীন?
শরীফের জীবনের শেষ আশ্রয় ছিল বাড়ির উঠোনে ঘুমিয়ে থাকা খোকা, তার কুকুরছানাটি। সারাদিন খোকার সঙ্গেই কাটতো শরীফের। কেবল খোকাই পারতো তার প্রতি হওয়া সকল অবহেলা ভুলিয়ে রাখতে। পাশের বাড়ির মোকলেস চাচা শরীফকে তিন বেলা যে খাবার দিয়ে যেতেন, সেখান থেকে অধিকাংশই সে দিয়ে দিতো খোকাকে। মানুষ না হয় বিশ্বাসঘাতক, কুকুরের পরিচয়ই তো তার আনুগত্যে। খোকাই বা কেন শরীফকে ছেড়ে মোকলেস চাচার বাড়িতে থাকা শুরু করলো? এক সময়ে শরীফ খোকাকে ডাকলেও আর সাড়া দেয়নি খোকা।
শরীফকে ভালোবাসেনি কেউ। ভালোবাসেনি কি ঈশ্বরও? কী কমতি রয়েছে শরীফে? নাকি ভালোবাসা বলতেই কিছু নেই। ভালোবাসা কী কেবল এক কাল্পনিক বস্তু? অথবা ব্যাখ্যাতীত সুন্দর স্বপ্নের মত কিছু? শরীফের অভিজ্ঞতা তাই বলে। তাই তো তার আদর্শগত অবস্থান প্রেম-ভালোবাসা, বিপ্লব-টিপ্লব সহ অবাস্তব সবকিছুর বিপরীতে। তবুও শরীফের মনে প্রশ্ন জাগে, নীলা কি শরীফকে কখনো ভালোবেসেছে- যদি সত্যিই ভালোবাসা বলতে কিছু থেকে থাকে?
নীলার সঙ্গে শরীফের শেষ দেখা হয়েছিল শিল্পকলা একাডেমিতে। তারা একটি নাটক দেখতে গিয়েছিল। নীলা তার কোনো বান্ধবীকে রাজী করাতে না পেরে শেষমেশ আবদার করেছিল শরীফের কাছে। যদিও শরীফ সেদিন কিছুটা ব্যস্ত ছিল, সে ফিরিয়ে দিতে পারেনি নীলার আবদার।
সেদিন নাটক চলার সময় বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিল। শক্তিশালী সব সংলাপের সঙ্গে শোনা যাচ্ছিল বজ্রপাতের শব্দ। নাটক শেষে বের হতেই শেষ বিকেলের আকাশে রংধনুর দেখা মিলেছিল একাডেমির প্রাঙ্গনে। নীলা তার মিষ্টি-মায়াময় কন্ঠে অনুরোধের সুরে বলেছিল, “আমাকে একটা ছবি তুলে দেবে? আজকের দিনের তোমার সঙ্গের স্মৃতিটি এই ছবিতে ধরে রাখতে চাই।”
“আমার সঙ্গে আবার কিসের স্মৃতি?” নিজের কাছে নিজের প্রশ্নেই ঘোর ভাঙ্গলো শরীফের। এতক্ষণ ধরে তার ঘরের ভাঙা দেয়ালের কোণায় জমে থাকা ঝুলের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলো সে এসব কিছু। নীলা তাকে কখনো ভালোবেসেছে কিনা সেই উত্তর তার জানা নেই। পরক্ষণেই তার উপলব্ধি হয়, নীলা অন্য সবার মত তাকে কখনো অবহেলা করেনি। শরীফের মনে জন্ম নেয় নতুন প্রশ্ন, সে কি ভালোবাসে নীলাকে?
পাশে শুয়ে গুনগুন করে গান গাইতে থাকা তার বন্ধুকে জিজ্ঞেস করে শরীফ, “ভালোবাসার অর্থ কী রে, নোমান?”
“এইসব বুর্জোয়া জিনিসে আমি বিশ্বাস করি না। অর্থহীন এইসব।”
শরীফের দর্শনেও তো ভালোবাসা অর্থহীনই। তবুও, তার দেয়ালের কোণায় জমে থাকা ঝুলগুলো ফুল হয়ে ফুটতে শুরু করে।