কয়েকদিন কেটে গেছে। চাকরির ইন্টারভিউর ব্যর্থতা যেন বুকের ভেতর জমাট বাঁধা কুয়াশার মতো ভারী লাগছে।
বিকেলের দিকে লাইব্রেরির সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। 'শঙ্খনীল কারাগার' বইটি হাতে অচেতনভাবে পাতা উল্টাচ্ছিলাম, মনটা কোথাও নেই। পাতার ভেতরে বন্দিত্বের গন্ধ লেগে ছিল, ঠিক যেমন আমার মন অচল হয়ে আছে।
হঠাৎ কানে এলো পরিচিত কণ্ঠ–
“তুমি এখানে?”
পেছন ফিরে তাকাতেই অবাক হয়ে গেলাম।
সেদিনের নীল শাড়ি আজও পরনে। চোখে আগের মতোই লাজুক হাসি, তবে আজ একটু আলাদা—কোনো অচেনা আভা যেন তার চোখের কোণে।
আমি হেসে উত্তর দিলাম,
“হ্যাঁ… বই খুঁজতে এসেছি। আপনি?”
তাকিয়া বলল,
“আমি মাঝে মাঝে এখানে আসি। ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেলে বই-ই একমাত্র আশ্রয়।”
আমরা দুজনেই লাইব্রেরির সিঁড়িতে বসলাম। আশেপাশে মানুষের কোলাহল থাকলেও, আমাদের আলাপে অদ্ভুত এক নির্জনতা নেমে এলো।
লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে রাস্তায় হেঁটে চলেছি।
ধীরে ধীরে কথা বাড়তে লাগল।
আমি আমার কথা বললাম–
“এই শহরে চাকরি খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। কখনো মনে হয় ভাগ্যটা যেন একেবারেই ফুরিয়ে গেছে।”
তাকিয়া চুপ করে শুনছিল। তারপর হঠাৎ বলল,
“আমারও ভেতরে অনেক গল্প আছে। তবে সবটা কাউকে বলার সাহস পাই না। মানুষ শুধু গল্প শোনে, বোঝে না।”
তার কণ্ঠে ভারী দুঃখের ছাপ।
আমি প্রশ্ন করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সে চোখ নামিয়ে নিল। মনে হলো, কোনো অদৃশ্য দেয়াল আমাদের মাঝে তুলে দিল।

হঠাৎ আকাশ কালো হয়ে এলো। এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস বইতেই টুপটাপ বৃষ্টি নামল। আমরা দৌড়ে পাশের এক পুরনো টঙের চায়ের দোকানে আশ্রয় নিলাম। ঠিক সেই দিনের মুহূর্তের মতো।
গরম চায়ের কাপে ধোঁয়া উঠছে, বাইরে বৃষ্টির পর্দা নেমে আসছে। সেই মুহূর্তটা যেন ল্যাম্পপোস্টের নিচের রাতটার প্রতিচ্ছবি।
আমি তার দিকে তাকিয়ে বললাম,
“অদ্ভুত না? বৃষ্টি যেন বারবার আমাদের সামনে নিয়ে আসে।”
তাকিয়া হেসে ফেলল, উত্তর দিল,
“হয়তো এই শহরের বৃষ্টিই আমাদের চেনে।”
চা শেষ হয়ে এলো। বৃষ্টি থামেনি।
বিদায়ের আগে তাকিয়া হঠাৎ চুপচাপ হয়ে গেল। তারপর নিচু স্বরে বলল,
“তুমি জানো, শহরটা আসলে ছোট না, খুব বড়। আমি চাইলে এই ভিড়ের মাঝে হারিয়েও যেতে পারি।”
আমি অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম।
কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সে দাঁড়িয়ে গেল।
“আজ তবে চলি। আবার কোনোদিন হয়তো একইভাব দেখা হবে।”
সে চলে গেল। বৃষ্টির পর্দার ভেতর তার নীল শাড়ি ঝাপসা হয়ে মিলিয়ে গেল।
আমি চায়ের কাপ হাতে বসে রইলাম। বুকের ভেতরে অদ্ভুত এক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে–
তাকিয়া কী বলতে চাইল?
সে কি সত্যিই হারিয়ে যেতে চায়? নাকি আমাকে খুঁজতে বলছে? তবে আজ তার কণ্ঠে ‘আপনি’র বদলে ‘তুমি’ শব্দটি শুনলাম।
আমি জানতাম–এই গল্প এখানেই শেষ নয়।